মাজরুল ইসলাম
[গত সংখ্যার পর...]
সপ্তদশ শতাব্দীর কাছাকাছি সময় মাড়ওয়ার থেকে এই বংশের অন্যতম আদি পুরুষ হীরা নন্দ সাহু পাটনাতে আসেন এবং আর এক বেনিয়া ইংরেজদের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য কুঠি গড়ে তুলেন। তাঁর বড় ছেলে জাহাঙ্গীর নগরে একটি কুঠি স্থাপন করেন। জাহাঙ্গীর নগর তখন বাংলার রাজধানী মানিক চাঁদের উত্তরাধিকারী ফতে চাঁদ ১৭২২ সালে নবাবদের নিকট থেকে জগৎ শেঠ উপাধি লাভ করেন। মুর্শিদকুলী খাঁর দারোগা রঘু নন্দনের মৃত্যু হলে ফতে চাঁদ নবাবের ব্যাঙকার হন। জগৎ শেঠের আদি বাড়ি ছিল মহিমা পুরে। যা এখন ভাগীরথীর গর্ভে বিলীন হয়েছে। অতীতের গৌরব আজ ধূলিসাৎ। ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে ইদ্রপুরীতুল্য রাজপ্রাসাদ।
খাজা খিজির: খোয়াজ খিজির বা খোয়াজ পরির কাহিনি আরবি লোক প্রবাদ থেকে শোনা যায়। খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকে আরব দরবেশ ইব্রাহিম ইবন অহদম তাঁর সুফি সাধনায় এই অলৌকিক পুরুষের কথা প্রচার করেন। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী খোয়াজ হলেন জলের মালিক। সঞ্জীবন বারি পান করে তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী ও সিদ্ধকাম মহাপ্রাজ্ঞ। তিনি নদী- সমুদ্রে ঝঞ্ঝা আনেন আবার ভক্তকে উদ্ধারও করেন। অনেকের মতে নবী ইলিয়াস ইহুদীদের কাছে যিনি এলিজা নামে পরিচিত, তিনিই এই রূপক চরিত্রে পরিচিত হয়েছেন। এনিয়ে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য অনেক প্রবাদ প্রচলিত আছে। এতে মুসলমানদের মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। নদ- নদী এবং সমুদ্র মধ্যে বিপন্ন নাবিকদের রক্ষা করে বলে জনসাধারণের বিশ্বাস, বিশেষ করে সিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে। ঢাকার নবাব মকরমখাঁর সময়ে বাংলার মুসলমান এই অনুষ্ঠানের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ জানতে পারে। পূর্বে এই পর্ব অতি সমারোহে পালিত হত। আজও লালবাগ কেল্লার সামনে ভাগীরথী তীরে সিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে। ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার এই উপলক্ষে কলা গাছের প্রকান্ড আলোকজান প্রস্তুত হয়। তার উপর নানা বর্ণের রঞ্জিত এবং কাগজে ও অভ্রে সুশোভিত করে। এই উৎসব বেরা নামে পরিচিত। ধারণা করা যায় লালবাগ শহরে এই উৎসবের প্রচলন করেন মুর্শিদকুলী খাঁ।
তোপখানা ঘাট: বাংলার রাজধানী ও মুর্শিদাবাদ শহর রক্ষার জন্য কাটরার দক্ষিণপূর্বে গোবরানালা বা কাটরা ঝিল ঘেঁষে একটি অস্ত্রাগার তৈরি করেছিলেন মুর্শিদকুলী খাঁ। এখনও জাহানকোষা কামান অতীতের নবাবী প্রতাপের নীরব সাক্ষীস্বরূপ একটি বেদীর উপর দৃশ্যমান। কামানটি অষ্টধাতুর নির্মিত। বাংলাদেশের কুলাউড়ার জনার্দন কর্মকারের খ্যাতি ছিল উপমহাদেশ ব্যাপী। মোঘল যুগে কুলাউড়ায় সমরাস্ত্র বন্ধক কামান তরবারি তৈরি হত।
প্রাচীন সমরাস্ত্রের এবং আধুনিক সমরাস্ত্রের গতি- শক্তি নিয়ে কথা উঠতেই পারে। কিন্তু এখন যেরূপ যুদ্ধের ব্যুহ সাজানো হয়ে থাকে, প্রাচীন কালেও সেরকম ব্যুহ সাজানোর নিয়ম চালু ছিল। যিনি ব্যুহ সাজান তাকে মহাব্যুহপতি বলা হত।
মুর্শিদাবাদের জাহানকোষা কামান তৈরি করার সময় নিযুক্ত ছিলেন জাহাঙ্গীর নগরের দারোগা শের মহম্মদের ও পরিদর্শক হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে প্রধান কর্মকার জনার্দন দ্বারা অক্টোবর মাসে ১৬৩৭ খ্রীষ্টব্দ নির্মিত হয়েছিল। এই তোপের ওজন ২১২ মন এবং অগ্নিসংযোগ করতে ২৮ সের বারুদের প্রয়োজন হতে।
বুধুরি গ্রাম: ভগবানগোলার ইতিহাস সুপ্রাচীন। এই ভগবানগোলার নিকটেই বুধুরি গ্রাম। এখানেই রামচন্দ্রে ও গোবিন্দ বসবাস করতেন। রামচন্দ্র ধর্ম প্রচারের জন্য দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন। গোবিন্দ প্রথমে শক্তি- উপাসক ছিলেন। তাঁর অনেকগুলো শাক্ত পদে কথা জানা যায়।পরে রামচন্দ্রের অনুরোধে শ্রী নিবাস আচার্য বুধুরিতে এসে গোবিন্দকে দীক্ষা দেন। তিনি চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ কবি। ছিলেন। বুধুরি- বিলাস মতে গোবিন্দ দাস ১৫৩৫ শকাব্দে পরলোকগমন করেন।
কুমোরপাড়ার রাধামাধব মন্দির: সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়াতেই মতিঝিলের পূর্ণ পাড়ে শ্রীজীব গোস্বামীর শিষ্যা হরিপ্রিয়া ঠাকুরানী রাধামাধব মন্দির স্থাপন করেন। এবং এই মন্দিরে রাধামাধব বিগ্রহ প্রতিষ্ঠান করেন। সাবেকি আমলের মাধবীকুঞ্জ বৃক্ষটি এখনও কালের সাক্ষী বহনকারী হিসেবে দৃশ্যমান। কথিত আছে, নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নাকি নিষিদ্ধ খাবার (গোমাংস) ভর্তি পরাত সেবাইতের নিকট পাঠান। পরাত বাহক সেবাইতকে জানায় নবাব দেবতার ভোগ পাঠিয়েছেন। পরাতের ঢাকনা তুলে দেখা গেল পরাত ভর্তি ফুল। বাহক এই ঘটনা নবাবকে জানান এবং নবাব নিজেই সেবাইতের নিকট আসেন। অলৌকিক ঘটনা দেখে মন্দিরের জন্য নিষ্কর জমি দান করেন। তবে এর সত্যতা কতদূর সত্য তা জানা যায় না।
গ্রামের নাম কুমোর পাড়া। মুর্শিদাবাদ জেলার মুর্শিদাবাদ থানার অন্তর্গত প্রান্তিক একটি ছোট গ্রাম। মুর্শিদাবাদ রেল স্টেশন থেকে দক্ষিণে বহরমপুর যাবার পথে মাত্র দেড় -দুই কিমি দূরে। লালবাগ শহরের অদূরে অন্যতম আকর্ষণ রাধামাধব মন্দির। এই মন্দির মতিঝিলের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। মন্দিরে গেলে একদ- বসলেই শান্তি পাওয়া যায়।
[চলবে...]