সেই মহামারী !




সেই মহামারী
আনোয়ার রশীদ সাগর

গাঁ এর মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। মেয়েরা একজন অপরজনকে ঠেলা দিচ্ছে, কানাঘুষা করছে। সামনে দু’টি গাধার পিঠে চড়ে দু’জন বেদে সরদার আসছে। দু’সরদারের পাশে বসে দু’জন সুন্দরী যুবতী, যুবতী মেয়ে দু’টির ঠোঁট পান চিবানো রসের লালপিকে ভরা, মুখে খিলখিলানি হাসি।
হেলে দুলে কুঁতে পেদে গাধা হাঁটছে। পিছনে পিছনে একদল বেদে হেঁটে আসছে। তাদের মাথায় সাপের ঝুড়ি, লতা-পাতার ঝুড়ি রয়েছে। হয়তো চিকিৎসা বা অপচিকিৎসার সরঞ্জাম রয়েছে। গাঁয়ের  যুবকেরাও বেশ মজা পাচ্ছে ওদের দেখে। রাস্তার ধারে সারি সারি বাড়িঘর। পূর্বদিকে বড় একটা ফাকা মাঠ। সেখানে গরুছাগল চরে। বিকেল হতে হতে মাঠটা বেদেরা দখল করে ফেলে, তাবু টাঙিয়ে থাকার ব্যবস্থাও করে। সন্ধ্যা হতে হতে গাঁয়ের যুবকেরা দল বেধে দেখতে যায় ওদের। ঠিক ওদের সকলকে নয়, যুবতীরাই ওদের বড় আকর্ষণ ।
মোদী দোকানী ও অন্যান্য ব্যবসায়ীরা বেদেদের আগমণে খুবই খুশি, খুশি ম-লরাও। গোপনে নিজেকে আড়াল করে মাতুব্বরী ভাব নিয়ে, বাড়ি ছেড়ে তারাও সেখানে ঘুরঘুর শুরু করেছে। বেদের মেয়েরাও কম বোঝে না। তারাও সমানতালে, মাজায় শাড়ি পেচিয়ে নলা-কলা শুরু করে, ও ভাইরে ভাই আইসো আমার ডেরায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে ম-ল মশায় গিয়ে সুন্দরী বেদেনির তাবুতে বসে গল্প ফাদে, আমার এলাকায় আমার কথামত সবাই চলে, সবাইর অনেক টাকা-পয়সা রয়েছে। আমারি চল্লিশটা গরু বিশটা ভেড়া এ মাঠে চরে। এ কথা শুনে বেদেনি তার শাড়ির আঁচল খুলে বাধে এবং পেটের পেটি নগ্ন করে রাখে। তাবুর ভিতর থেকে কিশোরী একটা মেয়ে পান সেজে এনে ম-লের হাতে দেয়। আর ওদিকে দূর থেকে ম-লের ছেলে হাত ইশারায় কিশোরীকে আহ্বান করে। কচিমুখে হেসে কিশোরী মেয়েটি ছোট নিতম্ব দোলাতে-দোলাতে বের হয়ে যায়।
সকাল হতে হতে একটু বয়সী মেয়েরা ঝুড়ি মাথায় বেরিয়ে পড়ে, যাবে আশে-পাশের গ্রামে বা পাড়ায় পাড়ায়। নতুন উৎসবে আনন্দের জোয়ার চারদিকে। কাজ ফেলে ছেলেমেয়ে-বুড়োবুড়ি ছোটে ওদের দেখার জন্য। ওরাও মাজায় শাড়ির আঁচল বেধে, মাথায় ঝুড়ি নিয়ে, নিতম্ব দোলাতে দোলাতে ঘোরে এগাঁয়ে-ওগাঁয়ে।

দুদিন-দুরাত পার হয়ে গেছে। পুবদিক থেকে বাতাস বয়ে যেতে থাকে পশ্চিমে। সন্ধ্যা হতেই হতেই মল-মূত্রের গন্ধে ভরে যায় গাঁয়ের বাড়িঘর। মুতের তীব্র গন্ধে অনেকেই বমি করে ফেলে। যতরাত হতে থাকে ততই বেদেমাঠের গন্ধ ভেসে আসতে থাকে। দু পাড়ার দু’ম-ল বেদেপাড়ায়ই রাত কাটিয়ে দেয়। সেই সাথে তরুণ ছেলেরাও।
মাঠের  আঁশটে গন্ধে ও মল-মূত্রের জীবানু ছড়িয়ে পড়ে সারা গাঁয়। কেউ স্থির থাকতে পারে না। এর মধ্যে আকাশে হড়াম-হড়াম শব্দ করে মেঘ ডাকা শুরু হয়। অনেকেই ভেবে নেয়, বৃষ্টি হলেই সব ধুয়ে যাবে। মেঘের গর্জনের পর বৃষ্টিও হয়ে যায়, বৃষ্টির পানিতে মাঠের গুঁ-মুতের আংশিক ধুয়ে ভেসে গিয়ে ডুবা-নদী-নালার পানির সাথে মিশে যায়।
সকালে হালকা ঠা-া ঠা-া অনুভব হয়। শুরু হয় কলেরা। মহামারী আকার ধারণ করে, শিশু বৃদ্ধ মারা যেতে থাকে, লাশের লাশ পড়ে থাকে। কে কাকে দেখবে? সকলেই বদনা হাতে দৌড়ায় নদীর ধারে। মেয়েরা তাদের লজ্জা ভুলে, সবাইর সামনেই পাছার কাপড় তুলে কলকল শব্দ করে মল ত্যাগ করে। একই অবস্থা হয় বেদে মাঠে। বেদে সরদারসহ কেউ কেউ মাঠ ছেড়ে পালায়। বাকি প্রায় সব বেদেই মারা যায়। মারা যায় গাঁয়ের অসংখ্য মানুষ। রেহাই পায় না গরু, ছাগল, ভেড়া ও পাখি। কেউ কেউ পালিয়ে, ভিনগাঁয়ে গিয়ে বাঁচে।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট