হৃদয়ের হাহাকার







হৃদয়ের হাহাকার
 রাহাত রাব্বানী

এ কী কঠিন কাজ আমার কাঁধে, আপনাকে নিয়ে কি লিখবো, কবি? আপনি তো থাকেন আমাদের ভেতর, আমাদের বাহির। আপনার কবিতার কাছে সেই প্রথম থেকেই তো বারবার আশ্রয় খুঁজে নিই- ‘পাঠে আমার মন বসে না/ কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।’ আপনাকে নিয়ে কী লেখা যায়; হৃদয়ের হাহাকার?  শেষ যেদিন, আপনার সাথে দেখা, ১০ জুলাই ২০১৮; আপনি কিছুই বলেন নি। বলতে পারেননি। শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন দেবশিশুর মতো। সেই গল্পটা লিখেছি এবারের বইমেলায় প্রকাশিত আমার ‘বলতে এলাম ভালোবাসি’ গ্রন্থে। সাথে যুক্ত করেছি প্রথম দেখার দিন। লিখেছি একটি ভারী আকাশ আপনার কাঁধেচাপা দিয়ে আছে। বড্ড কষ্টে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই ভার। অথচ কবি, দেখুন, আপনাকে আর এই ভার বইতে হলো না; বইতে হবে না। আপনি লোক থেকে লোকান্তরে পৌঁছে গেলেন। ধরা দিলো আপনার কাক্সিক্ষত সেই শুক্রবার: ‘রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে/ মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;/ অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে /ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’ আপনি মেনে নিলেন। অথচ আপনার সাথে এপারে আর দেখা হলো না। যদিও জাতীয় প্রেসক্লাবে কফিনবন্দী আপনি নিথর-নিস্তেজ শুয়ে আছেন তখনও। আপনাকে ঘিরে আপনার অজস্র ভক্ত, শুভানুধ্যায়ী। এই তো শেষ। এরপর আপনি যাত্রা দেবেন, মহাকালের পথে— আপনার সেই তিতাস নদীর বাঁকে। মৌড়াইলের মোল্লা বাড়ি।

চেয়েছিলাম, সদ্যপ্রকাশিত আমার বই নিয়েই আপনার কাছে যাবো। যেখানে আপনাকে নিয়ে লেখার দুঃসাহস দেখিয়েছি। তারিখও নির্ধারণ করে রেখেছিলাম প্রায়। কিন্তু প্রকৃতি যে, কারও জন্য অপেক্ষা করে না! আপনার স্বজন আবুল হোসাইন’র মাধ্যমে জানি আপনাকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। রাখা হয়েছে সিসিইউ-তে। ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। একপ্রকার ভয় কাবু করে নিলো। তখন মধ্যরাত। আপনার অবস্থার আরও অবনতি ঘটলো। আপনি চললেন আইসিইউতে। তারপরও প্রার্থনায় ছিলাম, ‘কবি, ফিরে আসুন। আপনাকে ফিরতে হবে।’ এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিবস, রজনী। তারপর... তারপর... এ বেদনা রাখাবো কোথায়?

কবি, বাংলা কবিতায় গ্রামজীবনের এক চিরায়ত কণ্ঠস্বর আপনি। কবিতায় আপনার নিজস্ব এক জগৎ। সেই জগতে যন্ত্রণাদগ্ধ শহরজীবনের স্থান নেই। সেই জগৎ স্নিগ্ধ-শ্যামল। অথচ আপনি কবি হতে যন্ত্রণাদায়ক এই শহরে এসেছিলেন সব ছেড়ে। কবি হয়েছেন। বাংলা ভাষার প্রধান কবি। এত বছর পর পাওয়া, না-পাওয়া, হারানোর অজস্র ঘটনা নিয়ে আপনি চিরকালের জন্য চললেন আপনার গ্রামের বাড়ি।

পাঠ্যবই থাকা ‘নোলক’ কবিতা দিয়ে মুগ্ধতা শুরু। তারপর  ‘লোক লোকান্তর’ আর ‘সোনালী কাবিন’ আপনাকে করেছে এক ঘোরের নাম। সেই ঘোর থেকে এখনও বের হতে পারিনি। প্রয়াত কবি শহীদ কাদরী এক অনুষ্ঠানে আপনার কবিতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘কবি আল মাহমুদের কবিতা, বাংলা কবিতার শত শত বছরের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তৈরি করেছে নতুন বাঁক। তাঁর কবিতার গীতল ধারা আমাদের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার।’ এ তো ধ্রুব সত্য।

কবি, রাজনৈতিক ভাবে যারা আপনাকে অপছন্দ করেন; তারাও আপনার কবিতা পড়েন। পছন্দ করেন। মুখস্থও রাখেন। এ তো আপনি জানতেন। বলতেনও। আপনিই তো আপনার অমর সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’ এ বলেছেন‘পরাজিত হয় না কবিরা।’  মৃত্যুও আপনাকে পরাজিত করতে পারেনি। আপনি যে কবি। আপনি এখন চিরজীবিতদের দলে।










শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট