শ্রাবণ অশ্রুতে ভেজে মন
রিতা আক্তার
কিছুকিছু মানুষ দুঃখকে পুষে রাখে যতœ করে। গত আট টি বছর ধরে অর্কও মিতুর স্মৃতি যতœ করে তুলে রেখেছে তার হৃদয়ের নীল খামে। এই স্মৃতিটুকু একন্তই অর্কের নিজের, যা দেখার অধিকার সে কাউকে দেয়নি।
আজ পয়লা আষাঢ়। হুম..
এমন এক বর্ষাঘন দিনে দেখা হয়েছিলো মিতুর সাথে। দোয়েল চত্তরের উল্টো পাশে মাটির শো পিস গুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলো সে। এমন সময় আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। সে কি বৃষ্টি! অর্ক বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য জায়গা করে নিলো মিতু পাশেই। বেশ সাদামাটা পোশাক, নেই কোনো বাড়তি মেকআপের ছোঁয়া, একটু কাজল আর ছোট্ট একটা টিপে একটা মেয়েকে এতো সুন্দর দেখতে হতে পারে জানা ছিলো না অকের্র। এইচ এস সি তে ভালো রেজাল্ট করে এখন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে অর্থনীতি তে ভর্তি হয়েছে সে। মফস্বলের এক ছোট্ট শহর থেকে এসেছে অর্ক। বাবা একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে অর্কই বড়।
রিকশার বেল বাজতেই হুঁস ফিরে এলো অর্কের। কি জানি কতক্ষণ সে মিতুর দিকে তাকিয়ে অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিলো জানে না। কিন্তু মিতু কোথায়! এদিক ওদিক তাকিয়ে মেয়েটিকে আর দেখতে পেলো না অর্ক। এতো বৃষ্টি ঝরছে যে, এদিক ওদিক যাওয়ারও জো নেই। বৃষ্টিটা হালকা হতেই সে মেসের দিকে রওনা হলো। কিছু টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছে রুমমেট আসিফ। বড় ভালো ছেলে সে। পরউপকারীও বটে। মেসে ফিরে খেয়ে আবার টিউনশি পড়াতে যেতে হবে অর্ককে।
কিছুতেই যেনো মিতুর মুখটা ভুলতে পারছে না সে।
পরদিন ক্যম্পাসে গিয়ে ক্লাসগুলো শেষ করে লাইব্রেরীতে গেলো অর্ক। প্রয়োজনীয় নোট লিখে ফিরে আসার সময় আচমকাই মেয়েটার দিকে চোখ পড়লো তার। হ্যাঁ গতকাল দেখা সেই মেয়েটাই তো। এক মনে পড়ছে আর লিখে যাচ্ছে। চারদিক কি হচ্ছে সেদিকে মনোযোগ নেই তার। দেখেই বোঝা যায় বেশ শান্ত স্বভাবের মেয়ে মিতু। কাছে গিয়ে অর্ক জানতে চায় নাম।
আমার নাম মিতু - উত্তর দেয় মিতু।
- কোন ডিপার্টমেন্ট?
- সোস্যাল ওয়েলফেয়ার।
অর্কও তার পরিচয় দেয় মিতুকে।
আর বিশেষ কিছু প্রশ্ন উত্তরের মাঝে না জড়িয়ে মিতু তার গন্তব্যে পা বাড়ায়।
এভাবেই মিতুর সাথে অর্কের দেখা হয় কথা হয়।
বন্ধুত্ব গড়ে উঠে একে অপরের সাথে।
অর্কের মতো মিতুও মফস্বল শহর থেকে পড়তে এসেছে ঢাকায়। হোস্টেলে সিট না থাকায় দূর সম্পর্কের এক মামার বাসায় থাকে সে। মামার দুই ছেলে মেয়েকে পড়ায়। ফাঁকে ফাঁকে ঘরের কাজে মামীকেও সাহায্য করে। মামা- মামী দুজনই খুব ভালো মানুষ। মিতুর বাবার মারা গেছেন তিন বছর হলো। গ্রামের বাড়িতে ছোট ভাইটাকে নিয়ে থাকে মা। দর্জির দোকানে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চলে তাদের।
এভাবেই তাদের দিন গুলো কেটে যায়।
অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয় অর্ক ও মিতু।
মিতু এখন হোস্টেলেই থাকে। একটা প্রাইভেট কম্পানিতে পার্ট টাইম জব করে মিতু। পড়াশুনার খরচ, হাত খরচা রেখে বাকি টাকা সে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয় প্রতি মাসে। অর্কও বেশ কয়েকটা টিউশনি করে নিজের খরচ জোগাড় করে নেয়। বৃদ্ধ বাবাকে সে আর আর্থিক চাপে রাখতে চায় না।
বেশ কেটেই যাচ্ছিলো অর্ক ও মিতুর জীবন।
একদিন হঠাৎ একটা ফোন এলো অর্কের কাছে বাড়ী থেকে। অর্কের বাবা খুব অসুস্হ্য। খবর পেয়েই সে চলে গেলো বাড়ীতে। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো কিন্তু অর্ক আর ফিরলো না। এদিকে ওকে মিতু ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু সুইট অফ পাচ্ছে। এর আগেও অর্ক বাড়ীতে গেছে তবে এক দু দিন এর বেশি থাকেনি সে। আজ গোটা একটা সপ্তাহ পার হয়ে গেলো কিন্তু সে ফিরছে না। বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে কেঁদে উঠছে মিতুর। তার কেনো এমন লাগছে? চারপাশে কত মানুষ তবুও কেনো বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে অর্কের জন্য। কেমন একটা শূণ্যতা বিরাজ করছে তার ভেতর। কি যেনো নেই, কি যেনো নেই। তবে কি মিতুও অজান্তে অর্ককে ভালোবেসে ফেলেছে? তাই ই হবে। নয়তো কেনো বারবার অর্কের জন্য তার মনটা পুড়ছে। এভাবেই চলতে থাকে কয়েকটা দিন। রাত গিয়ে দিন আসে, দিনের শেষে রাত। ক্লান্ত মনটা খুঁজে ফেরে এদিক ওদিক যদি অর্কের দেখা পাওয়া যায়।
আজ সেকেন্ড আওয়ারে কোনো ক্লাস না থাকায় মিতু চলে যায় লাইব্রেরীতে। একটা নোট লিখবে বলে বইয়ের পাতা উল্টে যায়। কিছুই যেনো ভালো লাগছে না তার। ভাবছে ক্যম্পাসের মাঠের এক কোণে বসে থাকবে। এই জায়গাটিতে রোজ অর্ক আর সে কত গল্প করেছে। অর্কের কথা ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে কখন যে জল গড়িয়ে পড়ছে তাও টের পায়নি মিতু। হঠাৎ তার কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে সে। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো অর্ক। জানিনা কি ভেবে মিতু জড়িয়ে ধরলো অর্ককে শক্ত করে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। যেনো সকল ব্যথার পাহাড় আজ গলে গলে লুটিয়ে পড়ছে অর্কের বুকে। লাল চোখে তাকিয়ে মিতু জানতে চাইলো - সেই বাড়ী গেলে এরপর আর কোনো খোঁজ নেই তোমার। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছো, আমি কতবার ট্রাই করেছি একবারও পাইনি তোমায়। আচ্ছা তুমি কি বলতো? আমার তো চিন্তা হয় তোমার জন্য। এতোদিনে একবারও কি মনে পড়েনি আমার কথা তোমার? এতো কঠিন হলে কি করে তুমি?
অর্ক তার মিতুর ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল-পাগলী একটা, এতো প্রশ্ন এক সাথে!!
বসো, বলছি তোমায়। একটু শান্ত হও এবার।
মিতু চোখের জল মুছতে মুছতে জানতে চাইলো -
বলো কি হয়েছিলো তোমার?
তোমার মুখটাও বেশ শুকনো লাগছে। সব ঠিক আছে তো? বাবা কেমন আছে?
অর্ক মিতুর হাতে হাত রেখে বললো - বাবা আর বেঁচে নেই মিতু। আমি পৌঁছবার আগেই চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। মা ভেঙে পড়েছে খুব। পুরো সংসারের ভার এখন আমার উপর। ছোট ভাই বোনগুলোর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। কি করবো? কি হবে? কিছুই মাথায় আসছেনা জানো...।
আচ্ছা তোমার কি হয়েছে বলতো মিতু?
আমায় অমন জড়িয়ে ধরে কাঁদলে কেনো?
এই বন্ধুটির উপর বুঝি খুব অভিমান হয়েছে তোমার?
নাও, আমি তো এখন তোমার সামনে, যা শাস্তি দিতে হয় দাও আমায়।
মিতু মাথা নিচু করে শুধু একটা কথাই বলল অর্ককে -
আজ থেকে সারা জীবনের জন্য আমাকে তোমার পাশে রাখবে, সুখে দুঃখে সব সময়, সারাক্ষণ..... এটাই তোমার শাস্তি।
অর্ক বলল- বোকা মেয়ে, তোমার মতো বন্ধুকে আমি দূরে রাখবো এমন সাধ্য কি আর আমার আছে বলো।
মিতু অর্কের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল - আমি তোমাকে ভালোবাসি অর্ক। পারবে না, এই আমিটাকে তোমার হৃদয়ে ঠাঁই দিতে।
অর্ক মিতুর কথা শুনে অপলক চেয়ে থাকলো ওর দিকে। যে মেয়েটিকে সে একদিন দেখেছিলো আষাঢ়ী কাব্য হয়ে দোয়েল চত্তরে, যাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলো, যাকে হারাবার ভয়ে কোনো দিন মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা সে বলতে পারেনি কোনো দিন, আজ এক পশলা বৃষ্টির মতো সে বুকে আঁছড়ে পড়ছে ভালোবাসার ঢল হয়ে। একি সত্যি! নাকি তাঁর কল্পনা...।
মিতুর হাতটি শক্ত করে ধরে বলল- মিতু আমিও যে তোমায় অনেক ভালোবাসি। মিতুর কপালে আলতো চুমু দিয়ে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো।
আর বলল- এই পাগলীটাকে আমি আমার কাছে রেখে দিবো সব সময়। ভালোবাসায়, মমতায়, আদরে রাঙিয়ে দেবো তোমায় মিতু। শুধু আমায় একটু সময় দাও। নিজের পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত করে নেই। এরপর আমরা নিজেদের সংসার শুরু করবো সবার দোয়া ভালোবাসার মাধ্যমে।
মিতুও চোখের জল মুছতে মুছতে বলল- ঠিক আছে। তাই হবে।
এখন চলো তো ক্যন্টিনে যাই, তোমার মুখটা দেখে তো বোঝা যাচ্ছে কিছুই পেটে পড়েনি।
হুমমমমম চলো যাওয়া যাক, অর্ক বলল।
দেখতে দেখতে ইউনিভার্সিটির গন্ডি পেরিয়ে দুজনেই ভালো একটি চাকরীর খোঁজ করতে থাকে। তবে দেশের পরিস্থিতি এমন হয়েছে হাজার হাজার বেকার সেন্ডেলের তলা ক্ষয় করছে একটি চাকরী পাবার আশায়। মুখ থুবড়ে পড়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। প্রতি নিয়ত চাকরী নামক সোনার হরিণ খুঁজে খুঁজতে অভাব গ্রাস করে প্রতিনিয়তই। ভালো রেজাল্ট করা সত্বেও অর্ক ও মিতু তেমন ভালো চাকরী পেলো না। অর্কের চাকরী হলো একটি প্রাইভেট কম্পানিতে আর মিতু একটি বেসরকারী স্কুলে। নিজেদের চলবার মতো খরচ যুগিয়ে বাকি টাকা দুজনেই যার যার মায়ের কাছে পাঠায়। মাস শেষে যখন টাকা গুলো হাতে পায় পরিবার তখন একটু হলেও তো ওদের অভাবটা পূরণ হয়। এর থেকে বেশি তো আর কি করাই বা যেতে পারে? ইচ্ছা যেখানে প্রবল স্বাধ সেখানে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে।
বছর দুয়েক পর ওরা সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করবে। দু পরিবার থেকেও কোনো অমত হয়নি। সবার সম্মতিতে বিয়ে হয় ওদের। দুজন যা আয় করে তাতে বেশ খানিক টাকা চলে যায় বাসা ভাড়া দিতে দিতে। তবুও তো জীবনে থেমে থাকতে দেয়া যায় না। একটু একটু করে দুজনের দু কামরার ঘর সাজায়। বছর তিনেক বাদে অর্কের ঘর আলো করে আসে মেয়ে শ্রাবণী। শ্রাবন মাসে জন্ম বলেই মেয়ের নাম শ্রাবনী রাখা হয়েছে। অর্কের আনন্দের মূহুর্তগুলো কেমন করে যেনো আষাঢ়েই এসে আটকে যায়। এটাই অর্কের কাছে খুব অবাক করা বিষয়। অর্ক মিতু একে অপরকে যেমন সম্মান করে তেমনি ভালোওবাসে। একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থাও রয়েছে সব চেয়ে বেশি। শত অভাব অনটন গায়ে না লাগিয়ে একমাত্র মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবে বলেই কত চেষ্টা। ভালোবা তো এমনই হয়। ওদের ঘরে টাকার অভাব ছিলো ঠিকই তবে একটা মানুষিক প্রশান্তি ছিলো। এটাই তো ওদের সুখের, ওদের ভালোবাসার মূল মন্ত্র।
দেখতে দেখতে ওদের মেয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেলো।
এক রাতে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে মিতু বারান্দার রেলিং ধরে আকাশ দেখছিলো। অর্ক দু’ কাপ চা এনে দাঁড়ালো মিতুর সামনে। মেঘের ভেলায় ভেসে চলেছে পূর্ণিমার চাঁদ। কি অদ্ভুত তার রূপ। চারদিক যেনো ঝলসে যাচ্ছে পূর্ণিমার আলোয়।
মিতু ঐ গান টা ধরো না? বলল অর্ক।
- কোন গানটা?
- চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে.....।
মিতু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গাইতে লাগলো এক মনে,
চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো, ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো.......।
মিতু যখন গান গাইছিলো, অর্ক আপন মনে মিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এখনও সেই প্রথম দেখা মিতুকেই দেখতে পাচ্ছে অর্ক। খুব মিষ্টি একটা মায়া ভরা মুখ। সংসারের এই টানাপোড়েনে মিতু কে সে খুব একটা স্বচ্ছলভাবে রাখতে পারেনি ঠিকই তবে ভালোবাসার কমতি ঘটেনি কখনও।
-কি হলো? কি দেখছো অমন করে?
- তোমাকে।
- যাহ্ আমাকে আবার দেখার কি আছে শুনি।
- আজ তোমায় একটু বেশিই সুন্দর লাগছে।
- ধুর! কি যে বলোনা তুমি।
- হুমমম, যা বলছি তা ঠিকই বলছি।
হয়েছে এই রাত দুপুরে আর প্রেম জাগাতে হবে না তোমায়। এখন শুতে চলো। সকালে তো আবার বাসটা ধরতে হবে আমায়। অনেক দূরের পথ।
ওওও, এই যাহ্, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি ময়মনসিংহ যাবে স্কুলের কাজে, বলল অর্ক।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনটায় কেমন কু ডাকছিলো অর্কের। মিতুর হাত টা ধরে বলল- আজ না গেলেই কি নয়? মনটা কেমন অস্থির লাগছে আমার।
মিতু অর্ককে জড়িড়ে ধরে বলল- ও, তোমার মনের ভুল। বিয়ের পর তো কখনও ছেড়ে থাকোনি আমায়। তাই অমন লাগছে তোমার। আমি খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো। দু’ দিনেরই তো ব্যপার। তুমি চিন্তা করো না।
অর্ক মিতুর কপালে আলতো একটা চুমু দিয়ে বলল- সাবধানে যেও, পৌছে ফোন দিও। তোমার ব্যাগে বিস্কুট আর ফল রেখেছি, পানিও আছে রাস্তায় খেয়ে নিও কেমন।
আচ্ছা ঠিক আছে জনাব, খেয়ে নিবো। তুমিও সময় মতো খেয়ে নিও। নিজের খেয়াল রেখো। আর শ্রাবণীকে দেখে রেখো কেমন, এবার তবে আসি, নয়তো বাস মিস হয়ে যাবে -বলল মিতু।
একটা রিকশায় উঠলো মিতু, বাসস্টান্ডের দিকে রওনা হতেই আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো।
যাহ্, এমন সময় বৃষ্টিকে আসতে হলো, বিরক্তি গলায় বলল অর্ক। ঘরের ভেতর থেকে দৌড়ে ছাতাটা এনে মিতুর হাতে দিয়ে বলল- সাবধানে যেও।
রিকশা চলতে থাকলো। মিতু রিকশার হুড নামিয়ে পিছন ফিরে অর্ক কে দেখতে লাগলো। অর্কও রিকশাটাকে দেখতে লাগলো যতক্ষন অবধি গলিটা পার না হয়। এরপর একসময় দুজনের দৃষ্টিও মিলিয়ে গেলো পথের সীমায় এসে।
বাসটা সময় মতোই ছাড়লো। মিতুর সাথে রয়েছে ওরই দুজন কলিগ। বৃষ্টির যেনো থামার ইচ্ছাই নেই আজ। ঝরছে তো ঝরছেই। আকাশের আজ বড্ড মন খারাপ হয়েছে বোধ হয়, তাই অমন কাঁদছে আজ।
ঠিক সময়ে মিতুরাও পৌছে গেলো ময়মনসিংহ। দু’ দিন পর কাজ শেষ করে আবার রওনা হলো ঢাকার দিকে। পথে বাসটি তিনবার থামলো, ড্রাইভার হেলপার মিলে ঠিকও করলো বাসটা। বলল ব্রেক একটু নড়বড় করছে তবে ভয়ের কিছু নেই। বাস আবার তার আপন মনে চলতে শুরু করলো। বেশ কয়েক মাইল যাওয়ার পর বাসটির ব্রেক আর কাজ করছিলোনা। ড্রাইভার তবুও যাত্রিদের কিছু বলেনি, তারা ভয় পেয়ে যাবে বলে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো বাসটিকে একটু সাইডে থামানোর। তা আর হয়ে উঠেনি, বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসের সাথে সংঘর্ষ হয়। বাসে থাকা ২৫ জন যাত্রির মধ্যে সাত জন নিহত হয় ১১ জন গুরুতর আহত এবং বাকিরা কম আহত হয়।
নিহতদের মধ্যে মিতু ও তার একজন কলিগও রয়েছে। আরেকজন কলিগ বেশ আহত হয়েছে। তবু সে এই দূর্ঘটনার সংবাদ সবার বাড়ি ফোন করে বলে দেন এবং স্কুলেও জানান।
অর্ক ঘটনাটি শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। তার পুরো শরীর যেনো অবশ হয়ে আসতে লাগলো। মিতু নেই এটা যেনো কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারলো না অর্ক।
সে ছুটে গেলো মিতুর কাছে। হাসপাতালের মর্গ থেকে যখন মিতুর লাশটাও আনা হলো অর্কের সামনে তখন সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিলো মিতুর নিথর দেহটা। কাপড়টা রক্তে ভিজে গেছে। মুখ থেকে কাপড় সরাতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অর্ক। বুকের মধ্যে শক্ত করে মিতুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো অর্ক।
দাফনের জন্য যখন মিতুকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো গোরস্থানে তখন পাঁচ বয়সী শ্রাবণী বাবার পাঞ্জাবীর কোনা ধরে বলতে লাগলো - ওওও বাবা, বাবা, মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? মা কথা বলছে না কেনো? মায়ের কি শরীর খারাপ হয়েছে? মা ঘুমিয়ে আছে কেনো বাবা?
অবুঝ মেয়ের এ প্রশ্নের কি উত্তর দিবে ভেবে পায়না। চোখের পানি মুছতে মুছতে মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে বলল- মামনি, তোমার মা ঐ দূর আকাশের একটা তারা হয়ে গেছে। রোজ রাতে তুমি আকাশের দিকে তাকিও, ওখানে দেখতে পাবে মাকে........।
আজ আট বছর হয়ে গেলো মিতু নেই। শ্রাবনীর বয়স ষোলোতে এসে পড়েছে।
বারান্দায় মিতুর প্রিয় শাড়িটি হাতে নিয়ে বসে আছে অর্ক। এই শাড়িটা খুব প্রিয় ছিলো মিতুর। এই শাড়িটায় এখন মিতুর শরীরের গন্ধ লেগে আছে, যা কেবল অর্কই টের পায়।
আজ মিতুর মৃত্যু দিবস, আট বছর পার করে গেলো মিতুর শূণ্যতা। তবুও কত যতœ করে আজও অর্ক তার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসার স্মৃতি যতœ করে তুলে রেখেছে নিজের কাছে।
মানুষ তো চলেই যায়। সত্যিই কি চলে যায়?
চলে গিয়েও যে তারা ফিরে আসে আমাদের মনে অবিরত বর্ষার ধারা হয়ে।
মিতুও তেমনি দূর আকাশে থেকে আজও অর্কের মনে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে.......।
রামপুরা, ঢাকা।