কবিতার জন্মদিন

 


কবিতার জন্মদিন

নবী হোসেন নবীন



কদম আলী আমার এক সময়ের সহপাঠী। ছারাবস্থায় সে টুকটাক কবিতা লিখত। মাঝে মাঝে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে তার স্বরচিত কবিতা পড়ে শুনাত। প্রথম প্রথম সহপাঠীরা তাকে ফুল কবি, পাতা কবি বলে ডাকত। কিন্তু সে তা গায়ে নিত না। এক সময় জীবিকার তাগিদে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। এর পর দীর্ঘ দিন কদম আলীর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। একদিন হঠাৎ আমার লেখার টেবিলের সামনে কদম আলী এসে হাজির। তাকে দেখে আমি কিছুটা অবাক হলাম। তার মাথার চুল লম্বা হয়ে ঘাড়ের নিচে নেমে গেছে। দাড়ি-ঘুপে মুখ আচ্ছন্ন। দেখে মনে হলো যেন কোনো সন্যাসী এই মাত্র আস্তানা থেকে উঠে এসেছে। তার হাতে একটা ফাইল। ফাইলে বেশ কিছু এলোমেলো কাগজ পত্র। তাকে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে বসতে বললাম। সে বসে ফাইল হতে একটা চিঠি বের করে আমার সামনে রাখল। জিজ্ঞেস করলাম কিসের চিঠি? সে বলল, আমার কবিতার জন্মোৎসবের দাওয়াত পত্র। কদম আলীকে আমি কখনও নিজের জন্মদিন পালন করতে দেখিনি। এবারই প্রথম হঠাৎ ঘটা করে কবিতার জন্মদিন পালন করেছে আনুষ্ঠানিক ভাবে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী সহকর্মী সবাই দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ অতীতের স্মৃতি চারণের পর যাওয়ার সময় বলে গেল অনেক কষ্টে ঠিকানা সংগ্রহ করে এসেছি যাবে কিন্তু। বললাম, ঠিক আছে। 


        আমি ভেবেছিলাম কবিতা কবির কোনো মেয়ের নাম হবে হয়ত। না গেলে মেজবানের কাছে নিজেকে ছোট করা হবে। তাই সাধ্যমত কিছু উপহার সামগ্রী নিয়ে আমিও হাজির হলাম কবির বাড়িতে। গিয়ে দেখি কবিতা কোনো মেয়ের নাম নয়, কবির লেখা কবিতা। সুন্দর করে ঘর সাজানো হয়েছে। রং বেরঙের কাগজ কেটে দেয়ালে সেঁটে দেয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে কবির স্বরচিত কবিতাও শোভা পাচ্ছে দেয়ালে। ঘরের দৈর্ঘ্য বরাবর একটি দেয়ালে বড় হরফে লেখা আছে একটি কবিতা। যার শিরুনাম “গোলাপ যদি প্রেম হতো”। কবিতাটি এখন পুরোটা মনে পড়ছে না তবে প্রথম দিকের কয়কটি চরণ ছিল এমন


“গোলাপ যদি প্রেম হতো 

প্রেম হতো সুবাসিত।

প্রেমিক হতো অলি

অকালে ঝরে পড়ত না আর কোনো কলি”।


এ কবিতাটিরই জন্মদিন আজ। কবিতার জন্মদিন বাংলাদেশে এই প্রথম নাকি সারা বিশ্বেই প্রথম তা নিয়ে আমি কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেলাম। মানুষের যে কত বিচিত্র রকমের ভাবনা ও শখ থাকতে পারে তা ভেবে কিছুটা অবাকও হলাম।


        অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছে তিন পর্বে। প্রথম পর্বে কবির কবিতা সম্পর্কে আলোচনা। দ্বিতীয় পর্বে কবির লেখা কবিতা আবৃত্তি। তৃতীয় পর্বে প্রীতি ভোজ। আলোচনা শুরু হয়েছে। এক জন আলোচক তার আলোচনায় বললেন, আমাদের মত এমন দরিদ্র ক্লিষ্ট দেশে কবিতার জন্মদিন পালন করা খুব সহজ কথা নয়। এর জন্য যতেষ্ট আত্মবিশ্বাশ ও সৎ সাহস থাকা প্রয়োজন যা কবি কদম আলীর আছে। আর এক জন বললেন, যে দেশে এখনও অসংখ্য মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে জীবন যাপন করে সে দেশে কবিতার জন্মোৎসব পালন করা সত্যিই গর্বের বিষয়। কবি কদম আলী এ কর্মের সূচনা করে ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এক জন বললেন, যে দেশের অর্ধেক মানুষ এখনও দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে সে দেশে কনিতার জন্মোৎসব প্রামাণ করে আমারা শিল্প-সংস্কৃতিতে কতটা এগিয়েগেছি। আমাদের আর পিছেনে ফেরার সময় নেই। সামনে এগিয়ে যেতে হবে তাই আমি আশা করছি কবি কদম আলী প্রতি বছরই তাঁর এক একটি কবিতার জন্মদিন পালন করবেন। আমি বসে বসে বক্তৃতা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম যে এখানে আসাটা সত্যিই ভুল হয়েছে। এখন যদি আমাকে কিছু বলতে বলা হয় তাহলে আমি কী বলব এ নিয়ে যখন চিন্তিত হয়ে পড়লাম তখনই মাইক থেকে আমাকে অনুরোধ করা হলো কিছু বলার জন্য। অগত্যা কী আর করা ধীর পদে এগিয়ে গেলাম মাইকের কাছে। বললাম সুধিবৃন্দ, যে দেশে কবির জন্মদিন পালিত হয় না সে দেশে কবিতার জন্মদিন পালন করা হাস্যকর। ভেবেছিলাম অনুষ্ঠানে পিন পতন নীরবতা নেমে আসবে কিন্তু ঘটল উল্টো ঘটনা। টেবিল চাপড়িয়ে সবাই আমাকে উৎসাহ দিতে লাগল। সবাইকে শান্ত করে আবার শুরু করলাম, যদি আমারা আমাদের নিজ নিজ এলাকার গুণীজনদের প্রাপ্য সম্মান দিতাম তাহলে আমাদেরকে আজকের মত কবির উপস্থিতিতে কবিতার জন্মদিন পালন করতে হতো না। আমরা কখনও কখনও নিজের আত্মতৃপ্তির জন্য কিংবা সুনাম সুখ্যাতির জন্য অথবা শখের বসবর্তী হয়ে এমন সব ব্যয়বহুল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকি যার ব্যয় দ্বারা কয়েক জন ভাগ্যাহত মানুষের ভাগ্য বদলে দেয়া যায়। এবার অনুষ্ঠানে আমার কাঙ্খিত নীরবতা নেমে এলো। সবাই মাথা নিচু করে আমার কথা শুনছিল। আমি বললাম, বন্ধুগণ আসুন আমরা কবিতার জন্মোৎসব পালন না করে কবিকে সম্মানিত করি। এই বলে আমি আমার আনিত একটি নোট খাতা ও কলম কবির হাতে তুলে দিয়ে আমি মঞ্চ থেকে নেমে এলাম। উপস্থিত সবার উপহার সামগ্রীগুলো আজকের অনুষ্ঠানের সাথে অনেকটাই বেমানান হয়ে গেল। কারণ সবাই আমার মত ধরেই নিয়েছিল যে কবিতা কবির কোনো মেয়ের নাম হবে।


  অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে কয়েক জন অতিথি কবির লেখা কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করলেন। পরিশেষে কবি কদম আলী তাঁর স্বরচিত গোলাপ যদি প্রেম হতো কবিতাটি আবৃত্তি করলেন। আবৃত্তি তো নয় যেন কুড়াল দ্বারা বয়স্ক গাছ কাটার শব্দ। তার পর শুরু হলো তৃতীয় পর্ব প্রীতিভোজ। বিশাল আয়োজন যেন বিয়ে বাড়ি। দেশি মুরগীর রোস্ট, খাসির কোর্মা, গরুর কালো ভোনা ও সুগন্ধী চালের পোলাও পাক করা হয়েছে। সবাই তৃপ্তি সহকারে খাইল বটে তবে খাবারের মান অনুযায়ী রসাত্বক আলোচনা আর তেমন জমলো না। আমিও খাবার সম্পর্কে আর কিছুই বলিনি। সবাই দাওয়া দাওয়া শেষ করে নীরবেই চলে গেল। আমিও বিদায় নিয়ে আসতে আসতে ভাবলাম এ ধরণে একটি অপ্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানে না আসলে হয়ত জানতেই পারতাম না যে কবিতারও জন্মোৎসব হতে পারে। অনুষ্ঠানটি যত হাস্যকরই হউক না কেনো তার বার্তাটি কিন্তু মোটেও হাস্যকর মনে হলো না।


গ্রাম-বাঁশিল ডাকঘর-কাঠালী

উপজেলা-ভালুকা, ময়মনসিংহ



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট