মহাব্বত আলীর উপলব্ধি
প্রকৌ. আমিনুল ইসলাম
মহাব্বত আলী এক ফার্মেসী থেকে আরেক ফার্মেসী ছুটছেন। থানা সদরের সব বড় বড় ফার্মেসীতে একটি ওষুধ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোথাও তা খুঁজে পাচ্ছেন না।
দুই মাস আগে মহাব্বত আলীর ঘর উজ্জ্বল করে একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিলো। প্রথম সন্তান বলে নাম রেখেছেন প্রথমা। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। দেখতে অবিকল মহাব্বত আলীর মত হয়েছে। তাই মহাব্বত আলীর আনন্দের সীমা নাই।
এই আনন্দ তার বেশি দিন রইলো না, কারণ কয়েকদিন ধরে বাচ্চাটি জোরে জোরে কাঁদছে। একবার কান্না শুরু করলে আর থামানো যায় না। কান্নার ধরন দেখে মনে হচ্ছে সে কোথাও ব্যথা পাচ্ছে। এতে মহাব্বত আলীর খুব টেনশন হচ্ছে। সবাই বলছে এটি খুব সাধারণ বিষয়, আস্তে আস্তে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে; ডাক্তার দেখানোর দরকার নাই। কিন্তু মহাব্বত আলীর মন সইছে না, প্রথম বাবা হয়েছে বলে কথা। তিনি তার কন্যাকে থানা সদরের প্রায় সব ডাক্তার দেখিয়েছেন। কিন্তু বাচ্চাটির কান্না কোন ভাবেই থামছেনা। বরং দিনে দিনে কান্না আরো বেড়ছে। কেউ বলছে হুজুরের পানি খাওয়ালে ঠিক হবে। তাই তিনি বড় হুজুরের পানি পড়া এনে খাওয়ালেন বাচ্চাটিকে, কিন্তু কোন উন্নতি হয় নাই।
মোহাব্বত আলীর এক আত্মীয় ঢাকায় একটি হাসপাতালের ডাক্তার। তিনি ঐ ডাক্তারের সাথে ফোনে তার কন্যার বিষয়ে কথা বলেছেন। ডাক্তার সাহেব তার বাচ্চাকে একটি ওষুধ খাওয়াতে বলেছেন। সাত দিন খাওয়ানোর পর যদি উন্নতি না হয় তবে বাচ্চাকে ঢাকায় এনে বিভিন্ন টেষ্ট করাতে হবে। আর এখন সেই ওষুধটি খুঁজে খুঁজেই হয়রান হচ্ছেন মোহাব্বত আলী। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ওষুধ না পেলে মহাব্বত আলী নিজেই হয়তো কেঁদে ফেলবেন।
এই থানা সদরে আর বাকি মাত্র একটি বড় ওষুধের দোকান, যেখানে মোহাব্বত আলী এখন যাচ্ছেন। তিনি ভাবছেন, ওষুধটি এখানে পাওয়া না গেলে থানা সদরের আর কোথাও পাওয়া যাবেনা, তখন তাকে জেলা শহরে গিয়ে খুঁজতে যেতে হবে। এই বড় ওষুধের দোকানের আগে একটি ছোট ওষুধের দোকান আছে। সব কাস্টমার ছোট দোকানের সামনে দিয়ে বড় দোকানে যায়। যে লোকই এই ছোট দোকানটির সামনে দিয়ে যায় তাকে দোকানদার বলেন ‘আসেন, আসেন, এখানে আসেন।’ যথারীতি মহাব্বত আলী অস্থির হয়ে এই দোকানটির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, দোকানদার বলে উঠলেন ‘আসেন, আসেন, ভাই এখানে আসেন।’ মোহাব্বত আলী মনে মনে ভাবছেন,
‘সদরের সব বড় বড় দোকানে ওষুধ খুঁজে পাচ্ছিনা। আর তিনি আমাকে তার এই দুই হাতের দোকানে ডাকছেন।’ বড় ওষুধের দোকানে গিয়ে মহাব্বত আলী জিজ্ঞেস করেন,
‘ভাই, এই ওষুধটা আছে?’
‘একটু দাঁড়ান। খুঁজে দেখছি।’
‘নাই। শেষ হয়ে গেছে।’
‘ভাই, কই পাবো বলতে পারবেন?’
‘ঐ ছোট দোকানটিতে দেখতে পারেন।
‘ভাই, সব বড় বড় দোকানে খোঁজ করে কোথাও পাচ্ছি না। আর আপনি বলছেন, ঐ ছোট দোকানে দেখতে!’
‘ভাই, অনেক সময় ছোটরাও উপকারে আসে।’
মহাব্বত আলী যেতে চাইলেন না ছোট দোকানটিতে, কিন্তু বড় দোকানের লোকটি তার দিকে যেভাবে তাকিয়ে আছে। সে চক্ষুলজ্জায় ছোট ছোট পা দিয়ে ঐ ছোট দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি ভাবলেন দোকানে না জিজ্ঞেস করেই চলে যাবেন, ঠিক তখনই পিছনে ফিরলেন মোহাব্বত আলী। দেখলেন লোকটি এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘ভাই, এই ওষুধটা চিনেন?
‘হ্যাঁ।
‘আছে?
‘দাঁড়ান, দেখি।’
‘মনে হয় নাই আপনাদের কাছে, যাই।
দোকানের কর্মচারী পেছন থেকে বলে উঠলো, ‘এই ওষুধ আছেতো।’
মোহাব্বত আলী একটি বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ভাই আমাকে বাঁচালেন।’ এতো ছোট দোকানে ওষুধটি পেয়ে মোহাব্বত আলী অবাক হলেন।
ঐ ওষুধটি খাওয়ানোর পর থেকে তার কন্যার কান্না কমতে থাকলো।
এরপর মোহাব্বত আলী আর কখনো ছোট বলে কাউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেনি।