ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : পর্ব ০৭









ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন

[গত সংখ্যার পর]
দুপুরে উৎসবকে কল দিলাম।
কিরে কেমন আছিস?
হুম। আছি, যেমন থাকি। তোর বনবাসের কি হাল-হকিকত তাই বল।
বলার মতো অনেক কথা আছে। তবে তোকে বলতে ইচ্ছে করছে না। কারণ তোর উপর আমি ক্ষেপে আছি।
হুম। তা জানি। ক্ষেপে থাক, দোষ নেই। তার আগে আমার কথা শোন, নেপাল যাবার প্রস্তুতি চলছিল। হঠাৎ বাচ্চারা জ্বরে আক্রান্ত হলো।
এখন কি অবস্থা?
কিছুটা ভাল আছে। ওরা সুস্থ হলেই, তোর ঐ বুনো বাড়িতে যাব। তারপর তুইসহ সোজা কাঠমান্ডু।
আমার পাসপোর্ট ভিসা লাগবেনা বুঝি?
ওসব নিয়ে ভাবিস কেন? তোর পাসপোর্ট তো আমার কাছে। আঙ্কেলের কাছ থেকে নিয়ে এলাম।
এত এক্সপার্ট তুই। হার মানতে হয়।
হা হা হা। তুই প্রস্তুতি নিয়ে রাখিস কিন্তু।
শোন, একটা গুড নিউজ আছে। চেয়েছিলাম তুই এখানে এলে তোকে সারপ্রাইজ দেবো।
সারপ্রাইজের কথা বলে আমাকে কনফিউজড করে দিস না। যা বলার বলে ফেল।
নীলা ফিরে এসেছে।
কী বলছিস?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি। অবাক হচ্ছিস? আরো অবাক হবি ওকে দেখলে। ও আগের মতোই আছে। আমাকে ভীষণ ভালবাসে।
সোম, তোর মাথা খারাপ হয়েছে? এসব কি বলছিস?
দুর, গাধা! আমার মাথা খারাপ হবে কেন? এই শোন, তুই কবে আসবি আমাকে জানাস।
কল কেটে দিলাম। মুঠোফোনে গান শুনতে লাগলাম। তন্দ্রাচ্ছন্ন সময় ধীরে ধীরে বয়ে চলছে। আমি এখন ভাবছি অযুতের কথা। উৎসব অযুতকে দেখলে নিঃসন্দেহে অবাক হবে। ভয়ও পেতে পারে।
আজকের দিনটার নাম দিলাম জড়তার গ্রাস! কারণ সারাদিনই বিছানায় ছিলাম। বয়সের ভারে হালকা ব্যথা জড়ো হয়েছে মেরুদ-ের আশপাশে।

পূর্বকথা মতো বিকেলে অযুত এল। অতি চালাকির স্বাক্ষর রেখে সে আমার সাথে গল্পে মশগুল হলো।
জানাল, ও একাত্তর সালের ডায়েরি পড়ে এখনো শেষ করতে পারেনি। গতরাতে বলেছিলাম, আজ যত আগে সম্ভব চলে আসবে। তাই সে বিকেলে এসে হাজির। আজকাল ওর মধ্যে অস্থিরতা ভাব নেই। আমাকে প্রভুর মতো শ্রদ্ধা ও মান্য করে। স্বেচ্ছায় কিছু কাজেও হাত দেয়। ভাল চা বানাতে পারে।
অযুত।
মিঃ সোম। বলো।
তুমি তো একা একা পড়ে যাচ্ছো। আমাকে পড়ে শোনাবে?
হ্যাঁ, কেন নয়? তুমি ইচ্ছুক হলে নিশ্চয় পড়ে শোনাব।
হ্যাঁ, ঠিক আছে। তাই করো।
অযুত পড়তে শুরু করল।
“অসীম আশঙ্কা দিকে দিকে! এসব জীবন মৃত্যুর দ্বার ঘেঁষে ছুটে চলেছে অসীম বেগে! কোনো বিপত্তী ওদের ছন্দে পতন ঘটাতে পারবে না। ওরা অজ¯্র প্রতিকূলতার মধ্যেও অনায়াসে রক্ষা পাবে।
দীক্ষা! মহাদীক্ষা! কিছু শব্দের ঘ্রাণ ওদের করোটিতে গেঁথে আছে। এ এক নতুন সমীকরণের উদ্ভব! পৃথিবীর চিরায়ত রাশিমালার মধ্যে যোগ হতে যাচ্ছে একটি নতুন রাশি! এর জীবন-মৃত্যু সংকুল পথ চলা বড্ড বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে মহাকালের পটভূমিতে! তবু হেরে না যাবার প্রত্যয়! একটি বিজয় জন্ম দেবে একটি নতুন রাশির!”
এতটুকু পড়ে অযুত একটি নিশ্বাস নিলো।
কি থেমে গেলে কেন?
মিঃ সোম এ ডায়েরিটা একেবারে ভিন্নধর্মী! কোথাও কোনো সমীকরণ খুঁজে পাইনি। পুরো ডায়েরি দুর্বোধ্য থিওরিতে ভরপুর।
তার মানে তুমি কিছু বুঝোনি।
হ্যাঁ, তাই।
আমি কিন্তু বুঝতে পেরেছি। তুমি চাইলেই আমার কাছ থেকে বুঝে নিতে পারো।
আমার কথা শুনে অযুত খুশি হলো। সে বলল, তাহলে তো বেশ হয়। এই মাত্র যা পড়লাম, তাই বুঝিয়ে বলো।
না, তা সম্ভব নয়। তুমি বরং প্রথম থেকে পড়ে শোনাও। তাহলে বোঝাতে সুবিধা হবে।
বাধ্য রোবটের মতো অযুত মাথা নাড়ল। পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে অযুত প্রথমদিকে গিয়ে থামল। তারপর পড়া শুরু করল।
“এই ¯্রােত মহাকালের সংখ্যাগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। মশাল ও বাহু। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ! স্পষ্ট হয়ে ওঠা সভ্যতার কপালে আঁকা চিহ্ন! একপাশে কয়লার দাগে অঙ্কিত কতিপয় কলঙ্ক চলক। অন্যপাশে ধ্রুবকের সমাবেশ। এ চলকগুলোর পতনে উন্মুখ এ ধ্রুবক সংখ্যার ¯্রােত! এ ¯্রােত থামাতে পারে, এমন সাধ্য কার? বিচ্যুতি এখানে ব্যর্থ!
হা হা হা...”
কি ব্যাপার অযুত, থেমে গেলে কেন?
এখানে সাংকেতিক চিহ্নগুলো একেবারেই অপরিচিত। ডায়েরিটা আমি হাতে তুলে নিলাম। দেখতে লাগলাম সাংকেতিক চিহ্নগুলো! দাদাজানের নিজস্ব ভাষায় লেখা কিছু কথা।
অযুতকে ডায়েরিটা ফেরত দিয়ে বললাম।
নাও পরবর্তী অংশ থেকে পড়ো।
পৃষ্ঠা পরিবর্তন শেষে অযুতের ঠোঁট নড়ে ওঠল।
“ধ্রুব সমাবেশ! এ এক মহান পৃষ্ঠার উন্মোচন! তর্জনী ও স্লোগান সংখ্যার যোগফল এক মহাসূচকের ঊর্ধ্বমুখী পাঠোদ্যান! পশ্চাতে কুৎসিত চলকের কুচক্র। ভিন্ন পথে মহাসমারোহ! মহাসমীকরণের উৎসব! কুচক্রের পতন আসন্ন!
দুষ্টের ত্রিভূজ আজ মহাসংকটের সম্মূখে। বাহুত্রয় বন্ধন ভেঙে নিঃস্ব, অচিরেই জ্বলতে শুরু করবে। ভস্ম না হওয়া অবধি জ্বলতে থাকবে।
দিকে দিকে নিপীড়িত সরল রেখাসমূহ ভেদ করেছে পরস্পরকে, গড়ে তুলেছে এক মহাবন্ধন। এ এক মহাস্পর্শক!”
অযুত বলে ওঠল, মিঃ সোম, তুমি কি কিছু বুঝতে পেরেছ?
হুম। এটা দুঃসময়ের বিবৃতি। তোমাকে আমি বুঝিয়ে বলব। তারপরের অংশ পড়ে যাও।
পরের পৃষ্ঠাগুলোতে এলোমেলো আঁকিবুঁকি!
যেখানে লেখা আছে সেখান থেকে পড়ো।
অযুত একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগল।







“কাল রাত্রি! বুলেটের ধ্বনি ও মানুষের আর্তচিৎকারে ভেঙে যাচ্ছে, দু’যুগ আগেকার অসমান সমীকরণ। আজ পদতলে দলিত, জিন্নার ধর্মতত্ত্ব! ভাঙা ভারত বর্ষের এ এক নতুন বিপর্যয়! দিগি¦দিক হাতড়ে খুঁজে পাওয়া যায় কেবল একটি শব্দ, সংগ্রাম!”
কিছু সময় থেমে পাতা উল্টিয়ে আবার পড়া শুরু করল অযুত।
“বৈশাখ আসন্ন! চৈত্রের ধূলি-ঝড়ে জন্ম নেয়া অমৃত পিপাসা। আজ স্বপ্নপূরণের প্রথম সিঁড়িতে। ওপার বাংলা থেকে ইথারে ভেসে আসা মহানাবিকের কণ্ঠস্বর! সালাম স্বাগত, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার! শ্রদ্ধাঞ্জলি ভারতভূমি!”
দু’পাতা উল্টে অযুত আবার পড়ছে,“পলাশীর প্রান্তর! আম্রকানন! সাদর সম্ভাষণ মহাজাগ্রত বীর! নির্ভুল গণিতবিদ মহান রাষ্ট্রনায়ক! কে রুখে এ শপথ ধ্বনি? ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে এক মহাপিপাসা, এক মহাসংগ্রাম।
আজ চিরতরে ভেঙে গেল, ভাঙা ভারতবর্ষের ভুল সমীকরণ! স্বাগত নবীন রাশি বাংলাদেশ! পৃথিবীর চিরায়ত ¯্রােতে এক নতুন সংযোজন!”
মিঃ সোম, আমার ধারণা, রিয়ন সাহেবের এ অসংলগ্ন থিওরি গণিতের ক্ষেত্রে কোনো কাজে দেবে না। মনে হচ্ছে, তিনি এ লেখাগুলো অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে লিখেছেন। আমার উচিত এ ডায়েরিটি অগ্রাহ্য করা।
অযুত, তুমি একাত্তরের প্রেক্ষাপট জানো না। তাই এভাবে বলছ। তোমাকে একটি বই দিচ্ছি ওটা পড়বে। তাহলে এ থিওরিগুলো তোমার কাছে ক্লিয়ার হবে।
আমার ব্রিফকেসে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস সম্বলিত একটি বই ছিল। বইটি বেশ বড়! সেই বইটি অযুতকে দিলাম। বই পড়ে শেষ করতে তার বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। আর এ সময়টা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ!
সন্ধ্যায় অযুত চলে যাবার পর, খানিকটা অলস ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। মিজান মিয়া এসে নক করল। চা নাস্তা দিয়ে গেল। চা পানের পর শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। একাত্তর সালের ডায়েরিটার পাতা উল্টে দেখতে লাগলাম। ভেতরের দিকের একটি পৃষ্ঠা পড়তে লাগলাম।
“এ দ্বীপে আমরা সাতাশজন। খাদ্য সংকট আসন্ন। তবু আমাদের দুশ্চিন্তা নেই। মৃত্যুর ভয়টুকু যখন নিঃশেষ হয়ে গেল, তখন কী আর থাকে? বেঁচে থাকার বিকল্প কোনো উপায় নেই। হয় স্বাধীন বাংলাদেশ নয় মৃত্যুদেশ।
যেখানে মেঘাদ্রি আছে, সেখানে যেতে আমার কোনো অনিচ্ছা নেই। দেশের জন্য মৃত্যুদেশে যাওয়ার চেয়ে সুখকর আর কিছু নেই। অন্যদিকে তারচেয়ে সুখকর মেঘাদ্রিকে পাওয়া।
গতমাসে আমাদের পাঁচটি অভিযানই সফল হয়েছে। মোট নয় জন মৃত্যুবরণ করল। আসলামের মুখটা এখনো দেখতে পাই। ও মৃত্যুর আগে পানি চেয়েছিল, দিতে পারিনি। তার আগেই মরণ ঘুমে ঢলে পড়েছে।
সুন্দরবনের ওপাশে লোকালয় আছে। আমরা সেদিকেই যাব। ক্ষুধা-তেষ্টার কাছে পরাজিত হবো না। মানুষের ভালবাসা আমাদের জন্য মহান আশির্বাদ।”
মিজান মিয়া, আবার এল।
কি ব্যাপার, কিছু বলবে?
জ্বি স্যার। বাপজান আপনারে যে ডায়েরিখানা দিলো। সেইটাতে কী লেখা আছে, বড় জানতে ইচ্ছা করছিল।
সে নোটবুকটা এখনো পড়া হয়নি মিজান।
স্যার, একটা সত্য কথা বলমু, রাগ করবেন না’তো।
বলো। রাগ করব না।
স্যার, আমারে মাফ করবেন। এই ডাইরিডার উপরে আমার খুব লোভ আছিলো। মনে করতাম, এইটাতে কোনো গুপ্তধনের নকশা বা হদিস আছে। কতবার চান্স খুঁজলাম, জিনিসটা চুরি করার লাইগ্যা। পারলাম না, বাপজান আমার ফন্দি টের পাইয়্যা, জিনিসটা বালিশের ভিতরে সেলাই কইরা লুকায়া রাখল। আর পাইলাম না।
আসলে মিজান, এটাতে কোনো গুপ্তধনের সন্ধান নেই বা কোনো নকশাও নেই। এখানে দাদাজানের কিছু সাংকেতিক কথা রয়েছে। ডায়েরিটা পুরোপুরি পড়া শেষে তোমাকে জানাব।
জ্বি, স্যার। মিজান মিয়া হাসল।
তুমি এখন বাড়ি যেতে পারো।
যাই তবে স্যার। আপনার খাবার মিটসেফে রাখা আছে।

মিজান চলে গেল। নীলাকে খুব মিস করছি। কদিন ধরে ওর দেখা নেই। ওর গণিতপ্রীতি আমার কাছে একেবারে খারাপ ঠেকেনি। তবু এ গাণিতিক অভেদগুলোর প্রতি একটা হিংসুটে ¯্রােত আমার মস্তিষ্কে বার বার বয়ে যেত। এ সমীকরণগুলোই যেন নীলাকে আমার কাছে থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। নিচে নেমে গেলাম। অন্ধকারে তাকিয়ে আছি। কালো ঘাসগুলোর বুকে খুঁজে বেড়াচ্ছি শশীর মতো সর্প শিশুটিকে। নেই, কেউ নেই সেখানে।
রাতের খাবার শেষে ঐ ছোট্ট ডায়েরিটি নিয়ে বসলাম। ইচ্ছে ছিল নীলাকে সাথে নিয়ে ডায়েরিটি পড়ব। তা হলো না। ইচ্ছে করছে নীলাকে কল করি। ফোনটা কাছে নেই উপরতলায় রেখে এসেছি। ভাবনার ভাঁজ একপাশে রেখে, ডায়েরি পড়ায় মন দিলাম।
ছোটো ছোটো অক্ষরে লেখা দীর্ঘ বর্ণনা। সে বর্ণনায় একটি ছদ্মবেশী ভাষাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে ভীষণ ঘোলাটে ঠেকল। মূল বিষয়টা একটা ভাষা কেন্দ্রিক, তা বুঝতে পেরেছি বটে। তবু কোথায় যেন গ্যাপ রয়ে গেছে। অদ্ভুত এসব চিহ্নের অর্থ উদ্ধার আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। বাঁকা চোখ, তীর, ধনুক, ক্রুশ, চামচ, পাখি, সাপ, কাঠঠোকরা, বক, ত্রিশুল, লাঙল, ডিঙি, নৌকা, মাছ, তুলাদ-, স্কেল প্রভৃতি চিহ্ন এক জটিল ধাঁধার সৃষ্টি করল। এ ধাঁধা পেরুবার শক্তি সাধ্য কোনোটাই আমার নেই।
ব্যর্থ মনোরথ চেপে খাটের পাটাতনের বক্সে পাওয়া ডায়েরিটি বের করলাম। এ ডায়েরির কভারে লেখা “ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা”। এ ডায়েরিটির ভেতরেও ঐ অদ্ভুত ভাষার ছড়াছড়ি। তবে প্রথম পৃষ্ঠার লেখা বাংলা। সেখানে তিনি লিখেছেন,“আজ লীলাবতীকে খুব মনে পড়ছে। আমার মেঘাদ্রি আর লীলাবতী যেন একে অন্যের পরিপূরক। কে জানত এই জ্যোতিষী গণিতবিদ বিদূষি রমণী লীলা একদিন ভারত ভূমিতে খনা নামে পরিচিত হবে। কে জানত জ্ঞান প্রকাশের অপরাধে হারাতে হবে ধ্বনি উৎসের পবিত্র অঙ্গ জিহ্বা। ওর নিরব ক্রন্দন ধ্বনি আমি প্রায়ই শুনতে পাই। ওর অপ্রকাশিত কান্নাই যেন বার বার ধ্বনিত হয় মেঘাদ্রির কণ্ঠে!
লীলাবতী! এক মহা ইতিহাসের নাম। ওর নাম মহান জ্ঞানগুরু আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, মহাবীর আচার্য, শ্রীধরাচার্য, ভাস্করাচার্যের চেয়ে কোনো অংশে কম দামি নয়।
রক্তাক্ত বদন! কান্না হাহাকার লীলার নামকে করেছে স্বর্ণ রঙে উজ্জ্বল!
ভাল আছে ভাল থাকবে চিরদিন লীলা মেঘাদ্রির নাম।”
আমার ভেতর থেকে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে এল। ডায়েরিটি ছুঁড়ে বিছানায় রাখতে চাইলাম। অতিবেগ সামলে ওঠা সম্ভব হয়নি। ডায়েরিটি বিছানা গড়িয়ে খাটের ওপাশে পড়ে গেল। দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলাম। নির্জন আশপাশ। আজ অমাবস্যা!
এই মুহূর্তে যদি নীলা আসত। তাহলে ওকে লীলাবতী খনার কথা বলতাম। দাদাজান মেঘাদ্রির মতো লীলাকেও ভালবাসত। প্রাচীন কালের কোনো এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে লীলা, আর একবিংশ শতাব্দীর আরম্ভ লগ্নে শেষ নিশ্বাস ফেলে কালের ক্যালেন্ডারে স্থির হয়ে আছেন রিয়ন সাহেব। এই দুজনের সম্মিলিত ভালবাসাও যে একটি গাণিতিক সমীকরণ। এ তত্ত্বকে সংখ্যা রাশি ও গাণিতিক চিহ্ন দিয়ে কে প্রকাশ করবে?
বুনো ঘাসের উপর পা ফেলে হাঁটছি। অদূরে কোথাও হাস্নাহেনা ফুটেছে নিশ্চয়ই। প্রাণ মাতাল করা ঘ্রাণ বার বার নাসিকা ছিদ্রে আঘাত করছে। হঠাৎ টিনের গেইট নিঃশব্দে নড়ে ওঠল। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি। আমার সামনে অন্ধকার ভেদ করে নীলা এসে থামল। অস্পষ্ট মুখখানি!
সোম।
নীলা, তুমি এত রাতে কোথা থেকে এলে? এখন রাত পৌঁনে বারোটা বাজে।
অবাক হচ্ছ কেন? দিন-রাত আমার কাছে সমান। চল, ভেতরে যাই।
নীলা নিচতলার ঘরে প্রবেশ করল। ঘরের আলোয় ওর মুখ স্পষ্ট হয়ে ওঠল। বিছানার উপর থেকে সে ছোট্ট নোটবুকটি তুলে নিলো। এক মুহূর্তে মনে হলো নীলা আর লীলা কত কাছাকাছি। ওরা দু’জনই গণিতের প্রেমে বিভোর! রহস্য রমণী! নীলাও কি একদিন লীলার মতো নিঃশব্দে কাঁদবে? কার এমন সাহস ওর জিহ্বা কাটতে পারে? না, সে দৃশ্য আমি সইতে পারব না।
নীলা, আমি তোমাকে ভালবাসি।
নীলা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। ও আমার চোখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করছে। আমার কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কি হলো, সোম? তুমি এত অস্থির কেন?
আমি নিরুত্তর। আমার চিবুক ছুঁয়ে নীলা বলে ওঠল, সোম তুমি ক্লান্ত!
নীলাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
নীলা তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়।
নীলা হেসে বলল, সোম, আমি তো তোমারই। এতদূর ছুটে এসেছি কেবল তোমার জন্য।
আমি তোমাকে ভালবাসতে চাই নীলা।
আমিও সোম, অনেক ভালবাসি তোমায়।
নীলার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে দীর্ঘক্ষণ ডুবে রইলাম। ওর চোখ দুটো তখন মৃত মাছের মতো ঘোলাটে লাগছিল। আমি বার বার ভালবাসার পিপাসা নিয়ে ওকে ঝাপটে ধরছি। অথচ ওর দিক থেকে সামান্যতম সাড়া নেই। নীলা পাথুরে মূর্তির মতো স্থির! ও কি ঐ রাতের আচরণ আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে? অপমানের প্রতিশোধ নিচ্ছে? আমি থমকে গেলাম। না, এটা তো ছলনা!
নীলা মৃদু আঘাতে আমাকে সরিয়ে দিলো। আমিও পথহারা পথিকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। কতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। নীলা বিছানায় গিয়ে বসল। ছোট্ট ডায়েরিটা হাতে তুলে নিলো।
নীলা, এ নোটবুকটার কথাই সেদিন তোমাকে বলতে চাচ্ছিলাম। দেখো, কি অদ্ভুত ভাষা! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
নীলা পাতাগুলো উল্টে পাল্টে দেখছে। ওর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি।
সোম, এ সাংকেতিক চিহ্নগুলো কি হায়ারোগ্লিফিক?
মানে?
প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিকের মতো লাগছে? কপ্টিক ভাষাও হতে পারে।
আমি হাসলাম।
দাদাজান, প্রাচীন মিশরের পুরোহিত ছিলেন না। তিনি বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত মানুষ।
সে যাই হোক। ভাষাচিত্র তাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। ভাষার প্রাচীন লেখাগুলো খুব দুর্বোধ্য!
নীলা, কপ্টিক ভাষা সেটা আবার কী?
কপ্টিক ভাষা মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিকের পরিবর্তিত রূপ। ভাষার দিক থেকে আসলে তোমাদের পৃথিবীটা বড় জটিল!
হাসালে। হঠাৎ পৃথিবীটা আমাদের হয়ে গেল? তুমি ভিন্ন কোথাকার কেউ নাকি?
সরি। আমাদের পৃথিবী! ভুলে বললাম।
যাক। এখন এ ডায়েরিটা পড়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করো। ভেতরের দিকে বাংলা লেখাও রয়েছে।
নীলা ডায়েরি পড়ায় মন দিলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে যাচ্ছে। আর আমি ওকে দেখছি। মাথার ডানপাশে কয়েকটা চুল ফ্যানের বাতাসে অনবরত দুলছে।
[চলবে...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট