বিজয়ের বেদনা
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
তখনও পুব আকাশে সূর্য ওঠেনি, সকাল হতে আরও কিছু সময় বাকি। এদিকে প্রচন্ড প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে কিশোরী বঁধূ ছালেহা বেগম। বাড়ির বাহির বারান্দায় বসে অস্থির ভাবে হুক্কা টানছে ফজলু মিয়া। অল্প কিছু সময় পরেই করুণ সুরে ফজরের আযান দিচ্ছে মুয়াজ্জিন হুজুর। ফজলু হুক্কা রেখে পুকুরে গিয়ে ওযু করে মসজিদের দিকে পা বাড়ায়। যদিও সে সূরা কালাম কিছুই পারে না। মুয়াজ্জিন হুজুর তখন সুন্নত নামাজ পড়ে মসজিদের বারান্দায় বসে তসবীহ পড়ছেন। ফজলুকে মসজিদের উঠানে দেখেই মুয়াজ্জিন হুজুর ভূত দেখার মতো চমকে উঠে দাঁড়িয়ে যান। দশ বছর আগে তার বাবা মারা যাওয়ার দিন শেষ বারের মতো তাকে তিনি মসজিদে আসতে দেখে ছিলেন। হুজুর ভাবলেন আবার কোন অঘটন ঘটলো নাকি। তাই তিনি ফজলুকে প্রশ্ন করতেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। হুজুর তখন ধরেই নিলেন কেউ হয়তো মারা গেছে, তাই তিনি বিড়বিড় করে পড়তে থাকেন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন..। তখন ফজলু কান্নারত অবস্থায় বলে উঠে, এখনো কেউ মরে নাই কিন্তু মরণাপন্ন অবস্থা। আমার বউটা প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাইতাছে। দাই বেডি কইছে অবস্থা নাকি খুব খারাপ, প্রচুর রক্ত যাইতাছে। হুজুর তখন ফজলুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন এবং ধৈর্য্য ধরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বলেন। তারপর জামাতে ফজরের নামাজ আদায় করে হুজুর ফজলুর সাথে তার বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। যাওয়ার সময় পুরোটা পথ তিনি দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে গেলেন। বাড়ির উঠানে পা রাখতেই তারা নবজাতক বাচ্চার কান্না শুনতে পান। তখন দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠে ‘সুবহান আল্লাহ্’। প্রথম সন্তানের মুখ দেখতে অস্থির হয়ে উঠে ফজলু। তখন তার মা লতিফা বানু ঘর থেকে বের হয়ে বড় মুখ করে জানায় পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে ছালেহা। তখন রক্তিম সূর্য আভায় রাঙিয়ে আছে পুবের আকাশ। নিজের পুত্রের মুখ দেখতেও যেন ঠিক পুবের সূর্যের মতোই লাল বর্ণের। তাই সন্তানের নাম রাখে সে লাল মিয়া। মুয়াজ্জিন হুজুর ইতিমধ্যেই নবজাতক পুত্র সন্তান জন্মের জানান দিলেন বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে আযান দিয়ে।
ছালেহা সন্তানের মুখ দেখে সব কষ্টের কথা ভুলে যায়। সংসারে বংশের প্রদীপ পুত্র সন্তানের আগমনের খুশিতে কদিন মধ্যেই দুটো খাসি জবেহ দিয়ে আকিকা করে। আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে দাওয়াত করে ফজলু। যারাই তার শিশুপুত্র লাল মিয়ার মুখ দেখেছে, সবাই খুব প্রসংশা করেছে। নামও তার লাল, ছোট মুখখানি দেখতেও লাল। বেশ সুখেই কাটছে ফজলু ও ছালেহার সংসার। তবে এই সুখ বেশি দিন রইলো না। হঠাৎ করেই দেশে একটা গন্ডগোল লেগে যায়। চারদিকে অস্থিরতা বিরাজ করছে কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষ তখনও কিছু বুঝে পেরে ওঠেনি। তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর কমবেশি সবাই বুঝতে থাকে, এবার একটা কিছু হতে যাচ্ছে। তবে এসব নিয়ে ফজলুর খুব বেশি মাথা ব্যথা নেই। সে একজন কৃষক মানুষ, এসব বিষয়ে তার চিন্তা না করলেও চলবে। তবে চিন্তা না করতে চাইলেও কি চিন্তা না করে থাকতে পারে? দেশে তখন যুদ্ধ লেগে গেছে। পাক বাহিনী সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, শহরের পর শহর তছনছ করে নির্বিচারে গুলি করে পাখির মতো মানুষ হত্যা করছে। শহরের মানুষ সপরিবারে গ্রামে ফিরে আসছে। সবার চোখে মুখে শুধু আতঙ্ক, কেউ স্বস্তিতে নেই। বাঙালিরাও দলে দলে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতেছে। মুক্তি বাহিনী অল্প দিনের মধ্যেই প্রতিরোধ গড়ে তুলে পাক বাহিনী বিরুদ্ধে। দেশে তখন পুরোদস্তুর যুদ্ধ চলছে। ফজলুর মনে তখন একটাই চিন্তা, এবার কোন রকমে ক্ষেতের ফসল ঘরে তোলার। তাহলেই সে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। তবে ঘরে নতুন ফসল তোলার আগেই তাদের গ্রামের হাই স্কুলে ক্যাম্প বসায় পাক আর্মি। একদিন ওদের বিশাল সুঠাম দেহ, পোষাক ও অস্ত্র দেখে ফজলু রীতিমতো ভয়ে কাঁপতে থাকে। স্কুলের মাঠে আশেপাশের কিছু যুবকদের ধরে এনে নির্যাতন করেতেছে। তাই মনের আতঙ্কে ফসলের মাঠ ছেড়ে সে দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসে। তারপর কেটে গেল সপ্তাহ খানেক।
একদিন রাতে ফজলুর ফুফাতো ভাই মতিন এসে তার বাড়িতে উঠে। সে কিছুদিন থাকার পর মতিনের আরও দুই বন্ধু এসেও এক রাত যায়। ওদের চলাফেরা ও কথাবার্তায় ফজলুর মনে কিছু সন্দেহ হতে থাকে। মতিনকে চাপ দিয়ে ধরতেই সে সবকিছু খুলে বলে। মতিনের কথা শুনে ফজলু খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে। মুক্তি বাহিনী এসে তার বাড়িতে উঠেছে। এবার তো আর কোন রক্ষা নেই। মতিন আরও জানায়, পাক আর্মির গতিবিধি লক্ষ্য রাখতেই সে এখানে এসেছে। আর কটা দিন থেকেই সে চলে যাবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফুফাতো ভাই হওয়ার কারণে ফজলু না করতে পারলো না। পাক আর্মির চেয়ে রাজাকারদের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে গ্রামবাসী। তবে প্রতিবাদ করার সাহস কারো নেই। তাদের জোর জুলুম নির্যাতন নীরবে মেনে নিচ্ছে। কদিন পরে মতিন চলে যায় এবং এর দু’দিন পথেই পাক আর্মির উপরে মুক্তি বাহিনীর গেরিলা হামলা হয়। এতে করে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। মুক্তি বাহিনীর খোঁজে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে যেতে থাকে। একদিন রাতে ফজলুর বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে গ্রামের তিন রাজাকার তার নাম ধরে ডাকতে থাকে। ফজলু বের হয়ে দেখে শুধু রাজাকার না, সামনে পাক আর্মিও আছে। সে ভয়ে তখন এক দৌড়ে পালিয়ে যায়। এটাই ছিল তার চরম বোকামি। তখন পাক আর্মিও তার পিছু পিছু দৌড়াতে থাকে। এক পর্যায়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে ফজলুকে হত্যা করে। তারপর আবার ফজলুর বাড়ি এসে তল্লাশি করতে থাকে। তখন তার কিশোরী স্ত্রীকে দেখে জোর করে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। যদিও ছালেহার কোলে তখন পাঁচ মাসের শিশু সন্তান। সে পাক আর্মির পায়ে ধরে কান্নাকাটি করতে থাকে। তবুও তাদের মনে বিন্দু পরিমাণ দয়া মায়া হয়নি।
পরদিন ভোর সকালে গ্রামের মানুষ দেখে রাস্তার ঝোপের আড়ালে ফজলুর লাশ পড়ে আছে। কেউ তার লাশ ধরেনি, এমনকি বাড়ি গিয়ে খবরও পৌঁছে দেয়নি। মুয়াজ্জিন হুজুরের কানে খবর পৌঁছাতে তিনি তখন লোকজন নিয়ে ফজলুর লাশ তার বাড়িতে পৌঁছে দেন। তিনি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে ফজলুর দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেন। এদিকে পিতা-মাতা হারা নাতি লাল মিয়াকে কোলে নিয়ে ফজলুর মা লতিফা বানু যেন অথৈ সাগরে ভাসছেন। একমাত্র ছেলে হারানোর শোকে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে অঝোরে কাঁদছেন। ওই দিকে ছেলের বউ আছে আর্মির ক্যাম্পে। তার সুখের সংসার এভাবে কেউ এসে তছনছ করে দিবে, এটা তার দুঃস্বপ্নেও কখনো আসেনি। দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে যাচ্ছে আর পাক আর্মিদের অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় এলাকার রাজাকার মুন্সী নিয়ামত উল্লাহ তার দলবল নিয়ে ফজলুর বাড়ি দখল করে নেয়। চোখের পানি আঁচলে মুছতে মুছতে নাতি লাল মিয়াকে কোলে নিয়ে লতিফা বানু স্বামীর ভিটে ছেড়ে ভিখারির মতো বের হয়ে যান। এই দৃশ্য দেখে মুয়াজ্জিন হুজুর বলে উঠেন, তোদের পাপের কলসি পূর্ণ হইছে, এখন পতন অনিবার্য। তিনি ফজলুর মাকে কিছু দিনের জন্য পাশের গ্রামের একজনের বাড়িতে কিছু দিনের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেন। মতিনের কানে সব খবর পৌঁছে যায়। সে তখন নিজেকে কোন ভাবেই ক্ষমা করতে পারছে না। সবকিছুর জন্য সে নিজেকে দায়ী করছে। যদি না সে ফজলুর বাড়িতে না যেত, তাহলে আজকে তার এমন করুণ পরিণতি নাও হতে পারতো। সব খোঁজ খবর নিয়ে একদিন সুযোগ করে মতিন মুয়াজ্জিন হুজুরকে দিয়ে তার ফুফু লতিফা বানু ও ভাতিজা লাল মিয়াকে তাদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
কিছু দিন পরেই এক রাতে গ্রামের হাই স্কুলের আর্মি ক্যাম্পে মুক্তি বাহিনী গেরিলা হামলা করে তাদের কোনঠাসা করে ফেলে। বেশ কজন মুক্তি বাহিনীর গুলিতে মারা যায়। যারা বেঁচে ছিল, তারা কোন উপায় না দেখে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। তখন মতিন তন্নতন্ন করে ছালেহাকে খুঁজতে থাকে কিন্তু কোথায় খোঁজে পায়নি। কোথায় আছে ছালেহা, সেটা কেউ জানে না। উত্তেজিত হয়ে উঠে মতিন এবং সে রাজাকার মুন্সী নিয়ামত উল্লাহ এর বাড়িতে একদিন রাতে হামলা করে। নিয়ামত জানায়, কদিন আগে পাক আর্মি অন্য একটা ক্যাম্পে ছালেহাকে নিয়ে যায়। তবে কোন ক্যাম্পে নিয়ে গেছে, সেটা সে জানে না। মতিন আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারেনি, সে নিয়ামতের পায়ে গুলি চালায়। তারপর তার বুক বরাবর তিনটা গুলি করতেই নিয়ামতে মৃত্যু হয়। মতিন আবার ফিরে যায় যুদ্ধের ময়দানে। তখন খুব কঠিন সময়, পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। সারা দেশেই পাক আর্মি অনেকাংশে কোনঠাসা হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বলতে গেলে যাকেই পাচ্ছে, তাকেই মারছে। তবে মুক্তি বাহিনীর শক্ত প্রতিরোধে কাছে অল্প দিনের মধ্যেই তারা পুরোপুরি কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ১৬ ডিসেম্বর পাক আর্মির আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় আসে। নাতি লাল মিয়াকে কোলে নিয়ে স্বামীর ভিটে মাটিতে আবার ফিরে আসেন লতিফা বানু। তবে আর ফিরে আসেনি কিশোরী পুত্রবধূ ছালেহা।
মতিনের দেখভল ও সামান্য আর্থিক সহায়তায় নাতি লাল মিয়াকে কোলে নিয়ে আবার শুরু হয় লতিফা বানুর জীবন যুদ্ধ। একদিন লতিফা বানুর জীবন যুদ্ধ থেমে যায়, তখন নাতি লাল মিয়ার বয়স তেইশ বছর বয়স। তখন চাচা মতিন মিয়া তার বিয়ে করিয়ে বাড়িতে নতুন বউ নিয়ে আসে। বর্তমানে লাল মিয়া একজন মধ্যবয়সী পুরুষ, একজন অটোরিকশা চালক। সে প্রাইমারি স্কুলেই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে দিলেও নিজের তিন সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে খুবই আন্তরিক। তার বড় মেয়ে রাফিয়া বর্তমানে কলেজে লেখাপড়া করছে। তার একটা সরকারি চাকরির জন্য লাল মিয়া অনেকের ধারে ধারে ঘুরে এখন বড্ড ক্লান্ত। সবাই জানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার জন্য তার পিতা ফজলু মিয়াকে হত্যা করা হয় এবং তার মা ছালেহা বেগমকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তবুও অনেক চেষ্টা করেও লাল মিয়া পায়নি সরকারি ভাবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সনদপত্র। এমনকি কোন দিন সরকারি ভাবে কোন রকমের সহায়তাও তার ঘরে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার জন্মের পাঁচ মাস পরেই একই দিনে তার বাবা-মা দুজনকেই হারায়। এতিম হয়ে শৈশব ও কৈশোর কাটানোর কষ্ট একমাত্র লাল মিয়া নিজেই জানে। শুধু জানে না এই সমাজ ও রাষ্ট্র। তাই বিজয় দিবসে সবাই যখন বর্ণিল আয়োজনে ব্যস্ত, তখন লাল মিয়া ঘরের কোণে বসে নীরবে কাঁদে। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান শেষে মুক্তিযোদ্ধার যখন বিভিন্ন সরকারি উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরে, লাল মিয়া তখন চোখের পানি মুছে অটোরিকশা নিয়ে বের হয় সংসারের গ্লানি টানতে। বিজয়ের আনন্দ কখনো লাল মিয়াকে স্পর্শ করেনা। তার কাছে বিজয় মানে হতাশা, বেদনা ও বুক চাঁপা কান্না।
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
কুইন্স, নিউইয়র্ক, আমেরিকা