অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
ঘুড়ির আকাশে ঘুরি...
মোঃ তাইব হাজারী
আমার ঘরের বাতিটা নষ্ট হয়ে আছে বেশ কিছুদিন যাবত । সারাদিনে এই কথাটি একবারের জন্য হলেও আমার মনে পড়ে না। ছোট বেলায় একটা গল্প প্রায়ই আমার দাদির মুখে শুনতাম। মাঘের শীতে নাকি শিয়ালের খুব কষ্ট হয়। রোজ রাতের বেলা শীত অসহ্য হলে শিয়াল মনে মনে ভাবে যেভাবেই হোক সকাল হলেই লেপ কাঁথার জোগাড় করবো। কিন্তু সকালে রোদ উঠলেই শিয়ালের আর সে কথা মনে থাকে না। আমারো হয়েছে সেই গল্পের শিয়ালের মতো দশা। তবে অন্ধকার ঘরে থাকতে যে খারাপ লাগে তা কিন্তু নয়। চলতে ফিরতে সমস্যা হয় প্রথম একটু আধটু। অন্ধকার ঘরে প্রথমদিন কেউ থাকলে তার মনে হবে কেউ হয়তো তার গলা টিপে ধরছে! দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন হাঁসফাঁস অবস্থা। বেশ কিছুদিন থাকলে সেই সমস্যার সমাধানও হয়ে যায়। পৃথিবীতে কোনোকিছুই স্থানী নয়। আমাদের সমস্যাগুলোও না। আজকে রাতে ঘরে বাতির প্রয়োজন অনুভব করছি কারণ আমার মাথায় ঘুড়ি বানানোর হুজুগ এসেছে। সাঁইত্রিশ বছরের একটি লোকের প্রকাশ্যে ঘুড়ি বানানোর অধিকার নেই। পাশের রুমের বাতেন ভাই দেখে ফেললেই বলে বসবেন রিপন তোমার বয়স দিনকে দিন নিচের দিকে নামছে ! এখন সম্ভবত চৌদ্দ পনের হবে কী বলো?
উনি এমনই। কয়েকদিন আগে বৃষ্টির ভেতর অল্প বয়সী ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলছি এমন সময় বাতেন ভাই ছাতা মাথায় আসছিলেন। আমাকে দেখেই ডেকে নিয়ে একগাদা কথা শুনিয়ে দিলেন। আপাতত তার ভয়েই দিনের বেলা ঘুড়ি বানানো হচ্ছে না আমার। এদিকে রাতে ঘরে বাতি নেই। আজ আর ঘুড়ি বানানো হবে না। অন্য কোনো সময় হলে নিউমার্কেট গিয়ে একটা ঘুড়ি কিনে নিয়ে আসা যেত। সারাদেশে এখন লকডাউন চলছে। ঘর থেকে বের হলেই পুলিশি জেরায় পড়তে হচ্ছে। স্থান বিশেষে সেনাবাহিনীর লাঠির আঘাতে কারো কারো পশ্চাৎদেশে কালশিটে পড়ে যাচ্ছে। অথচ অতদিন ঘুড়ি কেনার সহজ সুযোগ ছিল কিন্তু আমার ঘুড়ি উড়ানোর সময় হয়ে উঠেনি। সময় হয়ে উঠেনি কথাটা সম্ভবত ভুল হলো। ইচ্ছে থাকলেই সময় হয়ে উঠে। অফিসের নিয়মে বাঁধা কর্মঘণ্টার বাইরে যেটুকু সময় পাওয়া যায় তাতে আর কৈশোরে ফেরার পাগলামি করা হয়ে উঠে না। পৃথিবীর বর্তমান দূর্যোগে ঘরে বন্ধ দিনগুলোয় যখন মন হাপিত্যেশ করছে তখন এমন ইচ্ছাকে নিজে নিজেই সাধুবাদ জানাতে ইচ্ছা করছে। আমার নিজের কাছে যদি কোনো কাজ ভালো মনে হয় এবং সেই কাজ যদি আমি নিজেই করি তাহলে নিজেই নিজেকে বেশ কয়েকবার ধন্যবাদ দেই। কে কবে কোন কাজের জন্য আমাকে ধন্যবাদ দেবে সেই আশায় তো উৎসাহে ভাঁটা ফেলতে পারিনা। তাই নিজে নিজেই এই উপায় বের করে নিয়েছি। তাতে কে কী বললো শোনার দরকার নাই আমার। আজ আর নিজেকে ধন্যবাদ দিতে পারছি না। বরং নিজেকে এখন একখানা কাগজের ঘুড়ির জন্য তিরস্কার দিতে ইচ্ছে করছে।
যখন যে জিনিসটা পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে তখন তার প্রতিই মানুষের অনুরাগ আর আক্ষাঙ্খা প্রবল হয়।
পুরো পৃথিবীর মানুষ এখন ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে। একটি ভাইরাস আজ পৃথিবীর মানুষের সব সাফল্যের অহমিকাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। চীনের উহান প্রদেশ থেকে করোনা ভাইরাসের প্রকাশ ও বিস্তার হলো। প্রথম প্রথম চীন সরকার ভাইরাসটির কারণে সেদেশে মৃত মানুষের সংখ্যা গোপন করতে থাকে। মারাত্মক ছোঁয়াচে এই ভাইরাসের সংক্রমণে উপসর্গ হিসেবে সর্দি কাশি জ্বর ও শ্বাসকষ্ট হয়। সাধারণ ফ্লুর মতো উপসর্গ হওয়ায় বিশ্বের তাবড়-তাবড় দেশগুলো প্রথমে পাত্তা দেয়নি করোনাকে। বাংলাদেশের এক জেনৈক মন্ত্রীই ঘোষণা করে বসলেন আমরা সম্মিলিত জাতি করোনার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তখন সবারই কম বেশি মনে হচ্ছিল করোনা কারো কিছু করবে না।
কিন্তু যত দিন গড়ালো করোনা ততই শক্তিশালী এবং প্রাণনাশী হয়ে উঠল। চীনের সাথে সারাবিশ্বের বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূত্র ধরে খুব কম সময়ের মধ্যে সারাবিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল। করোনা বৃদ্ধ রোগীদের জন্য খুবই খারাপ অবস্থার সৃষ্টি করে বসল। তাছাড়া যে সব লোকের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ রোগ আছে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তাদের জন্যও করোনা ভয়াবহ হয়ে উঠল। চীনের পর ইতালি স্পেন জার্মানীতে করোনার ভয়াল থাবা পৃথিবীবাসীকে বিচলিত করে তুলল। তারপর তার থেকে রক্ষা পেলো না যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ফ্রান্সের মতো দেশগুলোও। স্বল্প সময়ে পুরো পৃথিবীতে মানুষের আতংকের নাম হয় উঠল করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাস তখন মর্যাদা লাভ করলো ডঐঙ থেকে। ডড়ৎষফ ঐবধষঃয ঙৎমধহরংধঃরড়হ কোভিট -১৯ নাম দিলো। কোভিট- ১৯ আক্রান্ত রোগীর সর্বশেষ অবস্থা ক্রোনিক নিউমোনিয়ায় সারাবিশ্বে মরতে শুরু করল প্রতিদিন হাজারে হাজারে মানুষ। পৃথিবীর মস্ত বড় বিজ্ঞানী ডাক্তার নার্সদের ঘুম হারাম হয়ে গেল মূহুর্তের মধ্যে। বার বার জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে করোনা তার প্রতিষেধক তৈরীর সমস্ত চেষ্টাকে ভেস্তে দিতেই থাকল। জেনেটিক পরিবর্তনের সূত্রেই পরবর্তীতে শিশুরাও আক্রান্ত হতে শুরু করল। প্রতিষেধক যেখানে নেই প্রতিরোধই সেখানে একমাত্র উপায় মেনে পুরো পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে অঘোষিত লকডাউন জারি করলো সরকার। করোনা মোকাবিলা নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের জের ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা রোজ হাসির পাত্র হয়ে উঠলেও সেই হাসিতে তো ছিন্নমূল মানুষের পেট চলে না। তাই কাজের খোঁজে আর সাহায্যের আশায় করোনার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ঘর থেকে এসব মানুষ বের হচ্ছে প্রতিদিনই। সরকার দিনরুজি মানুষের জন্য যে ত্রাণের বরাদ্দ দিলো সেই ত্রাণের চাউল দেশের জনপ্রতিনিধিরা চুরি করে নিলো! ক্ষমতাসীন দলের নেতা, চেয়ারম্যান মেম্বারের গোপন আস্তানায় পুলিশের তল্লাশিতে বের হতে লাগল টন টন চাউল। দেশের এমন পরিস্থিতিতে যারা গরিবের হক মেরে খায় তাদেরকে যে পশুর সাথে তুলনা করা হবে সেই পশুরই জাত যাবে। ভোটের সময় শুধু ধোয়া কাপড়ে আতর মেখে চারিত্রিক শুদ্ধতা প্রচার করলেই হলো। এখন দেশের মানুষ গোল্লায় যাক। এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার বালাই বলেও কিছু নাই। যদি থাকতো তাহলে এই সব চোরেরা প্রতিনিধি হতে পারতো না। দ্বিতীয়ত্ব করোনা মারাত্মক ছোঁয়াছে রোগ জানা সত্ত্বেও দল বেঁধে আড্ডাবাজি না করলে এদের কারো পেটের ভাত হজম হয় না।
সরকারি বেসরকারি সব অফিস আদালত বন্ধ। ওষুধ মুদিখানা আর কাঁচামালের দোকান ব্যতীত সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে বার বার বলা হচ্ছে সরকার ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ছিন্নমূল লোক রাস্তায় বের হচ্ছে নিছকই পেটের দায়ে আর কিছু পাতি আমজনতা রাস্তায় রঙ তামাশা করে বেড়াচ্ছে কোন আগ্রহে তার কোনো সঠিক ব্যাখা নেই। হুজুগে বাঙালি না দেখে শিখবে আর না ঠেকে শিখবে। ভাব খানা এমন যে যারা জন্ম থেকেই বিদ্যাসাগর তাদের সামান্য করোনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কিছু থাকতে পারে না। তাদের জানা উচিত করোনা কিন্তু পাগল ছাগল কিছু মানে না। তখন যে দাঁত কেলিয়ে বলবেন আমি পাগল ছাগল মানুষ আমারে ছেড়ে দাও বাপু করোনা। নাহ, সেটা হবে না।
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহআপাতত ঘুড়ি বানানোর কাগজ কাঠি আর আঁঠা গুছিয়ে রেখে দিলাম। বাতেন ভাই আমার অফিস কলিগ। দুজন পাশাপাশি দুইটা রুমে ভাড়া থাকি। আমি এমনিতে স্মোক করি না। তাই সিগারেট কেনার বালাইও নাই। মাঝেমধ্যে বাতেন ভাইয়ের থেকে নিয়ে খাই। কখনো অর্ধেক পোড়া সিগারেট বাতেন ভাই কাউকে দেন না, দিলে পুরোটাই দেন। আমি গিয়ে বাতেন ভাইয়ের কাছে এক শলাকা সিগারেটের আবদার করলাম। বাতেন ভাই আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন কী ব্যাপার তোমার মন খারাপ নাকি? বাতেন ভাই বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছেন বলে লজ্জিত হলাম। অথচ মন খারাপ কম বেশি সবারই হয়। এখানে লজ্জা পাওয়ার মতো কোনো ব্যাপার নেই। আমি বাতেন ভাইয়ের কথায় শুধু ঘাড় নাড়লাম। বাতেন ভাই বললেন তামাক হচ্ছে শরীরের বিষ। খারাপ অভ্যাস না করাই ভালো। তারপর প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন এক শ্রেণীর লোক আছে যাদের জীবন অন্যকে ভালো হওয়ার উপদেশ দিতে দিতেই কেটে যায়, তারা নিজে ভালো হওয়ার সময় পান না। কথাটি কার বলতে পারবে? আমি থমথম খেয়ে বললাম আপনার। বাতেন ভাই মুচকি হেসে বললেন কথাটি হচ্ছে সাহিত্য সম্রাট হুমায়ুন আহমেদের। এই যে আমি নিজে একজন চেইনস্মোকার অথচ তোমাকে উপদেশ দিলাম সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস তৈরী করো না। কী অদ্ভুত ব্যাপার তাই না? আমার থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি বলতে লাগলেন, সাহিত্যের প্রতি একটু অনুরাগী হও। জীবনের অর্থকে খুঁজে পাবে এখানে। বাতেন ভাইয়ের কাছে জোড়াগোল খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার অন্ধকার ঘরে কোথায় কী রাখা আছে আমি জানি। টেবিল থেকে লাইটার খুঁজে নিয়ে সিগারেট ধরালাম। জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। বাতেন ভাই ঠিকই বলেছেন। আমি সাহিত্য বুঝি না। এই যে আমার এখন মনে বাজছে-
পৃথিবীটা সুস্থ হলে
তুমি আমি ফের আরেকবার দেখা করবো।
আমার জন্য রবি বুধের মাঝামাঝি
একটি বিকেল রেখো।
অথচ আমার সাথে সেই বিশেষ কারো কোনো দেখা হয়নি। তার কাছে কোনো বিকেলের প্রার্থনা সুস্থ পৃথিবীতেও কোনোদিন করিনি। কোনো কোনো ব্যাপারে অধিকারের প্রয়োজন পড়ে। আমি আজ অবধি সেই অধিকারের হদিস করে উঠতে পারিনি। আর রবি অথবা বুধবার আমার কাছে বিশেষ কোনো দিনও না।
পরেরদিন ঘুড়ি তৈরির কাজ শেষ হলো।
প্রথমদিন যখন আমি লাটাই নিয়ে ছাদে ঘুড়ি উড়াতে বসলাম তখন আশে পাশের ছেলে বুড়োরা আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে দেখতে লাগলো যেন আমি একজন অপরাধী যে কিনা কিছুক্ষণ হলো জেলের প্রাচীর টপকে অথবা পুলিশের ভ্যান থেকে পালিয়েছি! পাশের বাসার এক মহিলাকে বলতে শুনলাম এমন দূর্যোগের দিনে আধবুড়োর কান্ড দেখে অবাক হতে হয়! মানুষের স্বভাব হচ্ছে যখনই কেউ ভালো কাজ করে আশেপাশের লোকজন তার সমালোচনা করে। তারপর তাকেই আবার অনুসরণ করতে থাকে। আমি দমে গেলাম না এতটুকুও। রোজ সকাল বিকেল দুই বেলা করে ভাড়া বাসার ছাদে ঘুড়ি উড়াতে থাকলাম। সপ্তাহ না ঘুরতেই একজন দুজন করে আশেপাশের প্রায় সমস্ত বাসার ছাদে ছেলে বুড়োর দল ঘুড়ি উড়াতে শুরু করল! নিয়ম ভেঙে কোনো কিছু শুরু করাটাই কঠিন, একবার শুরু হলে চলতেই থাকে। বিকেল হলে এখন আমার চারপাশের আকাশটা নতুন করে সাজে। মূহুর্তেই আমার মন মৃত্যুভয়ের আড়ষ্টতা মুছে ফেলে ঘুড়ির সাথে আকাশে ভেসে বেড়ায়। খুশীরা ঘুড়ির মতোই এঁকেবেঁকে চলে। আমরা যতসময় খুশি থাকি ততটুকুই বাঁচার স্বাদ পাই।