দখল
আনোয়ার রশীদ সাগর
অন্ধকারে একা হাটে ননীপাল। সে বুঝতে পারে না, কোথায় যাবে কী করবে? ধীরে ধীরে যেন নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে সে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে ওঠে। উঁকি দেয় উঠানে, আগুন ছুড়ে মারে দিকবিদিক। চোখের সামনে দড়দড় করে পানি পড়ার মত আগুন পড়ে। জীন-পরীর আঁচড় বলে অনেকে। ছেলেকে হারিয়ে নুরীর মারও এ রকম হয়। মুক্তিযোদ্ধা নুরীর মা দাড়কি মাছের ঝাক দেখতে পায়। অস্ত্র হাতে তার ছেলের সাথে একদল দামাল ছেলে জয়বাংলা বলে শ্লোগান দেয়। বলাইপাল দেখতে পায়, লাল-সবুজে আঁকা পতাকা পত্পত্ করে উড়ছে আর দাও দাও করে পুড়ছে। হাজার হলেও বাপ-দাদার ভিটে, ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। ফুরফুরে মেজাজে কাটাতে চায় বা্কি জীবনটা। চোখ বুঝলেই, ভুল দেখে, আঁধার ঘুমিয়ে থাকে জ্যোৎস্না জেগে হাসে। হঠাৎ ঝাঝালো গলায় ঝিঁঝিঁরা চেঁচিয়ে ওঠে, পালাও-পালাও।
চাঁদ যখন পশ্চিম আকাশে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়, তখন আঁধারও শেয়াল গর্জনে ডেকে ওঠে। রাত এভাবে নড়ে বেড়ায়, তা তো কখনো ভাবেনি বলাইপাল। আকাশ যে ধড়াশ-ধড়াশ শব্দ করে গোরস্থানের দিকে হেলে পড়ে, তা তো কখনো দেখেনি নুরীর মা। জোনাকিরা দল বেঁধে গাছ থেকে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে, দেখে গ্যাংড়িয়ে ওঠে ননীপাল।
অন্ধকারে ঘুমের মধ্যে, মুখচাপায় ধরা মানুষের মত শব্দ করে চেঁচায় বলাইপাল। জেগে ওঠে, বাঁচার আকুতি বেড়ে যায়। মনে মনে বলাইপাল ভাবে, তাকে মারা হবে না, শহরের রেজিস্ট্রি অফিসে যেতে হবে, তার শত্রু অন্য কেউ না। তার শত্রু বাপ-দাদার রেখে যাওয়া জমি। রাতের কুকুরগুলো ঘেউঘেউ ডেকে যাচ্ছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকে। মাথায় প্রতিবেশিরা পানি ঢালার চেষ্টা করে। বলাইপাল জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ইশারায় জানিয়ে দিল, তার মাথায় পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কাছের কয়জন মানুষকে বলল, আমাকে তোমরা ইন্ডিয়ায় রাইখি আসতি পারবা?
এ কথা বলার সাথে সাথে বাইরে থেকে অদৃশ্য শব্দ ভেসে আসতে লাগল, ভুত বা পেঁতনির গলায় ‘এ্যাঁ-এ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ’ শব্দ করে জানিয়ে দিল, যাবি কী কইরি?- তোর তাজা রক্ত খাবো, তোর আসল শত্রু বাইরে আছে।
উপস্থিত সবাই ভয়ে জড়-ষড় হয়ে যায়। বলাইপাল বুঝতে পারে। থেমে যায় সে। চুপ করে থেকে, চোখ মেলে তাকায়। তারপর শান্ত গলায় বলে, তোমরা আমাকে বাঁচাতে পারবা নানে, আমার কতা রাকো। উপস্থিত সবাই নীরবে বলাইপালের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। লেখাপড়া জানালোক বলাইপাল, তার প্রতি কারো কারো বেশ আনুগত্যও আছে।
এবার বলাইপাল নিজেই বিছানা থেকে ওঠে খাড়া হয়ে ওঠে বসে এবং বলে, তোমরা বিশ্বেসদাকে ডাইকি আনো। অনেকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। বলাইপাল নির্ভয়ে বলে, সে ছাড়া এই রাইতে আমাক কেউ বাঁচাইত্ পাইরবি নানে। বলেই দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে হুঁহুঁহুঁ শব্দ করে কেঁদে ফেলল। তখনই পাশের মসজিদ থেকে মূয়াজ্জ্বীনের কণ্ঠে ‘আল্লাহ আকবর......আসসালাতু ’ আযানের ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল।
স্বাধীন দেশে বাঙালী হয়ে বাঁচার শখ উবে যায় বলাইপালের। চারদিকে অস্ত্রের ঝনঝনানি। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে, বিভিন্ন উপায়ে সমাজতন্ত্র কায়েমের শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে।
হিন্দু-মুসলিম মেয়েদের মধ্যে সম্প্রীতি রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক আচার বা অনুষ্ঠান গুলো এক সাথেই করে। বলাইপালের এহেন অবস্থায় সকলের মধ্যে বেশখানিক সহমর্মিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গ্রামময় এক ধরনের হৈচৈ-ও হচ্ছে, বলাইপালকে রাতে মুখচাপায় ধরেছিল, ব্যাচারী এ যাত্রায় বাঁইচি গিছে। ভুঁত-পেঁতনিতে ধরলি আর বাঁইচতু না। এতক্ষণে আতাগাছের নিচে ক্যাচ-ম্যাচা পাখিরা ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। ঝাকে ঝাকে ক্যাচ-ম্যাচ ক্যাচ-ম্যাচ শব্দ করছে আর জোড়া পা একসাথে তুলে নেচে নেচে উঠছে।
বলাইপাল উদাস মনে রাস্তায় হাটে, নদীর ধার দিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলে চলে। সাদা লুঙ্গি পরণে আর খদ্দরে চাদরে শরীর ঢেকে রাখে। চাদরটি গরমকালে কান্দের উপর ভাঁজ করে রাখে। তার চলার মধ্যে এক ধরনের আভিজাত্য রয়েছে।
সে হাটতে হাটতে শুধু লাশ দেখতে পায়।৭১-এ দেখেছিল শুধু ছয়টা লাশ। নদীর ¯্রােত কম থাকায় লাশগুলো ভাসতে ভাসতে একদেড় কিলোমিটার গিয়েছিল। কয়েকটি লাশের মাথা নদীর ধারে পড়েছিল, শিয়ালে মাথাগুলো নিয়ে টানাটানি করছিল। হাইস্কুলের মৌলভী স্যার লাশগুলো ও এদিকওদিক পড়ে থাকা হাড়হাড্ডি গুছিয়ে নদীর পশ্চিম ধারের গোরস্থানে পুঁতে রেখেছিল। বলাইপাল লাশ দেখছিল আর একাত্তরের কথা ভাবছিল। এখন লাশ পড়ে থাকে, রাস্তা-ঘাটে। গুলি করা লাশ, জবাই করা লাশ, গলায় ফাঁস দেওয়া লাশ। লাশ আর লাশ।
রাতে শুয়ে ঘুম হয় না। মনে মনে ভাবে, সেদিন যারা তাকে মুখ-চোখ বেঁধে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, তারা হয়তো আবার আসবে। বলাইপাল এই এলাকার বুদ্ধিমান মানুষ। মনে মনে ভাবে যারা মুখ-চোখ চেপে ধরেছিল, তাদের সবাইকে চেনে সে। তবে তাদের নাম বলতে পারবে না, বললে লাশ হতে হবে। তারচেয়ে পৈত্রিক সম্মত্তিগুলো বিশ্বেসকে রেজিস্ট্টি করে দেওয়ায় ভাল।
যে চিন্তা, সেই কাজ। একদিন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আট-দশ কিলোমিটার পথ এসে, থানা শহরের রেজিস্ট্রি অফিসে বসে, সব সম্পত্তিগুলোর দলিল বিশ্বেসের হাতে হস্তান্তর করেছে।
তারপরও বলাইপাল এলাকা থেকে হারিয়ে যায়। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না তাকে।
রাতে তার বাপ-দাদার ভিটেতে ল্যাম্প জ¦লতে দেখা যায়। এর কিছুদিন পর বিশ্বেসের লোকজন এসে বলাইপালের ভিটে-মাটি দখল করে নেয়। একদিন, দু’দিন বা তিনদিন যেতে যেতেই জানা যায়, বলাইপালের জমিগুলো রেজিস্ট্রি করে নিয়ে, তাকে বাধ্য করা হয়েছে মেহেরপুরের দিকে চলে যেতে। কিন্তু বলাইপাল দেশের মায়া ছাড়তে পারেনি। গোপনে ফিরে এসে, প্রিয়জনদের সাথে দেখা করে, রাজবাড়ী বোনের বাড়ি আশ্রয় নিবে বলে জানিয়ে যায়।
পর্যায়ক্রমে বিষয়টি আলোচনা হতে হতে এক সময় বিশ্বেসের লোকজনও জেনে যায়, বলাইপাল দেশেই আছে, ইন্ডিয়ায় যায়নি। শুরু হয় তাদের নজরদারী। অপর দ্কি, লোকজন ও আত্মীয়-স্বজন ডেকে ঢোল-ডগর বাজিয়ে, দপের মাঠের বড়দাগের জমিটা দখল করে আট-দশটা লাঙ্গল দিয়ে চষা শুরু করে দেয়। সেইসাথে বাড়ি বড় বড় খাসি জবাই করে খাওয়ায়ে দেয় তাদের। চারদিকে মারহাবা-মারহাবা আওয়াজ শুরু হয়ে যায়, জমি দখল করে ‘বাঁশগাড়ি’ করে ফেলে।
বিশ্বেসও বুঝতে পারে, পরিবেশ তার অন্কুুলে রয়েছে। সুতরাং ননীপালের জমি দখল সহজই হবে। তাছাড়া ইতমধ্যে ননীপাল রাতে ভুঁত-পেঁতনি দেখতে শুরু করেছে। রাতে জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না-কাটিও করে। এখন ননীপাল মরে বাড়ি পড়ে থাকলেও, কেউ সন্দেহ করবে না। তবে তার জমিগুলো রেজিস্ট্রি তো করতে হবে?
নূরী। বীর মুক্তিযোদ্ধা। অনুপ্রাণিত হয়েছিল, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে। মাঠে-ঘাটে যুদ্ধ চলছে। লাশের পর লাশ পড়ছে। সরকারীদল, কমিউনিস্টপার্টি আর গণবাহিনীর মধ্যে এ যুদ্ধ চলতেই আছে। সকলের হাতেই অস্ত্র। শতশত মায়ের বুক খালি হয়ে যাচ্ছে। ঝরে যাচ্ছে আকাশের পূর্ণিমা চাঁদগুলো।
ছেলে হারা, স্বামীহারা, সম্পদ হারানো মানুষের আর্তনাদ চতুর্দিকে।
নূরীও একদিন হারিয়ে গেল, লাশ হয়ে পড়ে থাকলো মাঠের মধ্যে। নূরীর মা অন্ধ হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘোরে, ননীপাল গ্রামছাড়া ভিখারিনী এবং বলাই পাল সব হারিয়েও দীপ্ত শফৎ নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। সে প্রতিজ্ঞা করে, সব গেলেও দেশ ছাড়বো না-মনে মনে বলে, এটি আমার বাপ-দাদার দেশ। একদিন না একদিন পরাজিত হবেই দখলদারীরা। অপেক্ষায় থাকে বলাইপাল।
আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা।