এই পতাকা আমার, আমার আত্মার!
মুহম্মদ মাসুদ
একটি শোক সংবাদ! একটি শোক সংবাদ! উত্তর পাড়ার...।
শেষরাত্রি। ফজরের আজানের খুব কাছাকাছি। মিনিট কয়েক দূরত্ব। হয়তো তারও একটু কাছাকাছি। সত্যি! এই সময়টায় মৃত্যুর সংবাদ কলিজা অবধি গেঁথে যায়। খুবই আফসোস হয় এই ভেবে কেউ একজন ফজরের নামাজ আদায় করতে পারলো না।
ঘুমের ঘোরে তখন হুঁশ বেহুঁশে অজ্ঞান অবচেতন হয়ে ঘুমিয়ে আছি। নানামুখী স্বপ্নের অংশগ্রহনে সংক্ষিপ্ত পদার্পণ এবং হেলে-দুলে জার্সি পরে মাঠে খেললেও আজানের মিষ্টি শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। মাকে ডাক দিয়ে বললাম, ‘মা, উঠেছ কি?
‘হ, উঠছি।’
‘আব্বায়?’
‘হ, তোর বাপ জানেও উঠছে।’
‘কিছু শুনেছ?’
‘হ, হেইজন্য তোর বাপ জানে তাড়াতাড়ি গেলো।
মসজিদের কাছাকাছি যেতেই কান্নার শব্দ কানে এসে ভিড় করলো। পরিচিত কন্ঠস্বর। এ কন্ঠস্বরের রিংটোনে পরিত্যক্ত কলিজার সবটুকুই শুকিয়ে গেলো নিমেষেই। আত্মাটা ছাঁইছুঁই ছাঁইছুঁই করতে লাগলো।
মমিন চাচা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। হাউমাউ করে কান্না! পিতৃশোকের কান্না। এ কান্না জীবন ঝড়ের কান্না। যে কান্নার অশ্রুবর্ষণে কোন ছলচাতুরী নেই। অহংকার নেই। আছে নির্ভেজাল ভালবাসা।
ইমাম সাহেব মমিন চাচাকে অনেক বোঝালেন। বললেন, ‘সবাইকেই যেতে হবে। আমরা আলাদা আলাদা এসেছি আর আলাদা ভাবেই খোদার কাছে চলে যাবো।’
পাখি পোষার শখ ছিলো দাদুর। খুবই শখ ছিলো। বিশেষ করে ময়না টিয়াপাখি। কেননা, পাখিদুটো মিষ্টি করে কথা বলতে পারে। যা শেখানো যায় তাই বলে। বিশেষ করে ময়না পাখি। সে রোজরোজ পাঁচ ওয়াক্ত নিয়ম করে বলে উঠতো আজান দিয়েছে, আজান দিয়েছে।
পাখির খাঁচায় কোন পাখি নেই। সেই আদুরে ময়না টিয়াপাখিও নেই। খাঁচাগুলো খাঁচার জায়গায় এখনো স্বাক্ষরিত দেখে মমিন চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচা পাখিগুলো কোথায়?’
মমিন চাচা বলল, ‘আব্বা বলেছিল, তিনি মরে গেলে যেন পাখিগুলো ছেড়ে দেই। যদি রাতে মরে যায় তবে যেন ফজরের নামাজের আগে ছেড়ে দেই।’
‘এরপরে কি পাখিগুলো চোখে পড়েছে?’
‘না। আর চোখে পড়েনি। তবে টিনের চালে খাবার দিয়ে রেখেছি।’
প্রাইমারী স্কুল মাঠে বিজয় দিবসের গান বাজছে। আজ বিজয় দিবস। ১৬ই ডিসেম্বর মনে করতেই কলিজার মধ্যে একটা অচেনা ধকল শরীরটাকে শিহরিত করলো। স্মরণ হলো দাদু যদি বেঁচে থাকতো এতোক্ষণে নিশ্চয়ই স্কুল মাঠে পৌঁছে যেত।
পতাকা পতপত করে উড়ছে। লাল সবুজের বিজয় পতাকা উড়ছে। কিন্তু কদমগাছ তলায় মুঞ্জিল দাদু বসে নেই। এইতো প্রতিদিনই, যখন লাল সবুজের পতাকা পতপত করে উড়তো। সেই শব্দটি দাদু কান পেতে শুনতো। দাদুকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘এ শব্দে কি পাও?
‘দাদু বলতো মুক্তিযুদ্ধের ডাক শুনতে পাই। মুক্তিযোদ্ধার পায়ের শব্দ পাই। বিজয়ের ধ্বনি শুনতে পাই। গোলাবারুদের আওয়াজ শুনতে পাই।’
কদমগাছটি আজ কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কত-শত কাহিনী, কত-শত ঘটনার সূত্রপাতের স্বাক্ষী সে। দাদুর মুখে শুনেছি এই কদমগাছ তলায় নসু মিয়াকেও গুলি করে হত্যা করেছে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। যে ছিলো সত্যিকারের সাহসী যোদ্ধা, বীরপুরুষ।
স্কুল মাঠে সবাই তখন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইছে। মনপ্রাণ উজাড় করে গাইছে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’
হঠাৎই একটি ময়নাপাখি এসে পতাকার বাঁশের খুঁটিতে বসে পাখা নাড়তে শুরু করলো। আর হঠাৎ করে জাতীয় সংগীত গাওয়া বন্ধ হয়ে যেতেই ময়নাপাখি গাইতে শুরু করলো, ‘চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস...।’