প্রেম ভয় বিরহ
যাকারিয়া মুহাম্মদ
হঠাৎ একদিন আমরা দুজন আবিষ্কার করি, আমরা পরস্পর বন্ধু। সেদিন আমি আর মৌনতা সকালের মকতব থেকে ফিরছি, বাড়িতে প্রবেশের আগে রাস্তা থেকে বাড়িতে হইচইয়ের শব্দ শুনে দৌড়ে ঘরে এসে দেখি, বড়মামা মামীকে গালিগালাজ করছেন। তিনি ছাড়া ঘরের কেউ কোনো কথা বলছে না। নানী রান্নাঘরে মুখ গোমড়া করে বসে আছেন, আমি তাঁর কাছে গেলাম, তিনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি আর মৌনতা দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, কী ঘটছে আমরা একবিন্দুও বুঝতে পারলাম না। একবার শুনলাম, মামা বরাবরের মতো বড় আওয়াজে বলছেন, ‘হৃদয়কে বাড়িতে পাঠিয়ে দাও, ক’দিন পর ও-ও মৌনতাকে নিয়ে পালাবে’। এ কথা শোনতেই আমার দিকে তাকাল মৌনতা। আমি তখনো কিছু বুঝতে পারছি না।
পরিস্থিতি শান্ত হলে আস্তে আস্তে বুঝতে পারি, রাতে ছোটখালা বড়মামীর ভাই সুহেল মামার সাথে পালিয়েছেন। ছোটমামী সকালে ছোটখালার রুমে গিয়ে একটা কাগজ দেখেন, সেখানে লেখা ছিল- ‘আমি সুহেলের সাথে যাচ্ছি।’ তারপর শুরু হয় এই চেঁচামিচি।
২.
সেদিন আমি আর মৌনতা ইশকুলে গেলাম না, কেউ যেতে বললও না। আমি পেছনের পুকুরঘাটে গিয়ে বসে রইলাম। মাথায় একটা কথাই কেবল বারবার ঘুরছিল, ‘ক’দিন পর ও-ও মৌনতাকে নিয়ে পালাবে।’
দুপুরে আম্মা এলেন। আমরা; ছোটদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে তারা সবাই মিলে এক রুমে বসে কী সব কথা বললেন। আমি আবার ঘাটে গিয়ে বসে রইলাম। মাঝেমধ্যে ঘর থেকে চেঁচানোর আওয়াজ আসছিল। আমি ঘাটে বসে রইলাম, আমার মাথায় সেই একটা কথাই কেবল ঘুরঘুর করছে।
রাতে আম্মাকে আমি মামার বলা কথাটা বলে দিতেই আবার হইচই শুরু হয়ে গেল। আম্মা জোরে জোরে আওয়াজ করে মামাকে কীসব বলছিলেন আর এই কথাটা- ‘আমার ছেলেকে আর তোমাদের এখানে পড়াব না’- বারবার বলছিলেন। আমি দেখলাম, আম্মার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। আমার মনে হল, কথাটা বলা আমার ঠিক হয়নি।
৩.
ছোটখালা তখন কলেজে পড়তেন এবং সুহেল মামাও এখানে থেকে কলেজে পড়তেন। সবাই বলত, তারা খুব ভালো বন্ধু- একসাথে কলেজে যেতেন এবং একসাথে ফিরতেন। মামা-মামাীর বিয়ের পর থেকে সুহেল মামা এখানে, ইশকুল এখানেই শেষ করেছেন।
পরদিন আম্মা বাড়ি চলে গেলেন কিন্তু আমাকে নিলেন না। আমি আর মৌনতা ইশকুলে যেতে-আসতে লাগলাম। আমরা তখন ফাইভে পড়ি। একদিন আমরা ইশকুল থেকে ফিরছি, রাস্তায় রুবেল নামের একজন, যে বড় ক্লাসে পড়ত, সে আমাকে বলল: ‘কী রে হৃদয়! সুহেল আর লামিয়ার মতো তোরাও তো দেখা যায় একসাথে ইশকুলে যাস-আসিস, ভালোই খাতির! বন্ধু বন্ধু লাগে, দেখিস কদিন পর ভাগিয়ে-টাগিয়ে নিয়ে যাস না আবার।’
ভাগিয়ে নেওয়ার কথাটা শোনে বড়োমামার বলা সেই কথাটা আমার মনে পড়ল। কিন্তু বেশি কিছু বুঝতে পারলাম না। তবে আমি আর মৌনতা একে অপরের বন্ধু, এতটুকু বুঝতে পারলাম।
৪.
আমি আর মৌনতা প্রত্যেকে নিজেকে অপরের থেকে ভালো বন্ধু প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। আমরা নিজেদের মনের সব কথা পরস্পরকে বলি, কোনো কিছু লুকোই না, কারণ আমরা শোনেছি— বন্ধু সম্পর্কে কোনোকিছু গোপন থাকা উচিৎ না। বন্ধুত্ব নিয়ে যখনই যার থেকে যা শুনতাম, তা-ই আমরা আমাদের বন্ধুত্বে কার্যকর করতাম।
সময় বরাবরের মতো এগুতে লাগল। আমরা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন। আমি একটু একটু করে অনুভব করতে লাগলাম, আমি মৌনতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি। আর মৌনতাও যে দুর্বল হচ্ছে আমার প্রতি, সেটাও বোঝার বাকি রইল না আমার। তবুও আমি নিজেকে বেধে রাখলাম। যখনই কিছু করার কথা ভাবি, মামার সেই কথাটা আমার মনে পড়ে যায়।
সময় তখনও বয়ে চলছে নদীর জলের মতো। মৌনতা এখন আমার স্বপ্নে এসে হানা দেওয়া শুরু করেছে। আমরা এসএসসিতে ওঠলাম। আমার আর নিজেকে সংবরণ করা সম্ভব হল না। এক শুক্রবারে আমি আর মৌনতা ঘাটে বসে আছি, সাহস করে একসময় আমি মৌনতাকে কৌশলে বলতে শুরু করলাম। অনেকটা এভাবে-
: প্রেম জিনিসটা কী অদ্ভুত। তাই না মৌনতা?
: কেমন অদ্ভুত?
: এই যেমন ধর, আমরা বন্ধু। এবং আমরা আজন্ম বন্ধুত্বের পবিত্রতা অক্ষুণœ রেখে আসছি। আমরা চাই না আমাদের নিয়ে মামার শঙ্কা বাস্তবের রূপ নিক। তবুও দেখ, মন সে কথা বুঝতে চায় না। আসলে আমি নিজের অজান্তে তোকে ভালোবেসে ফেলেছি, মৌনতা।
আমি আরও কিছু বলতে যাব, মৌনতা আমাকে থামিয়ে অবাক করে দিয়ে বলল: চাইলে আমরা প্রেম করতে পারি। আমরা শুধু ভালোবাসব কিন্তু পরস্পরকে নিজের করে চাইব না। আব্বার শঙ্কা ছিল, আমি তোর সাথে পালিয়ে যাব। প্রেম করায় কোনো শঙ্কা ছিল না। চল, আমরা প্রেম করি, ভালোবাসি। শুধু ভালোবাসব, আব্বার শঙ্কাকে বাস্তব হতে দেব না কখনো।
এমন জবাবে যারপরনাই বিস্মিত ও খুশি হলাম।
৫.
আমাদের প্রেমজীবন শুরু হল। আমাদের ভিতরে কী চলছে, তা কাউকে বুঝতে দিলাম না আমরা। পাশাপাশি রুমে থেকেও আমরা মেসেজে কথা বলতাম। ইশকুলে যাওয়া-আসার পথেই কেবল আমাদের মৌখিক প্রেমালাপ চলত। পাছে কেউ সন্দেহ করে এই ভয়ে বাড়ি আমরা সরাসরি মেলামেশা, কথাবার্তা কমিয়ে আনলাম। আর আমাদের এসব সতর্কতা কাজেও লাগল, কেউই বুঝতে পারল না আমাদের ভেতরকার প্রণয়ের কথা।
এসএসসি শেষে লম্বা বন্ধ হল, আমি বাড়ি গেলাম। মেসেজে আমাদের কথাবার্তা হতো দৈনিক। তখন বন্ধ প্রায় শেষের দিকে, হঠাৎ একদিন মৌনতা আমার মেসেজের কোনো উত্তর দিল না। একদিন দুইদিন করে দিন যেতে লাগল কিন্তু কোনো উত্তর নেই। সারাদিন আমি একটা উত্তরের অপেক্ষায় মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকতাম। কোনো উত্তর আসত না। একদিন আম্মাকে মামাবাড়িতে কিছু ঘটেছে কি-না জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন: কিছু তো হয়নি তবে মৌনতার বিয়ে নিয়ে কথা চলছে।
ইশকুল খোলার দুদিন আগে আমি নানাবাড়ি চলে এলাম। এসে জানলাম, মৌনতার বিয়ের দিনতারিখও ঠিক হয়ে গেছে। জানুয়ারির ১৭ তারিখ, আর বেশিদিন বাকি নেই। মৌনতা আমার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে দেখে আমিও আর তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম না। দুদিন পর দুপুরবেলা আমি পুকুরঘাটে বসে ছিলাম, হঠাৎ মৌনতা এসে পাশে বসল। আমি কোনো কথা বললাম না। মৌনতা বলল-
: ‘চল, আমরা পালিয়ে যাই।’
: ‘কেন? আমাদের তো পালিয়ে যাওয়ার কোনো কথা ছিল না।’ কথাটা আমি পুরোপুরি অপ্রস্তুতভাবে বলে ফেললাম। মামার বলা সেই কথাটা আমার মনে পড়ে গেল।
: ‘তুই কি ভালোবাসিস না আমাকে? বাসলে, চল পালিয়ে যাই।’
: ‘আমাদের শুধু ভালোবাসার কথা ছিল, পালানোর না। আমি আজন্ম তোকে ভালোবাসব।’
মৌনতা ওঠে চলে গেল। এ রকম কথা বলা আমার উচিৎ হল কি-না আমি বুঝতে পারলাম না।
৬.
আজ মৌনতার বিয়ে। আমি পাথরের মতো অনুভূতিহীন হয়ে সবকিছু দেখছি। তখন সকাল সাড়ে ন’টা। উঠোনে একটা গাড়ি এসে থামল। আমি বারান্দায় ছিলাম। ঘর থেকেও অনেকে বেরিয়ে এসেছে কে এসেছে দেখার জন্য। সবাইকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে গাড়ি থেকে নেমে এলেন ছোটখালা ও সুহেল মামা। তাদের সাথে ফুটফটে একটা ছেলে। নানী খালাকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেম। তারপর শুরু হল কান্নাকাটি এবং তারপর এতদিন কেমন কেটেছে এইসব কথাবার্তা। মামাকেও দেখলাম, খালাকে বুকে নিয়ে কাঁদলেন। আমি এলোপাথাড়ি ভাবনায় হারিয়ে যেতে লাগলাম।
মৌনতার স্বামী খুবই স্মার্ট। তাকে দেখে ভালো লাগল আমার। কিছুটা হিংসেও হয়েছে কি-না বুঝতে পারলাম না। খাওয়া-দাওয়া শেষে মামা মৌনতাকে তার স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। তারপর, ছোটবেলায় দেখলে দূরে দূরে থাকতাম, ভয় পেতাম, না-জানি কখন তুলে নিয়ে যায়, এ রকম একটা কালো গ্লাসের কালো গাড়িতে করে মৌনতা চলে গেল।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। দেখলাম, বড়মামা সুহেল মামার সাথে কথা কথা বলছেন। যে এতদিন তার ঘরে খেয়ে তার বোনকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল একদা, তার প্রতি এখন কোনো ক্ষোভ নেই তার। অথচ এই ক’বছরে একবারও তাদের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেননি। আমি কিছু ভুল করলাম কি-না এ নিয়ে সংশয়ে এবং গভীর এক দুঃখবোধে মূর্ছা যেতে লাগলাম। মৌনতার কথা ভেবে আমার কাঁদতে ইচ্ছে হল।
ছাতক, সুনামগঞ্জ