বাবু
পারু পারভীন
ক্যাম্পাস থেকে এসে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে বাবু। আজকাল তেমন আগ্রহ করে খায় না। খাবারের পরিমাম ও কমে গেছে। কী হলো ছেলেটার?
ওর ভাত খাওয়া দেখছি আর ভাবছি।এখন বিকেল হয়ে গেছে।দুপুরের ভাত এ অবেলায় খাচ্ছে তাই?
: আর একটু ভাত নে।
: জোর করো না তো মা,
:বমি বমি লাগছে।
: কী হয়েছে রে তোর?
:ভার্সিটিতে ওঠার পর ঠিক মত খাস না।
:রাত জাগিস।
: যাও তো ঘ্যাণ ঘ্যাণ ভাল লাগে না।
: পারলে আমাকে কিছু টাকা দাও।
: কি হবে টাকা দিয়ে?
পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ব্যবসা করব।
:কিসের ব্যবসা?
:ডালের
আমি ভাবলাম এখন ডালের দাম চড়া তাই হয়তো মসুরের ডাল কিনে পাড়ার দোকানদারকে দেবে কিছু লাভের বিনিময়ে।কাওরান বাজার যখন বাসার কাছে। পাইকারী মালের আড়ত।
আমার ভাইরা এমন মৌসুমী ব্যবস করতো।ওদের হাত খরচ চলে যেতো।
কে জানতো ডাল মানে ফেনসিডিল। সর্বনাশ হবার পর জেনেছি।ওর বন্ধুরা এসবের ব্যবসা করে।ওকে মাঝেমধ্যে খেতে ওদেয়। বিনে পয়সায়। থানার পুলিশদের হাত করতে বাবুকে কাজে লাগায়।ওর চাচার নাম ভাঙ্গায় এ কাজে।
একদিন রাতে ঘরে ঘরে অস্থির হাঁটছিল।আমি এশার নামজ পড়ছিলাম। কিছু একটা বলবে মনে হলো।
: কি রে কিছু বলবি?
আম্মা এবার সত্যি সত্যি ব্যবসা করব কিন্তু।কিছু টাকা লাগবে।আব্বার কাছে রোজ রোজ হাত পাততে ভাল লাগে না।
আমি এবার গজগজ করে উঠলাম।
: দেখ বাবু আমাকে আর বিক্রি করিস না। কত আর মিথ্যা বলবি শুনি?
আমার কথা শুনে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।ও কলেজে ওঠার পর সিগারেট খেত লুকিয়ে। এখন নিজের রুমে খায়।ধোঁয়ায় সারা ঘর ভরে যায়।
এমন অবাধ্য হয়ছে যে বললেও কাজ হয় না।ওর বাবা আমাকে দোষ দেয়। আমি নাকি ছেলেটার মাথা খেয়ে ফেলেছি।
টাকা পয়সা নিয়ে বাবা ছেলে প্রায় কথা কাটাকাটিতে যায়। বাবুটা দিন দিন মার মুখো হয়ে উঠছে।
ওর বাবার প্রতি অভিমান ক্ষোভে রূপ নিয়েছে।ঠিক মত ক্লাসে যায় না।
মাথায় চেপেছে বোতামের ব্যবসা করবে।
জিজ্ঞেস করলাম,
:কি বোতাম রে বাবু?
:নারিকেলের মালার?
আমার মেয়েটা বাবু একটু আড়াল হলে বললো,
: আম্মা তুমি এত বোকা কেন?
:ও ইয়াবাকে বোতাম বলছে।
আমি মাথায় হাত দিয়ে বসেরইলাম অনেক্ষণ।
আমাকে আসলেই বোকা বানাতে চাইছে। জমানো টাকা এখন আর আমার কাছে থাকে না।আগে চেয়ে নিতো।এখন রান্না ঘরের যেখানে যে কৌটায় রাখি না কেন ও চুরি করে নিয়ে যায়।
ওর বাবার পকেটেও হাত দেয়।বোনটাও শখ করে কিছু জমাতে পারে না।দে দে করে নিয়ে নেয়।কি করে ও এত টাকা দিয়ে?
প্রশ্নের উত্তর মেলে যখন সেমিস্টার ফি জমা না দিয়ে রাঙামাটি চলে যায় তখন।
তিনদিন পর ফিরে আসে জবাফুলের মত চোখ
লাল করে।ফোন করে অবশ্য বলেছিল রকিবের বোনের বিয়েতে যাচ্ছে।তিনদিন পর ফিরবে।
আজকাল অনেক বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মেয়েটা প্রায় বলে ওর বন্ধুগুলো সুবিধার না।আমিও দেখি সুবিধার না।ওর বাবা সেই কবে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে ওর সাথে।আমরা টাকা চেয়ে আনি।
:বাবু ক্লাসে যাবে টাকা দাও।
: বাবুর মা তুমি কি জানো বাবু যে ক্লাসে যায় না?
শুধু শুধু টাকা দিয়ে তুমি ওর জীবনটা ধ্বংস করছো।
বাবু আসলেই ক্লাসে যায় না।তিন সেমিস্টার বাদ গেছে।প্রাইভেট ভার্সিটি ওরা টাকা পেলেই হয়।
: সারাদিন বাসায় বসে করোটা কী?
ছেলে কই যায় কী করে এসব খবর নেয়া তোমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?
: মেয়ের পেছেন পই পই লেগে থাকো
: ছেলেটা কী তোমার সন্তান নয়?
বাবুর বাবার কমন ডায়লগ। কেন সে ও তো এই দায়িত্বটা পালন করতে পারে। নয়টা পাঁচটার ডিউটির দোহাই সেই সাথে যানজট। বাবু ছোট বেলা থেকে একা একা স্কুলে আসা যাওয়া করতো।কোন দিন সমস্যা হয় নি।
আমি মেয়েকে নিয়ে কলেজ বাসা টিউটর এই করতে করতে বাবু ভেসে যায়।
বাবুর বাবার প্রইভেট জব।নট নড়ন চড়ন অবস্থা। বাবু হারিয়ে যায়।
একদিন বাসায় আসলে দুদিন আসে না।
খুঁজতে যাই এ ওর বাসায়। ফোন ধরেনা।বন্ধু গুলাও এমন।
ছেলে বাসায় না আসলে প্রথম প্রথম আমার ওপর চড়াও হতো ওর বাবা।
: ছেলেকে মাথার ওপর তুলছিলে তো খুব।
: এবার বোঝ কত ধানে কত চাল!
নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতো।এখন কিছু বলে না।চাপা একটা হতাশা বয়ে বেড়ায়।
মেয়েটার ভাল মন্দ নিয়ে ভাবে। আমার মেয়েটা খুব মেধাবী।কলেজে খুব নাম।মেয়েটা একা চলতে পারে না একদম।ওর পেছনে সময় যায়।
এর মধ্যে দু এক বার বাবুর ক্যাম্পাসে গেছিলাম।
উল্টো পথ।যেতে আসতে মেয়ের কোচিং টাইম পার হয়ে যায়।সামনে পরীক্ষা।
এভাবে ছেলেটা হরিয়ে যেতে বসেছে।কাউকে বলি না ঘরের কথা। ছেলে নেশা করে। এটা তো বলে বেড়াবার নয় কিনতু যেদিন বাবুকে ধরে বেঁধে রিহাব দিয়ে আসি সেদিন আমার পুলিশ দেবরটা ফোনে অনেক কথা শুনিয়েছে।
: মান ইজ্জত সব ডুবিয়েছেন আপনারা।
চার মাস পর বাবু ফিরে এসেছে।এখন খুব ভয় পায়।বাইরে যায় না।আমি মেয়েটা নিয়ে বাইরে বের হলে বাহির থেকে তালা দিয়ে যাই।এসে দেখি খাটের এক কোণে উবুজুবু বসে আছে।
ওর বাবাকে দেখলে ভয় পায় আমার পেছনে আড়াল নেয়।
ওর বাবা এখন যথেষ্ট সহানুভুতি দেখায়। ডাক্তার তাই বলেছে।রিহাবে ওরা হাত পা বেঁধে রাখতো।বেদম মারত। একবার ধাক্কা মেরে ওয়ার্ড বয় মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিল।
বাবুকে কোন দিন আমরা মারি নি। চার মাসে কী এমন করলো ওরা যে ও প্রায় উম্মাদ হয়ে গেছে।
মেয়েটা সপ্তাহ খানেক বাসায় নেই।সলিমুল্লাহ মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। হোস্টেলে চলে গেছে।মেধা তালিকায় ছিল তাই ওর ভর্তি হতে টাকা লাগে নি।অবৈতনিক পড়া শুনা।কিন্তু এ আনন্দ আমাদের বাসাটা জাগায় নি। বাবু শিশুর মত হয়ে গেছে।
অনেক দিন পর বাবুর ঘর থেকে ভেসে আসছে গীটারের টুংটাং।কত বছর পর ও গীটারটা বাজাচ্ছে?খুশিতে আমার চোখে পানি চলে এসেছে।মনে মনে বললাম,
: যে ভাবেই হোক বাবু তোকে ভাল করে তুলবো।
কদিন পর বেবীর জন্মদিন।ও বাসায় এসেছে। ভাইকে অনেক দিন পর গান করতে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেলেছে মেয়েটা।
: মনে আছে মা বাবুইটা আগে ঠিক এমন গান করতো।
: কী সুন্দর দিন ছিল আমাদের।
: তুমি কিছু চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাবুর ভয় ভীতি কাটতে শুরু করেছে। আমাদের বাসাটা এতদিন পর যেন একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।