বিমুখতা ও বখে যাওয়া তরুণ সমাজ...
ইফতেখার শামীম
রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে। কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়।
দেহ এবং মন দুয়ে মিলে মানুষ। দেহের সুস্থতার জন্য যেমন খাদ্য প্রয়োজন, ঠিক তেমনি মনের সুস্থতার জন্য প্রয়োজন বই পড়া। বই মানুষের মনে আনন্দ-বেদনার কাব্যিক দার্শনিক সত্যবোধ জাগিয়ে তুলে। বই পাঠে খুলে যায় মানুষের মনশ্চক্ষু। বইয়ের মাধ্যমে বিলীয়মান চঞ্চলমান অতীত ও বর্তমানের মানবসভ্যতার সেতু গড়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাকোঁ বেধেঁ দিয়েছে। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ গিবন বলেছেন, Books are those mirror that reflect our mind, the mind of sages and heroes.
জীবনের নানাবিধ অভিঘাত যখন মানুষকে উন্মক্ত করে তোলে, তখন শান্তনা সহানুভূতি ও আনন্দের জন্য বই পাঠের বিকল্প নেই। বারট্রান্ড রাসেল এর মতে ‘সংসারে জ্বালা যন্ত্রণা এড়ানোর উপায় হচ্ছে মনের ভেতর আপন ভূবন সৃষ্টি করে নেয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, ভবযন্ত্রণা এড়ানোর ক্ষমতা তার তত বেশি হয়। বই পড়া নিয়ে Vincent Staretএর উক্তিও এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য- ÔThen we buy a book we buy pleasureÕ
এবং এই বই পাঠে আপ্লুত হয়ে আনাতোলে ফ্রাস বলেছেন, নানা জ্ঞান বিজ্ঞান যত’ই আমি আয়ত্ত করতে থাকি, ততই একটা একটা করে আমার মনের চোখ ফুটতে থাকে। উল্লেখ্য যে পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম নিভৃতে বৃক্ষতলে স্বর্গরচনার জন্য উপকরণের যে তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন তাতে একখানা কাব্যেরও স্থান ছিলো। তার মতে বই ছাড়া স্বর্গীয় আনন্দ অপূর্ণ থেকে যায়।
এভাবে সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অব্দি যত মনিষী ইতিহাসের পাতায় অমর হয়েছেন, সবার সফলতা এবং অমরত্বের পেছনে বই কোনো না কোনোভাবে সহায়তা করেছে। বই মানবসভ্যতার অন্যতম প্রাণসত্ত্বা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও তেতো সত্য এই যে, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার এই যুগে বই পাঠ থেকে মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের তরুণ সমাজ বইপ্রেমী না হয়ে, ডিজেপার্টি প্রেমে মত্ত হয়ে আছে। আজকাল পরিবারের কর্তা তার সন্তান জন্মানোর সাথে সাথেই তার নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় একাউন্ট খুলছেন, শিশু যখন ২-৩ বছরে পা দিচ্ছে, তখন তার হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে স্মার্টফোন। এবং সেই স্মার্টফোনে ডাউন করে দেয়া হচ্ছে নানাবিধ গেমস। এবং আমাদের দেশের ৭০ ভাগ শিশুই বইয়ের সাথে পরিচিত হবার পূর্বে প্রযুক্তির অপব্যবহারে জড়িত হচ্ছে। প্রযুক্তি অবশ্যই আমাদের জন্য আশীর্বাদ কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার কিংবা মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের সমগ্র জাতির জন্য অশনি সংকেত। ইদানিং আমাদের তরুণ সমাজের ৯৫ ভাগ যত সময় স্মার্টফোন সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটায় তার একভাগও বই পড়ে কাটায় না। ফলশ্রুতিতে আজকালকার তরুণ’রা যখন মনের আনন্দ পাচ্ছে না, নিঃসঙ্গতার অতল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে, তখন তারা মনের আনন্দের জন্য সঙ্গী খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেয়েদের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহের চেষ্টা, ইমো- ওয়াটসআপ-ফেসবুকে মেয়েদের একাউন্ট সার্চ করে ইনবক্সে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্ঠা কিংবা ইন্টারনেটে ডিজে গান অথবা পর্ণো ভিডিও দেখা’ই তাদের মনের প্রধান খাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বই বিমুখতার পাশাপাশি আজকালকার তরুণ’রা ব্যস্ত বিভিন্ন নোংরামি ট্রল এবং ইস্যু নিয়ে। বই বিমুখতার কারণে তরুণরা বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত হচ্ছে, জঙ্গিবাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে। বিভিন্ন নোংরামি ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে । এবং অবশেষে অধিকাংশ তরুণ’ই জীবনের উপর প্রচন্ড বিতৃষ্ণা নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের গোটা সমাজ, আমাদের স্বপ্নবাজ তরুণ যাদের মেধা আর বুদ্ধিভিত্তিক অগ্রগতিতে রাষ্ট্র ও সমাজ অগ্রগতির স্বপ্ন দেখতে পারতো, তারা আমাদের চোখের সামনেই ধ্বংস হচ্ছে। এই ধ্বংসপ্রায় তরুণ সমাজকে উদ্ধারের এক এবং অন্যতম পথ তরুণদের বই পাঠে অভ্যস্ত করে তোলা। বই যে আমাদের মনের ভেতর চমৎকার জগত তৈরি করে দেয়, তা এই তরুণ সমাজ যদি বুঝতে পারে তাহলে এই তরুণদের নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উচুঁ করে দাড়াঁনোর স্বপ্ন এবং আশা রাখতে পারে । একমাত্র বই’ই যুগে যুগে ত্যাগের দীক্ষা, সত্য ও সুন্দরের সাধনায় মানুষকে প্রলুব্ধ করেছে । তাই মানবজীবনে বই পাঠের মূল্য গভীর ও ব্যাপক।
কোনো এক কবি লিখেছেলেন,
পড়িলে বই আলোকিত হই
না পড়িলে বই অন্ধকারে রই
অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া তরুণ সমাজকে আলোর ধারায় ফিরিয়ে আনতে বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র বই, বই এবং বই’ই আমাদের এই বখে যাওয়া তরুণ সমাজকে বুদ্ধিভিত্তিক চর্চায় মনোনিবেশ করাতে বাধ্য করতে পারে।