রহস্যাবৃতা

 


রহস্যাবৃতা

সোহেল বীর


নতুন মোবাইল ফোন কেনার পর মিসড্ কল দিতে খুব ভালো লাগত। অন্যরকম অনুভূতি কাজ করত নিজের ভিতর। বিষয়টা দারুণ উপভোগ করতাম আমি। আন্দাজে নম্বর তৈরী করে মিসড্ কল দেওয়াটা ছিল আরও বেশি উপভোগ্য। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ভালো লাগাটা বিষাদে পরিণত হলো। ভাবনার নদীতে জোঁয়ার বইতে শুরু করল। মিসড্ কল দেওয়াটা অন্যের মতো আমার কাছেও কেমন যেন বিরক্তিকর মনে হতে লাগল। সিদ্ধান্ত নিলাম আর কাউকে মিসড্ কল দেবো না। বন্ধ করে দিলাম অন্য নম্বরে মিসড্ কল দেয়া। কিন্তু নিজে মিসড্ কল দেয়া বন্ধ করলেও অন্য নম্বর থেকে ঠিকই মিসড্ কল আসতে শুরু করল। হিতে বিপরীত। 

বিশ্বদ্যিালয়ের আবাসিক হলের সামনে গোল চত্বরে একা একা বসে আছি। একটু দূরে কপোত কপোতিরা বসে গল্প করছে। আমার একাকি বসে থাকাটা কারো কারো কাছে হাসির উদ্রেগ হয়েছিল বটে। তাতে কি? আমার সঙ্গী ওই নীল আর পশ্চিমাকাশের গোধূলী। গোধূলী তার পূর্ণ যৌবন নিয়ে হাজির হয়েছে এতক্ষণে। খুব আপন মনে যুবতী গোধূলীকে উপভোগ করছি। এমন সময় একটি অপরিচিত নম্বর থেকে পরপর তিনটি মিসড্ কল আসলো আমার মোবাইলে। কল ব্যাক করব কিনা ভাবলাম। শেষমেশ আমার মোবাইলে কিছু ফ্রি মিনিটের সদ্ব্যবহার করতে ফোন দিলাম। ফোন দিতেই চিকন সুরের কন্ঠ বেঁজে উঠল আমার কানে। কিছুটা ইতস্ততের সাথে তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি খুলনা থেকে বলছি কিনা। আমি হ্যা সূচক উত্তর দিতেই তিনি বললেন তিনি আমার বান্ধবীর ছোট বোন। তার বড় বোন নাকি আমার সাথে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসিতে পড়ে। আমি তার বোনের নাম জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে কথা না বলার হুমকি দিয়ে বললেন আমি যেন তার বোন সম্পর্কে কোনোকিছু জানতে না চাই। বুঝতে পারলাম নাম জানতে চাওয়াটা হয়তো আমার অপরাধ হয়ে গেছে। বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন রহস্য মনে হতে লাগল। আমি ‘আপনি’ সম্বোধন যেন না করি সেজন্য মেয়েটি আমাকে অনুরোধ করল। আমিও সুবোধ বালকের মতো তার অনুরোধের ঢেঁকি গিললাম। এরপর থেকে মেয়েটি আমাকে নিয়মিত মিসড্ এবং কল দুটোই দিতে লাগল। তবে সে সবসময় তার সুযোগ ও ইচ্ছেমতো কথা বলত। 

তার সিমটা বন্ধ থাকে সব সময়। আমি ইচ্ছে করলেও তার সাথে কথা বলার কোনো সুযোগ ছিল না। যখন আমার সাথে তার কথা বলতে ইচ্ছে হতো তখন সে নাকি কিছু সময়ের জন্য সিমটা তার বাসার মোবাইল ফোনে ভরে আমার সাথে কথা বলত। এভাবে দিন যত যেতে লাগল আমার কাছে তার কল দেয়ার মাত্রাটা বাড়তে লাগল। ভেবে কূল পাই না, মেয়েটি কেন আমার সাথে কথা বলে, কী চায় সে আমার কাছে। সবকিছুই আমার কাছে কেমন যেন রহস্য মনে হতে লাগল। তার সম্পর্কে কোনোকিছু না জানিয়ে মেয়েটি দিনের পর দিন আমার সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলতে লাগল। আমিও তার কথার ¯্রােতে গা ভাসিয়ে দিলাম। 

মেয়েটির বোনের সম্পর্কে জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠল মন। আমার জানা মতে আমাদের সাথে ছয়জন মেয়ে পড়ে। তাদের কারোরই ছোট বোন নেই। তাই মেয়েটির বোন কে, তা জানার আগ্রহটা আরও বেড়ে গেল। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রায়ই বলতাম, ‘তোমার বোন আমাদের সাথে, না আমাদের জুনিয়র ব্যাচের কেউ?’ কারণ, আমরাই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচ। মেয়েটি নিশ্চিত করে কিছু বলত না। বলত তার বোনের সাথে সম্পর্ক তেমন ভালো না থাকায় সে সঠিক জানে না আসলে তার বোন কোন বর্ষে পড়ে। কৌতূহলটা বেড়ে গেল দ্বিগুণ। 

মেয়েটির বোনের সম্পর্কে যখনই জানতে চাইতাম তখনই সে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার চেষ্টা করত। একদিন তো বলেই ফেলল আমি কেন এত তার বোন সম্পর্কে জানতে চাই। সে আমাকে অভিমানের সুরে বলল, ‘আমার সাথে কথা বলতে আপনার ভালো লাগে না? যদি ভালো না লাগে তবে আমি আর কোনোদিন আপনাকে ফোন দিব না!’ আমি সব সময়ই তার কথার যথার্থ মূল্য দেওয়ার চেষ্টা করতাম, কেন তা জানি না। তাই বললাম, ‘না, তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগবে না কেন? খুব ভালো লাগে।’ তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম মাত্র। 

মাঝে মাঝে তার সাথে আমার দীর্ঘক্ষণও কথা হতো। কথা বলার বিষয়টা থাকতো এই যেমন মেয়েটিকে আমার কেমন লাগে, আমি কোন ধরনের মেয়েকে পছন্দ করি ইত্যাদি। আমি কোনো মেয়েকে ভালোবাসি কিনা সেটাও জানতে চাইল একদিন। আমি বলেছিলাম, ‘না’। উত্তরটা শুনে মনে হলো সে একটু খুশিই হলো। কেন খুশি হলো তা জানতে পারলাম না। তবে সে আমাকে নিশ্চিত করল যে, এই ধরনের ছেলেদের নাকি তার খুব পছন্দ- যারা প্রেম করে না! কিন্তু আমার ভিতর জন্ম নেয়া রহস্যের জট খুলতে পারলাম না কোনো মতে। মেয়েটির বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে সে বললো পাংশাতে। রাজবাড়ি জেলার একটি উপজেলা পাংশা। পাংশায় আমি অনেকবার গেছি। আমার সেজমামা পাংশা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের স্যার। মামার বাসায় মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম। পাংশায় বাড়ি কথাটি শোনার পর তার  সম্পর্কে জানতে আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়লাম।

বেশ ক’দিন মেয়েটার কোনো খোঁজ পাই না। ভাবলাম একটাবার খোঁজ নিই- অসুখ বিসুখ হলো কিনা। তাকে ফোন দিলাম। কেমন আছে, কোথায় আছে জানতে চাইলাম। সে বলল, ‘ঝিনাইদহে’। ঝিনাইদহে! আমি বেশ অবাক হলাম! ভাবলাম, মেয়েটির সাথে দেখা করার দারুণ সুযোগ! মনটা কেন জানি মেয়েটির সাথে দেখা করার জন্য আস্ফালন করতে লাগল। কারণ একটাই- কৌতূহল। তাছাড়া কেন জানি মেয়েটিকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। 

আমি মেয়েটিকে দেখা করার জন্য বললে সে আমার সাথে দেখা করতে রাজী হলো না। আমাকে বলল, তারা সেদিনই নাকি পাংশাতে চলে যাবে। ঝিনাইদহে তাদের গ্রামের বাড়ি আর পাংশায় তার বাবা সরকারি চাকরি করেন। মেয়েটির সাথে দেখা করতে না পারাই কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে গেল। সময় নিয়ে স্বাভাবিক হলাম। মনকে বোঝালাম মেয়েটি তো আমার কেউ না! তার জন্য আমার কীসের মন খারাপ?

কিছুদিন পর। আমার সকল কৌতূহল আর জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মেয়েটি আমাকে ফোন করে বলল, ‘আসলে আমি দীপা। পাংশা মহিলা কলেজে মানবিক বিভাগে প্রথম বর্ষে পড়ি। আমার কোনো বোন নেই, আমি একা। আমি আপনার নাম্বারটা আমার বান্ধবী মোনালিসার বড় বোনের কাছ থেকে পেয়েছি। মোনালিসার বোন আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তবে তিনি ফার্মেসির ছাত্রী না, তার (রুমমেট) বান্ধবী ফার্মেসিতে পড়ে। কোন্ বর্ষে পড়ে তা আমি জানি না। আমাদের কলেজের একটা ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক আছে। তাকে আমি জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি! ইদানিং সে অন্য এক মেয়ের সাথে মোবাইলে কথা বলে। আমাকে খুব একটা সময় দেয় না। সেই যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে ওকে (মেয়েটির ভালোবাসার মানুষ) কষ্ট দেয়ার জন্য আমি আপনার সাথে এতদিন কথা বলেছি। আপনার সাথে যত কথা হয়েছে সব কথাই আমি পরে ওকে বলেছি। আপনার সাথে এতদিন অভিনয় করার জন্য আমি সরি‌্য। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন।’ অভিনয়! কথাটি শোনার পর অবাক বিস্ময়ে আকাশের দিকে নীরব দৃষ্টিতে নির্বাক তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। মেয়েটির কথার যে জটিল সমীকরণ তা বুঝতে সময় লাগল আমার। তার কথায় মনে হলো, দীপাবলীর সকল আলো একসাথে অন্ধকার হয়ে আমাকে ভেংচি কাটছে। আর আমি ভয়ে প্রলাপ বকছি- হায়রে পৃথিবী, তুমি বড়ই বিচিত্র! আর বিচিত্র এই পৃথিবীতে দীপারা বড় বেশি রহস্যময়ী!





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট