(গত সংখ্যার পর)
১৫.
উর্মিলার ডায়েরি
১০.১০.১৯৮৯
নিজের মধ্যে রূপান্তর লক্ষ করি। রক্ত-মাংস-চিন্তা-চেতনা-আশা-আকাক্সক্ষায় খুব দ্রুত পরবর্তিত হচ্ছে। শুভপুরের বসন্ত পালের কন্যার নিস্তরঙ্গ জীবন-প্রণালীর সঙ্গে আস্তে আস্তে ব্যবধান ঘটতে শুরু করেছে। কত কত বিস্তর চিত্র-অনুষঙ্গ মনুষ্যকুল যুক্ত হচ্ছে, যাদের চাওয়া-পাওয়ার ভাষার সঙ্গে পূর্বে কখনও পরিচয় ছিল না। নাজিম হিকমত লিখেছেন, ‘যারা ধ্বংস করে/ যারা সৃষ্টি করে/ কেবল তাদেরই জীবনকথা মুখর আমার গানে/ আর যা কিছু/ধরো আমার জেলের দশটা বছরÑ/ওসব তো কথার কথা।’ জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দশ বছর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো খেদ নেই।
গতকাল ছড়াকার বাপ্পী শাহরিয়ারকে ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল স্বৈরাচারের সৈনিকেরা। আহ! নিরীহ একজন শব্দশিল্পী তার সমস্ত ঘৃণা শাসকের প্রতি প্রকাশ করার কারণে বঙ্গভূমির একজন গর্বিত সন্তান হাসপাতালের বেডে পঙ্গুত্ব বরণ করে কাতরাচ্ছে। হায়রে বঙ্গভূমি। কত শতাব্দীব্যাপী তুমুল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা অরক্ষিত থেকে গেল।
দক্ষিণ আফ্রিকার আটাশ বছরের তরুণ বেঞ্জামিন মলওয়েজ শ্বেতাঙ্গ শাসনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিল বলেÑতাকে ফাঁসির দড়ি গলায় পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভুবনজুড়ে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। তারপরও কাউকে তো কুতুবদিয়ার বাতিঘরের মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
মানব সভ্যতায় সামরিক বাহিনী মানবকল্যাণ করেছে তার কোনো উদাহরণ নেই। এরা লুণ্ঠনকারী। খুনি। ধর্ষক।
সামাজিক বৈষম্যের একমাত্র কারণ ফসলের সুষম বণ্টন। দীর্ঘ সময় এ ভূখ- শাসিত হয়েছে আধিপত্যবাদীদের দ্বারা। মোগল-হুন-পাঠানের সময় শুধু সম্পদের লোভেই ঔপনিবেশবাদীরা ছুটে এসেছে। আর ধর্মের আবরণেই তা সম্ভব। শাসকবর্গ ওই পথ ধরেই হেঁটেছেন। এরশাদ। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভূখ--পতাকা-সংবিধান পাশ কাটিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা জলাঞ্জলি দিয়ে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করেছে। এ বিষবৃক্ষের ফল কী হবে তা কেবল ভবিতব্যই জানে।
স্বাধীন উপত্যকায় নেমে আসবে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ধর্মের লেবাস পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সোমনাথের লুণ্ঠনকারী সুলতান মাহমুদ নাঙ্গা তরবারি হাতে ছুটে যাবে। কুরুক্ষেত্রে অর্জুন নতুন করে অস্ত্র ব্যবসায় মনোযোগী হবে। অশোকের রক্ত লোলুপতায় বুদ্ধের ধ্যানচ্যুতি ঘটবে। ক্রুসেডে সালাউদ্দিন মনুষ্যত্ব হারিয়ে রিচার্ডকে বধ করাই সমীচীন মনে করবে।
০৯.১১.১৯৮৯
অফিসে ছোট্ট একটি রুম হয়েছে। বেবী আপার রুমের পাশেই। খুব বেশি কাজ নেই। সম্প্রতি ম্যানিলা কনফারেন্স বিষয়ক স্থানীয় পত্রপত্রিকার পেপার কাটিং, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক টীকা ভাষ্য জাতীয় পেপার কাটিং যা বেবী আপাকে বক্তৃতা করতে সাহায্য করবে। দীপু ভাই আমাকে সামগ্রিক সাহায্য করেন। আহা দীপু ভাই। স্বপ্নের মীন কুমার। পুরুষকে অতটা সহজ হলে চলবে কেন? দীপু ভাইয়ের আমার কাছে কিছু চাওয়ার আছে। ক্যামন কাঙালের মতো। বুক ভরে কান্না আসে।
ওকে কেউ পর্বতের কান্নার কথা বলেনি। বুদ্ধদেব বসুর নায়কের বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর হয়। সদা হাস্যে দীপু ভাইয়ের মুখের পেলবতায় কোন্টা কষ্ট আর কোন্টা বেদনার প্রতিভাস তার কিছুই পরিলক্ষিত হয় না। কৌতুকপ্রিয় মানুষটির জন্য অন্তরে কিছু কিছু লাজুক প্রণয় জমতে শুরু করছে।
কলেজ জীবন অদ্ভুতভাবে শুরু হয়েছে। শুভপুরের উর্মিলা যে শঙ্কা নিয়ে নগরে এসেছে তার সঙ্গে কোনও মিল নেই। পাঁচটায় কলেজে পৌঁছামাত্র ডে শিফটের বিভিন্ন সংগঠনের মেয়েরা অপেক্ষা করে। কখন উর্মিলাদি আসবে। চোখে মুখে লজ্জা নিয়ে লক্ষ করে ওপরের ক্লাসের মেয়েরাও ওকে সমীহ করে কথা বলছে। জানতে চায় আগামীতে আন্দোলনের মোটিভ কী হবে?
প্রিন্সিপাল ডলি আপা টিচার্স রুমে ডেকে নিয়ে সম্প্রতি রাজনীতির বহুরৈখিক ব্যাখ্যা চায়। প্রথমে খুব লজ্জা হতো। একদিন বেবী আপা বলেন, ‘উর্মি এখন কিন্তু তুমি আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। তোমাকে এগিয়ে যাবার পথ করতে হবে। জীবনকে নির্মাণ করতে হলে বহুমাত্রিক চরিত্রের সঙ্গে হেঁটে যেতে হবে। আর তার জন্য চাই শিক্ষা। এবং রাজনৈতিক দর্শন।’
তারপর থেকে নিজের মধ্যে অনুভব করি, পে-ুলাম সত্যের দিকে এগিয়ে আছে।
গত এক মাস ধরে বেবী আপার সঙ্গে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল-জামালপুর-কিশোরগঞ্জে অনুষ্ঠিত স্বৈরাচারবিরোধী সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছি। প্রতিটি সমাবেশের আগে অনেক নারী-পুরুষ তরুণ-তরুণীর জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে হয়েছে। ময়মনসিংহ টাউন হলের এক বক্তৃতায় বলি, ‘আমরা গণতন্ত্রের বিকল্প কিছুই খুঁজতে যাব না। রাজা, সামন্ত, জমিদার, হানাদারদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে রাজপথে দাঁড়িয়ে ভাত এবং রুটির অধিকারের জন্য স্থির। পরাজয়ের গ্লানি একাত্তরে ললাট থেকে মুছে ফেলেছি। বঙ্গোপসাগরের ঘোলাজলে রক্তলোলুপ হাঙর চিরকাল এসেছে। আসবে। ভয় কী! আমরাও কাস্তে শানিয়ে রাখব।’
মাইক ছেড়ে তার পাশেই বসতে বলেন বেবি আপা, ‘উর্মি, আমি তো বিস্মিত। এত সুললিতভাবে জরুরি কথা বলার কৌশল আমাকে মুগ্ধ করেছে। তুমি তো নতুন প্রজন্মের আইকন। ইংরেজি ভালো করে শিখতে হবে। এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল করিনি।’
‘আপা।’
‘সত্যি উর্মি।’
তারপর থেকে উর্মিলার টেবিলে বইয়ের পাহাড় জমতে শুরু করেছে। কখনও বেবী আপা, দীপু ভাই নারীনেত্রী আয়েশা বেগম, মানবাধিকার কর্মী সুসাহিত্যিক মালেকা বেগম বইগুলো দিয়েছে। দীপু ভাই দিয়েছে রেমার্কের ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’এর অনুবাদ। অসাধারণ উপন্যাস। মানবিক দলিল। যুদ্ধের ভয়াবহতায় জীবন শুধু মূল্যহীন থেকে যায়।
গত তিন দিন আগে দীপু ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। গ্রাম থেকে তার মা এবং বোন আসমা এসেছে। আসমা জন্মান্ধ। বাইশের তরুণী। আসমার অসম্ভব সুন্দর মায়াবী একজোড়া চোখ আছে। অথচ দৃষ্টিহীন।
দীপু ভাইয়ের মা সাধাসিধে মহিলা। জগতের পঙ্কিলতা মেঘাচ্ছন্নতার আকাশে আনাগোনা কম। সবেধন নীলমণি দীপু ভাইয়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি। আসমার জন্য উৎকণ্ঠায় কাতর বঙ্গীয় বিধবা।
‘দীপু বলে, ‘তোমাকে জগতের সবাই চেনে।’
আমি বলি, ‘দীপু ভাই বেশি বলে।’
‘আমিও তো তাই বলি, ‘এ মেয়েতো আসমার চেয়ে ছোট।’
আসমা বলে, ‘আমি কিন্তু বিশ্বাস করি। দীপু দাদা কখনও মিথ্যে বলে না। তোমাকে তো দেবী সরস্বতী ভাবে। তোমার মতো নারীও এ জীবনে দেখেনি।’
আসমা আমার হাত ধরে। অত্যন্ত মমতাময় হাত।
‘তুমি তো জগৎ জুড়ে থাকা এক মেয়ে ।’
‘আমি শুভপুরের উর্মিলা। বাবা বসন্ত পাল। স্কুল মাস্টার। অতি সাধারণ। সমাজে সাধারণদের সংগ্রাম করতে হয়। নিজেকে রক্ষা করার সংগ্রাম। দিদি, আপনি আমাকে আশীর্বাদ করবেন।’
‘উর্মিলা আমি শুধু আশীর্বাদ পারি।’
ক’দিন যাবৎ ঢাকার রাজপথ উত্তপ্ত। বাঁধভাঙা বন্যার মতো রাজপথে মানুষের ঢল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবন পুলিশি তল্লাশির কারণে ছাত্ররা আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলছে।
স্বৈরাচার রাস্তার দখল নিতে চায়। তা হবে কেন? মানুষের জীবন এত তুচ্ছ নয়।
নূর হোসেন, তোমার স্বপ্নের গণতন্ত্রের জন্য আমি মৃত্তিকায় লুটোপুটি খাব। রক্তস্রোতে ভেসে যাবার আগে ভাবতে পরিতৃপ্ত পাব। জননী-বঙ্গভূমি। আমি তোমার কন্যা-জায়া-জননী।
২৭.১২.১৯৮৯
গতকাল দৈনিক জনকণ্ঠে আমার একটি ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছে। শিরোনাম: একজন মানবাধিকার কর্মীর গল্প। সব প্রশ্নই গতানুগতিক। এসব কথা বিগত দু’মাসে প্রেস মিডিয়াতে বহুবার বলেছি। প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক আনোয়ার কবির ঘুরেফিরে একজন উনিশের তরুণীর কাছে জানতে চায়, তার স্বর্ণালি সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা পাখি একা না যুগলবন্দি।
আমি উত্তর দিয়েছি, ‘মানুষ একাধিক জীবন নির্মাণ করতে পারে না। তাহলে আমার জন্ম হতো না।’
আনোয়ার কবির: ‘আপনি প্রিয়দর্শিনী। লাস্যময়ী। সহস্র তরুণ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’
‘আমি জানি না। আমি কিছুই জানি না। আমি উর্মিলা। শুভপুর থেকে নগরে এসেছি। বেবী আপা, শহীদ জননী, মাদার তেরেসার মানবিক আত্মা ধারণ করি।
ওইখানে প্রেমাঞ্জন থাকবেই। যার জন্য থাকবে তার নাম হোমোসিপিয়েন।’
আনোয়ার কবির: ‘সেই হোমোসিপিয়ন কে বা কাহারা?’
‘আমি জানি না। মানুষ তো বটেই। প্রেমান্ধ মানুষ।’
এর পরপরই দীপু ভাই টেলিফোন করেন।
‘দেবী রজকিনী, চ-িদাস বারো বছর শুকনো পুকুরে বড়শি ধরে বসে ছিল। আমার এত ধৈর্য নেই। আমি দেবতা হতে চাই না। কাতর হোমোসিপিয়েন হতে আপত্তি নেই।’
তারপর থেকে ভালো ঘুম হয় না। (চলবে)