জীবন্ত কিংবদন্তি ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু






জীবন্ত কিংবদন্তি ভাষাসৈনিক
গোলাম আরিফ টিপু

হাসনাত আসিফ কুশল

মানুষটি খুব ছোটখাটো। কিন্তু তাঁর কাজ বিরাট এবং বিশাল। চোখে তাঁর ঝরে আলোর দ্যুতি। দ্রোহ তাঁর স্বভাবজাত। লড়ছেন মানুষের মুক্তির জন্য। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং ন্যায়ের পক্ষে তাঁর অবস্থান সবসময়। জীবন্ত এই কিংবদন্তীর নাম গোলাম আরিফ টিপু। তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে দিয়েছেন নেতৃত্ব। পেশায় ফৌজদারি আইনবিদ। তাঁর নেতৃতে¦ চলছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধীদের বিচার। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলী।

শুধু ভাষা আন্দোলনই নয়, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক গোলাম আরিফ টিপু। রয়েছে তেভাগা আন্দোলনেও ভূমিকা।তাঁর স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ভূমিকাও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযোগ্য।

গোলাম আরিফ টিপুর জন্ম ১৯৩১ সালের ২৮ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কমলাকান্তপুর গ্রামে। বাবা মৌলভী আফতাব উদ্দিন আহমেদ ও মা গুল আরজান নেসা।

স্কুলজীবন থেকে গোলাম আরিফ টিপু একজন স্বাধীনচেতা ও জনদরদী মানুষ হিসেবে পরিচিত। ইলা মিত্রের স্বামী রমেন মিত্র (হাবু মিত্র) ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তাঁর কাছ থেকে তিনি রাজনৈতিক দীক্ষা নেন। সেই সূত্রে ইলা মিত্রের সাথে তাঁর ছিলো পরিচয় এবং পরে রাজনৈতিক সম্পর্ক। ইলা মিত্র ছিলেন উত্তরবঙ্গের কৃষক আন্দোলনের নেত্রী। কৃষক অধিকার আদায়ে আন্দোলন করতে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতনেরও শিকার হন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত তেভাগা আন্দোলন সফল হয়। ইলা মিত্র ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। গোলাম আরিফ টিপু রমেন মিত্র ও ইলা মিত্রের সাহচর্যে বাম চিন্তাচেতনায় উজ্জীবিত হন। তবে এসব ছাপিয়ে পরবর্তীতে ভাষাসৈনিক হিসেবে তাঁর অবদান বড় হয়ে ওঠে। ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা।

গোলাম আরিফ টিপু অবিভক্ত ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার কালিয়াচকের কালিয়াচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। হাইস্কুলে পড়ার সময় বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ঘুরেছেন বিভিন্ন স্থান। তাঁর বাবা ছিলেন সাব রেজিস্ট্রার, ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার এবং সর্বশেষ অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর দাদা ছিলেন সালিশব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত।

গোলাম আরিফ টিপুচাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষ্ণগোবিন্দপুর হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯৪৮ সালে এসএসসি (ম্যাট্রিকুলেশন) পাশ করেন। রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে এইচএসসি (ইন্টারমিডিয়েট)এবং ১৯৫২ সালে  ¯œাতক পাশ করেন। এই ১৯৫২ সালেই তিনি রাজশাহী কলেজের ছাত্রনেতা হিসেবে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ওই বছর তিনি রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ইতিহাস এমএ শ্রেণী এবং এলএলবিতে ভর্তি হন।তবে রাজনৈতিক কারণে এখানে অধ্যয়ন অসমাপ্ত রাখতে বাধ্য হন। পরে রাজশাহীতে ফিরে গিয়ে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ইতিহাস ও এলএলবিতেভর্তি হন। ১৯৫৬-১৯৫৭ শিক্ষাবর্ষে তিনি এলএলবি পাশ করেন। তবে ইতিহাসের পাঠ আর শেষ হয় নি।





১৯৫২ সালে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে রাজশাহীতে আছড়ে পড়ে তার ঢেউ। ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র মিছিল বের হলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পর পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সালাম, বরকত, শফিক, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে। এই খবর রাজশাহীতে ছড়িয়ে পড়লে সৃষ্টি হয় তুমুল বিক্ষোভ। রাজশাহী কলেজের ছাত্রনেতা গোলাম আরিফ টিপু এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। রাজশাহী কলেজের ফুলার হোস্টেলে তাঁর কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সর্বদলীয়রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন (সংগ্রাম পরিষদ),রাজশাহী গঠিত হয়। তিনি এই সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হন। এসময় রাজশাহী কলেজে তাঁর নেতৃত্বে(দেশের প্রথম) শহিদ মিনার স্থাপন করা হয়। আর মিনারটি স্থাপনের রাতেই পাকিস্তানি প্রশাসন তা ভেঙে ফেলে।
১৯৪৮ সালে যখন ঢাকায় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ যেদিন ঘোষণা করেন-
ÔUrdu and urdu shall be the state language of PakistanÕ. সেই দিনের পর থেকে সৃষ্ট আন্দোলনে যুক্ত হন গোলাম আরিফ টিপু। গড়ে তোলেন আন্দোলন। রাজশাহীতে এই আন্দোলন ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।


১৯৫২ সালের জুলাইয়ে গোলাম আরিফ টিপু ঢাকায় আসার পর অবিসংবাদিত এবং অপরিহার্য একজন ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি গাজীউল হক, আবদুল মতিন, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রমুখের পাশাপাশি ভাষা আন্দোলন পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে ব্রতী হন। ১৯৫৪ সালে গোলাম আরিফ টিপু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন।১৯৫৭ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপে (মোজাফফর) যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল জেনারেল আইয়ুব খান। একবার আইয়ুব খান রাজশাহীতে গেলে তার গাড়িতে জুতা নিক্ষেপ করেন গোলাম আরিফ টিপু। এজন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য ১৯৫২ থেকে পাকিস্তানের পরবর্তী সময়টুকুতে তাঁকে এভাবেই কয়েক দফায় গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬২ সালে গোলাম আরিফ টিপু আইনপেশায় নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি ন্যাপ (মোজাফফর) থেকে কুঁড়েঘর প্রতীকে অংশ নেন।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি একজন কৃতি ফুটবলার হিসেবে পরিচিত। তিনি খেলেছেন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। আর এর আড়ালে করেছেন রাজনীতি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন আন্দোলনে। ১৯৭১ সালের সর্বদলীয় মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলন স্ট্যান্ডিং কমিটি রাজশাহীর সদস্য, উপদেষ্টা ও সংগঠক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি অন্যান্য ন্যাপ নেতাকর্মীদের মতো বাকশালে যোগ দেন। আশির দশকে নবগঠিত এন এ পি’তেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তবে তা মাত্র কিছুদিনের জন্য। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি সকল স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

গোলাম আরিফ টিপুর উল্লেখযোগ্য মামলার মধ্যে নিহার বানু হত্যা মামলা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। আন্দোলনে যুক্ত ছাত্রশিক্ষকদের পক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় তিনি বিনা পারিশ্রমিকে আইনী লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন।তিনি বিশুদ্ধ ইংরেজি এবং বাংলায় বক্তব্য তুলে ধরে বিচারকের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। শোনা যায়, তাঁর শুনানির বক্তব্য চলার সময়ে আশেপাশের লোকজন কাজকর্ম ফেলে, দোকানপাট বন্ধ করে দিয়ে আদালতে দেয়া তাঁর বক্তব্য শুনতে যেতেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে বন্দী হলে তাঁর পক্ষে আইনী লড়াইয়ে একক আইনজীবী হিসেবে ভূমিকা পালন ও সফলতার সাথে আইনী লড়াই করে শেখ হাসিনাকে মুক্ত করেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে দালাল আইনে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার সংগঠিত হচ্ছিলো, তার অনেকগুলিতেই গোলাম আরিফ টিপু দালালদের বিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে তিনি প্রধান কৌঁসুলী(চিফ প্রসিকিউটর) হিসেবে ২০১০ সালে যোগদান এবং এ পর্যন্ত ওই পদে কর্মরত ও ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের যথার্থ ভূমিকার কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লা, মুহম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ- এবং গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আব্দুল আলীম এবং বিদেশে পলাতক চৌধুরী মাঈনুদ্দিন, আশরাফুজ্জামান খান সাজাপ্রাপ্ত হন। আরও অনেক মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারাধীন রয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে এ সকল মামলা গোলাম আরিফ টিপু বনাম মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত।ট্রাইব্যুনালেযুদ্ধাপরাধীদের দ- প্রমাণে সরকারকে তিনি যুক্তি উপস্থাপন করে সাহায্য করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা তাঁর জীবনের একটি বড় অধ্যায়।

গোলাম আরিফ টিপু রাজশাহী বারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন দুইবার।প্রথমবার নির্বাচিত হন ১৯৮৭-১৯৮৮ সালে ও দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন ১৯৮৮-১৯৮৯ সালে। তিনি  বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের প্রবীণতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) আহ্বায়ক ছিলেন এবং পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট পর্যন্ত টিআইবির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি অসংখ্য স্থান থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ ইতিহাস ঐতিহ্য কেন্দ্র সম্মাননা স্মারক, ২০১৪/২০১৫, নবাব সিরাজউদ্দৌলা স্বর্ণপদক,  বিডি ফাউন্ডেশন, ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন স্মৃতি পরিষদ সম্মাননা পদক, ২০১৮, একুশের চেতনা পরিষদ শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা স্মারক, ২০১০ এবং ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তিতে একুশের চেতনা পরিষদের ক্রেস্ট, ২০১২, ভাসানী অনুসারী পরিষদের সম্মাননা ক্রেস্ট, ২০১৪, ঢাকাস্থ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতি সম্মাননা স্মারক, ২০১৩/২০১৪।

গোলাম আরিফ টিপু একজন গুণী আবৃত্তিকার। মেঘদূতসহ বহু কবিতার পঙ্ক্তিমালা তাঁর মুখস্থ। তাঁর বর্তমান আবাসস্থল ঢাকা।

গোলাম আরিফ টিপুর স্ত্রী জাহানারা বেগম লুই। তাঁর চার মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েরা হচ্ছেন ডালিয়া নাসরিন, কায়েমা আক্তার জাহান লাভলী, ডায়না নাজনীন, ডানা নাজলী। তাঁর একমাত্র ছেলে আরিফ ইফতেখার আহমেদ আশীষ ২০১৩ সালের ২৬ জুন ইন্তেকাল করেন।চার মেয়ের তিনজন সপরিবারে ঢাকায় এবং একজন লন্ডনে অবস্থান করছেন।

এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা ও বর্তমানের বর্ষীয়ান এই আইনজীবীর দীর্ঘায়ূ কামনা করছি। নিশ্চয় তাঁর দ্রোহী জীবন নতুন প্রজন্মকে পথ নির্দেশনা দেবে।





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট