আল মাহমুদ বেঁচে থাকবেন চিরকাল
বাসার তাসাউফ
একটা সময় ছিল, যখন কবি শামসুর রাহমানের সাথে কবি আল মাহমুদের প্রতিযোগিতা হতো। অবশ্য সেটা শুধু পাঠক মহলে। কারো মতে, আল মাহমুদ প্রধান কবি, কারো মতে আবার শামসুর রাহমান। অবশ্য এ কথাটি অনস্বীকার্য যে দু-জনেই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান মৌলিক কবি ছিলেন। তবে শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর কাব্য-বোদ্ধামহলে বহুদিন ধরে আল মাহমুদের নাম পয়লা নম্বরেই উচ্চারিত হয়ে আসছিল। ‘লোক লোকান্তর’ ‘সোনালী কাবিন’ ‘কালের কলস’ ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ তাঁকে সেই আসন দিয়েছে। এসব কাব্যে তিনি লোকজ, গ্রামীণ পটভভূমি এবং ভাবাত্মক রূপাত্মক শব্দ প্রয়োগ ও কল্পনিক বিষয়বস্তুতে যে উপমা প্রয়োগ করেছেন তা সত্যিই অসাধারণ।
কবিতায় আবেগ ও আতিশয্য থাকা প্রয়োজন আছে। কিন্তু আবেগ ও আতিশয্য অবদমিত হলে অনেকাংশে কাব্যরস হ্রাস পায়। আবার আবেগের বাহুল্য কবিতাকে মেদবহুল করে তোলে। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, ‘ঢ়ড়বঃৎু রং বসড়ঃরড়হ ৎবপড়ষষবপঃবফ রহ ঃৎধহয়ঁরষরঃু. বাংলা কবিতায় আজকাল বেশ আবেগ থাকতে দেখা গেলেও ঞৎধহয়ঁরষরঃু দেখা যায় না। আল মাহমুদের কবিতায় আবেগ যেমন আছে, তেমনি ঞৎধহয়ঁরষরঃু আছে। তাঁর এই বহুমাত্রিক কাব্য নির্মাণকৌশল শুধু কাব্যই সৃষ্টি করে নাÑ তিনি আমাদের এক ধরনের গন্ধ ও অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। আমরা রসনা ও স্বাদ পেয়েছি কবিতাগুলো পড়ে।
অনেকে আজকাল আধুনিকতার দোহাই দিয়ে দুর্বোধ্য কাব্য রচনা করে নিজেকে মস্ত বড় কবি হিসেবে জাহির করতে চায়। দেখা যায় সেই কবির কবিতার ভেতরে পাঠকের প্রবেশের রাস্তা একেবারে রুদ্ধ। তাই পাঠকও সেই সব কবিতায় প্রবেশের রাস্তা না পেয়ে ফিরে যায় অন্য কোনো সহজবোধ্য কাব্য-দরোজায়। ফলে সেই কবিগণ হারিয়ে যান আড়ালে-আবডালে। আল মাহমুদ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন। তাই বলে যে তিনি খুব সহজ ভাষায় কবিতা লিখতে তা কিন্তু নয়। তাঁর কবিতার মূলে রয়েছে ফুল, পাখি, নদী চাঁদ, ঝর্ণা ও প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং রমণীর রূপলাবণ্যম-িত শরীর, বক্ষ, কেশ, আঁখি, মুখবয়ব। তাঁর ভাবুক মনকে নাড়া দিয়ে কবিতা লিখিয়েছে অনেক রমণী। নারীকে, নারীর অঙ্গসৌষ্ঠবকে তিনি গহরফলক, উষ্ণ কালসাপ, নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ, চরের মাটির মতো শরীরের ভাজ, ত্রিকোন কর্দম, গুঢ় রাত, ত্রিকোন মৃন্ময়ী ইত্যাদি উপমায় সুশোভিত করেছেন। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, তার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো প্রেম ও নারী। তবে নারী ও সৌন্দর্যকে তিনি আলাদা করে দেখতে চেয়েছেন। একজন নারী একজনের কাছে সুন্দর হলেও অন্যের কাছে তা না-ও হতে পারে। তাই আল মাহমুদ নারীকে সুন্দর না বলে আকর্ষণীয় বলেছেন। তার অর্থ হলো, নারী তাঁকে আকর্ষণ করেছে, নারীর মধ্যে যে আকর্ষণ করার শক্তি আছে- আল মাহমুদ তা অবলোকন করেছেন বলেই নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্খা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। তিনি লিখেছেনÑ
‘বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না
তুমি যদি খাও তবে আমাকে দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।’
আবার তিনি লিখেছেনÑ
‘আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল
এর ব্যতিক্রমে বানু এ-মস্তকে নামুক লানৎ
ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।’
এ ব্যাপারে অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেছেন, ‘তিনি বোদলেয়ারের অনুরাগী। কিন্তু মাটি তাঁর কাছে সেই নারী যে জলসিক্ত সুখদ লজ্জায় নিজেকে উদাম করে। তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার। অভাবের অজগর তার টোটেম। যে কিসিমে শিষ্ট ঢেউয়ের পাল রাতের নদীতে ভাসা পানকৌড়ী পাখির ছতরে ছলছল ভাঙে সে কিসিমেই তিনি তার বানুর গতরে চুমো ঢালেন।’ (একজন খাঁটি কবি, উপমা, পৃ. ২৫)। আল মাহমুদ মানব মনের একটি অদৃশ্য ও আদিমতম কামনার জোয়ারকে বিন্দুমাত্র বাঁধা না দিয়ে তার প্রবাহমানতাকে আরো স্বচ্ছন্দ রূপ দিয়েছেন। কাব্যে শব্দ প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে আদিমতাকে অপূর্বভাবে চিত্রায়ন করে আদি ও অন্ত পর্যন্ত চিরন্তন রোমান্টিক ধারাকে বর্ণনা করেছেন:
‘তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশী ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ।’
(সনেট ১০ )
তিনি আরও লিখেছেন,
‘সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি
আত্মবিক্রয়ের স্বর্র্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।’
তাঁর ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যের এসব সনেটে উপমা আর রূপকে নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙ্খা ও কামনার চিত্র ফুটে উঠেছে।
কবিতা কী? কথিত আছে, ‘বাল্মীকির ক্রোঞ্চমিথুন বিয়োগজনিত শোকই ‘শ্লোক’ রূপে উৎসারিত হয়েছিল।’ কেউ কেউ মনে করেন, কবিতার জন্মজঠর হচ্ছে কল্পনা ও সাধনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বলেই ফেলেছেন, ‘কবিতা কল্পনা-লতা। সাধনার ধন।’ ইংরেজ কবি কিটস্-শেলি-মিল্টন তাদের প্রেয়সির বিরহে লিখেছেন অনেক কবিতা। নজরুলও লিখেছেন। কালিদাস ‘মেঘদূত’ লিখেছিলেন প্রিয়াবিরহের বেদনা থেকে। তাহলে কি বিরহী-বিলাপ শব্দের, বাক্যে অন্ত্যমিলে প্রকাশিত হলেই তাকে কবিতা বলে? আল মাহমুদ কবিতার পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে, ‘কবিতা কী?
কবিতা তো শৈশব স্মৃতি
কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
ম্লানমুখ বউটির দড়িছেঁড়া হারানো বাছুর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার...।’
(কবিতা এমন)
গ্রামের বাড়িতে খুব ভোরে মাটির ঘরের কোণের খোঁয়াড়ে মোরগুলো যখন ডেকে উঠতোÑ তখন তুষ পোড়া ছাই দিয়ে দাঁত মেজে পুকুরের ঠা-া জলে অযু করে কায়দাটি হাতে মক্তবে যেত এক মেয়ে। সবুজ ও কচি দূর্বাঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরের জলে নগ্ন পা ভিজিয়ে মক্তবের দিকে হেঁটে মক্তবে যাওয়া সাধারণ মেয়েটির নাম আয়েশা আক্তার। কবি আল মাহমুদ মক্তবে যাওয়া চুলখোলা আয়েশা আক্তারের কথা যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা আমাদের মুগ্ধ করে।
আল মাহমুদ শুধু কবিতাই লিখেন নি। গল্প লিখেছেন, লিখেছেন উপন্যাস ও আত্মজীবনী। তিনি কবিতায় যেমন সাবলীল, গদ্যেও তেমন। বেশ র্ঝঝরে তাঁর গদ্যের ভাষাশৈলী। পড়তে গেলে ঠোঁটের আরাম হয়। পাঠক হয় মোহগ্রস্ত। তাঁর বিখ্যাত সোনালী কাবিনসহ অন্যান্য গ্রন্থে তিনি সময়ও সমকালকে ইতিহাসের নিক্তিতে মাপতে চেয়েছেন। তুলে ধরতে চেয়েছেন সময়ের ইতিহাসকে। তাঁর কবিতা পড়লে আমাদের মনে ধারণা জাগে, আমাদের অতীত কেমন ছিল আর কী আছে ভবিতব্য। সময় নিয়ে এত যিনি সচকিত; সেই সময়-ই তাঁকে কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছে? তিনি একটি গদ্যে লিখেছিলেন, ‘আমি লেখক হওয়ার, কবি হওয়ার মোহে দৃঢ় বাসনা পোষণ করতাম, আর লোকে তো এখন আমাকে কবিই বলে। ... আমি কবিতা লিখেছি, গল্প-উপন্যাসও লিখেছি। সব মিলিয়ে সমালোচকেরা একদিন আমার বিচার করবে। আশা করি আমি সুবিচার পাব।’
আল মাহমুদ এখন অস্ত যাওয়া দিবাকর। সব আলোচনা ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে গিয়ে অন্যভুবনে বাস করছেন। তাঁর বসবাসের ঘরের চারপাশে এখন নিশির ঝিঁঝিরা গুঞ্জন করে। আর আমরা গাই তার স্তুতি। হয়তো গেয়ে যাব আরও কিছু দিন কিংবা ভুলে যাব অচিরেই। কিন্তু তাঁর কাব্য, গল্প আমাদের গুঞ্জরিত করে যাবে বহুদিন, বহু যুগ, হয়তো যুগ-যুগান্তরেও। কারণ তিনি লোকান্তরে হলেও পাঠকের অন্তরে আছেন।