সাড়ে ছত্রিশ বছর পরে...
রেজাউল রেজা
আচমকাই যখন তার সাথে দেখা হলো তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সে।
আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিল, এদিক-ওদিক তাকাতাকি করছিল।
তখন সে পার্কে পশ্চিমমুখো বেঞ্চিতে ছিল না--চলে গিয়েছিল সাড়ে ছত্রিশ বছর আগের সোনালী সময়ে।
যেটা ছিল তাঁর জীবনের অন্য রকম এক অধ্যায়।
আপনি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছেন,
সেই শুরু থেকেই সে সে করে যাচ্ছি--তার নামটা বলছি না।
আর সেই সে, কাকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ল সেটাও বলছি না।
শুনুন তাহলে, এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম ওর নাম শাহজাহান আলী তপন।
আমরা এক সাথে অনার্সে পড়তাম।
সে ছিল আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান।
কোনকিছুরই অভাব ছিল না তার।
যখন যা লাগে তাই পেয়ে যেত হামেশাই।
আমরা ওকে দেখে আফসোস করতাম।
“তোর বাপ তো একটা দৈত্যরে ভাই!” এটা বলে তপনকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করতাম।
ওর একটা জাপানি কোম্পানির বাইক ছিল।
আমি, জহির ও তপন আমরা তিনজন ছিলাম জানের জিগর বন্ধু।
তপন বাড়িতে থাকত আর আমরা হোস্টেলে। বাড়িতে থাকলেও ওর মনটা হোস্টেলেই পড়ে থাকতো। সকালের খাওয়ার পর পরেই হোস্টেলে চলে আসতো।
আমাদের কাছে না এলে যেন পেটের ভাত হজম হয় না ওর।
বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান হলেও তপন খুব নম্র-ভদ্র ছিল।
ধূমপান, মেয়েদেরকে টিজ করা একদম সহ্য করত না।
একদিন তিনবন্ধু মিলে তপনের বাইকে চেপে ঘুরতে যাচ্ছিলাম।
কোথায় ঘুরতে যাচ্ছি সেটা জানতাম না।
নীলফামারী টু পঞ্চগড় এশিয়ান হাইওয়ে ধরে যাচ্ছিলাম।
বাইক আমিই চালাচ্ছিলাম।
যেতে যেতে একটা নদীর কাছে গেলাম, পরে জানতে পারলাম সেটা ছিল করতোয়া নদী।
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ এলাকায়।
সেখানে খুব সুন্দর একটা বড়সড় ব্রিজ ছিল।
ব্রিজটা নতুন হয়েছে।
তাই লোকজন বিকেলের অবসর সময় কাটাতে সেখানে আসতো।
ধীরে ধীরে সেখানে একটা ছোটখাটো শিশু পার্কও তৈরি হয়েছিল। বাইকটা গ্যারেজে রেখে ব্রিজের উপরে রেলিং ঘেঁষে হাঁটছিলাম।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তপনের যে কি হলো! বলল- দোস্ত চল্ চল্ ওদিকটাতে যাই।
খুব তারা দিচ্ছিলো সে।
ব্রিজের পশ্চিম মাথায় গিয়ে উত্তর পাড়ে গেলাম।
আমরা দুজন কিছু বুঝতে পারছি না কেন আমরা এত তারাহুড়ো করে ওদিকে গেলাম।
ও একটা মেয়ের দিকে ইশারা করল।
মেয়েটির দিকে তাকাতেই আমার চোখে আলোর একটা ঝলকানি লাগলো।
আমি সেই আলোতে আশেপাশের আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।
সৃষ্টিকর্তা কি দিয়ে তৈরি করেছেন ঐ মেয়েটিকে?
মানুষ এত সুন্দর হয়!
সে আসলেই মেয়ে, নাকি জলপরী?
ঘনকালো লম্বা লম্বা চুল, পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির মত লম্বা, ছিপছিপে গড়ন।
একেবারে শ্বেতবর্ণ নয়--লাল ফর্সা।
কপালে ছোট্ট কালো টিপ আর নীল শাড়িতে আপরূপা লাগছিল যেন জান্নাতী হুর নেমে এসেছে এ ধরায়।
আমাদের বুঝতে বাকি রইলো না তপন মেয়েটিকে পছন্দ করে ফেলেছে।
পছন্দ করাটাই স্বাভাবিক, যে কেউই করবে।
মেয়েটি নদীর পানি নিয়ে খেলা করছিল, খানিকটা দূর থেকে তার পাগলামী আপন মনে দেখছিল তপন আর মনে মনে ভাবছিলো, যে করেই হোক মেয়েটির সাথে কথা বলতে হবে।
আমাকে যে কথা বলতেই হবে।
আমরা তিনজন ধীরে ধীরে মেয়েটির কাছে গেলাম।
আমাদেরকে দেখেই মেয়েটি থতমত খেলো। ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি জিজ্ঞেস করলাম-আপু, কেমন আছেন? আমরা আপনার সাথে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
মেয়েটি খানিক সময় চুপ থাকলো তারপর ভদ্রতার সাথে বলল, বলুন কি বলবেন।
তার কথা শুনে মনে হলো কোন ভালো পরিবার মেয়ে।
আপু, আপনার নামটা বলা যাবে?
-আশ্চর্য! কেন বলা যাবে না? নাম তো মানুষের পরিচয়ের জন্যই।
আমি শ্রেয়া। দেবীগঞ্জ এন.এন. স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ছি।
আর আমাদের বাসা দেবীগঞ্জ প্রোপারেই।
আর কিছু? বলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আমাদের দিকে।
তপন ও জহির তখনও স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশে।
আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম।
ঠিকানাও দিলাম।
তপন যে তাকে দেখে পাগল হয়েছে সেটাও বলে দিলাম।
মেয়েটি কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করলো তারপর বলল-আমি আপনাদের ঠিকানায় চিঠি লিখব।
শ্রেয়ার কথা শুনে তপন কি খুশি!
অথচ এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি, স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে ছিল।
কিছুদিন পর একটা চিঠি এলো। তপনের নামেই এলো। চিঠি পেয়েই বাইক বের করে হোস্টেলে চলে এলো।
তিনবন্ধু অধীর আগ্রহ নিয়ে চিঠিটা খুললাম।
“আমারও আপনাকে ভালো লেগেছে”
-আপনার শ্রেয়া।
চিঠিতে এটুকুই লেখা ছিল।
ইয়া.....হু কাজ হয়ে গেছে কাজ হয়ে গেছে!
এই খুশিতে সেদিন জম্পেশ একটা খাওয়া-দাওয়া দিলো তপন।
ধীরে ধীরে চিঠিতে শব্দের পরিমাণ বাড়তে থাকলো, তারপর বাক্যের।
অতঃপর চিঠি দুই-তিন পাতায় রূপ নিলো।
তপন কোন চিঠিই একা পড়তো না- আমাদেরকে সাথে নিয়েই পড়তো।
অবশেষে প্রেম হয়ে গেল।
চিঠির সাথে সাথে ফটো আদান-প্রদান চলতে থাকলো।
প্রতিটি ফটোতেই শ্রেয়াকে অপ্সরীর মত লাগতো।
কয়েকবার করতোয়া ব্রিজের পাশে দেখাও করা হয়ে গেল।
ভালোই চলছিলো তপন-শ্রেয়ার দিনগুলো।
শ্রেয়া এস.এস.সি পাশ করে পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজে ভর্তি হলো।
সব খবরই আমরা শ্রেয়ার চিঠি মারফত জানতে পারতাম।
দেখার করার স্থান, সময় সবকিছুই সে চিঠিতে লিখে দিত, আমরা ঠিক সেই সময় সেই জায়গায় হাজির হতাম। এভাবেই দেখা হতো।
এভাবে তাদের সম্পর্কে বয়স প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল।
সেদিন রবিবার ছিল। তপন অধীর আগ্রহে শ্রেয়ার চিঠির জন্য অপেক্ষা করছে।
সাধারণত রবিবারই শ্রেয়ার চিঠি আসে।
চিঠি এলে বাড়িতেই আসে, তাই সেদিন আর সে বাড়ির বাইরে গেল না। কিন্তু
চিঠি এলো না।
এভাবে কয়েকদিন কেটে গেল। তপনের দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগল।
শুধু তপনের নয়--আমাদের তিনজনেরই।
বহুল প্রতীক্ষিত চিঠিটি এলো দু’সপ্তাহ পরের এক রবিবার।
আমরা তিনজনেই ভয়ে ছিলাম।
হয়তো চিঠিতে খারাপ কিছুই লেখা আছে। না হলে এত দেরিতে এলো কেন?
বুক দুরুদুরু করছে।
অজানা ভয় আর শঙ্কা নিয়ে চিঠিটা খুললাম।
যা ভাবছিলাম তাই হলো।
চিঠির সম্বোধনের নিচের বাক্যটা দেখেই হু হু করে কেঁদে উঠল তপন।
আমিও নিজেকে সামলাতে পারলাম না।
জহির বেচারা শক্ত মানুষটার চোখ দিয়েও পানি বের হলো।
তারপর পুরো চিঠিটা পড়লাম।
চিঠিতে লেখা ছিল-
প্রিয়তম তপন,
ভেবে নিও আমি মরে গেছি। এটাকে বেঁচে থাকা বলে না,বলে না.........
জানি, এই চিঠি পড়ার পর তুমি অনেক কষ্ট পাবে। নিজেকে সামলিয়ে নিও।বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বুকে পাথর বেঁধে অনেক সত্য মেনে নিতে হয়।
আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
সেদিন কোনপ্রকার কথাবার্তা ছাড়াই হঠাৎ করে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
আমি নিরুপায় ছিলাম। ভেতরে ভেতরে কেঁদে কেঁদে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কেউ বুঝার চেষ্টা করেনি কেন কাঁদছি। আমি আজও কাঁদি, এই কান্না হয়তো সারাজীবনের সঙ্গী হয়েই থাকবে।
পারলে ক্ষমা করিও আমাকে।
আর হ্যাঁ, কখনও করতোয়া ব্রিজের কাছে এসো না। তাতে কষ্ট বাড়বে।
ইতি
শ্রেয়া
শ্রেয়ার চলে যাওয়া বেশ প্রভাব ফেলল তপনের জীবনে।
সে হারালো শ্রেয়াকে আর আমরা হারালাম আমাদের প্রিয় বন্ধু তপনকে।
সেদিন থেকেই পড়ালেখা বাদ দিয়েছিল সে।
বাবার ব্যবসায় ব্যস্ত জীবন কাটাতে শুরু করল। আমরাও বাধা দেইনি। ব্যস্ত থাকলে যদি কষ্ট ভুলে থাকতে পারে তাহলে সেটাই ভালো।
পড়ালেখা শেষ করে আমরা দুজনেই সরকারি চাকরি পেয়ে গেলাম।
ট্রান্সফারেবল জব মানেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ানো।
এভাবে আলাদা হয়ে গেলাম তিনবন্ধু। ঈদ বা পুজোয় লম্বা ছুটি পেলে অবশ্য দেখা হতোই।
আমি ও জহির দুজনেই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি।
এখন আমাদের তিনবন্ধুর আড্ডাটা আবার বসে। যদিও আগের মত নয়।
আজ সাড়ে ছত্রিশ বছর পর আমরা যখন বুড়ো হয় গেছি তখন পার্কে আচমকাই শ্রেয়ার সাথে দেখা হবে কখনও ভাবিনি।
শ্রেয়ার মাঝেও বয়সের ছাপ কম পড়েনি।
তবে রূপের ঝলক আজও কমেনি।
অনেক গল্প, অনেক কথা হলো পার্কে বেঞ্চে বসে।
সে তাঁর ছেলের চাকরির সুবাধে এখন নীলফামারীতেই থাকছে।
ওর স্বামী মারা গেছে এক বছর হলো।
এখন প্রতিনিয়তই মর্নিং ওয়াক করার সময় আমাদের দেখা হয়। তপন ও শ্রেয়াকে একদিকে হাঁটতে দিয়ে অন্যদিকে যাই আমরা দুজন।
ওরা গল্প করে, হাসাহাসি করে। আমরা দূর থেকে দেখি আর মনে মনে হাসি।
দুজনে বলে উঠি-
যে সঙ্গ মিলেনি যৌবনে, তা মিলল বটে-মিলল বার্ধক্যের ক্ষণে।।
দক্ষিণ কাকড়া, কাকড়া বাজার, ডিমলা, নীলফামারী।
গল্পটা পড়ে অনেক ভালো লাগলো
Reply