শিশু মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্যে
আল মাহমুদ’র ছড়া
হামীম রায়হান
‘সূদুর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য (ছড়া) যারা আউড়িয়েছেন এবং যারা শুনেছে, তারা অথেও অতীত রস পেয়েছে। ছন্দতে, ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মধ্যে। সেইজন্য অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর (ছড়া) আয়ু বেড়ে চলেছে।’
কথাগুলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এ উক্তির মাধ্যমে সহজেই বুঝা যায় বাংলা সাহিত্যে ছড়ার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। আজ লিখতে বসেছি ছড়া নিয়ে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের ছড়া নিয়ে আলোচনা করব। তাঁর ছড়া প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা একটু জেনে নিই ছড়া বিষয়টি নিয়ে।
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীনতম শাখা ছড়া। মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ছন্দময় এক সৃষ্টি ছড়া। প্রায় দেড় হাজার বছরের তদুর্ধ ইতিহাস রয়েছে ছড়ার। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের প্রথম পদেই ছড়ার অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়। সাহিত্যের বিবর্তন ধারায় ছড়ার ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন। আদিতে সাহিত্য রচিত হতো মানুষের মুখে মুখে আর লেখ্য রূপে সাহিত্য আসার পূর্বে ছড়ায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করত।
শিশুসাহিত্যের একটি অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ছড়া। শিশুরা যেমন চঞ্চল, তালে তালে খেলতে পছন্দ করে ঠিক তেমনি ছড়ার চলনও চঞ্চল, তালে তালে। ১৮৯৯ সালে লৌকিক ছড়াকে প্রথম গ্রন্থভূক্তি করেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার ‘খুকুমণির ছড়া’ নামে।
এবার আসা যাক, আল মাহমুদের ছড়া প্রসঙ্গে। তাঁর পুরো নাম মীর শুকুর আল মাহমুদ। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে তিনি যেমন এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছেন তেমনি ছড়া রচনায়ও তাঁর দক্ষতা পরিচয় পাই। তাঁর আলোর ঝলকানিতে সমৃদ্ধ হয়ে আমাদের ছড়া সাহিত্য তথা শিশুসাহিত্য। ছড়া সৃষ্টির যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভাষাগত সারল্য, বিষয় বৈচিত্র্য, কল্পনা, রূপকথা, উদ্দীপনা ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের সাদা চোখে সহজেই ধরা পড়ে আল মাহমুদের ছড়ায়। তিনি যখন শিশুদের জন্য ছড়া লিখতে বসেছেন, তখন ঠিক শিশুদের মতনই ভাবনা ও কল্পনার জগৎকে সামনে এনেই ছড়া সৃষ্টি করেছেন। তাই তো তাঁর ছড়ায় উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে শিশু মনস্তত্ত্বের বিভিন্ন অনুষঙ্গ। শুধু তাই নয়, তিনি ছড়ায় ছড়ায় শিশুদের মনে জাগাতে চেয়ে প্রকৃতিপ্রেম, দেশপ্রেম ও প্রতিবাদী চেতনা। তাঁর ছড়ার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো আঞ্চলিক শব্দের সার্থক ব্যবহার।
মানুষের জীবনে সবচেয়ে সুন্দরতম সময় তার শৈশবকাল। শৈশবের অনিন্দ্য সুন্দর স্মৃতিগুলো মানুষকে সারাজীবন নাড়া দেয়। শৈশবের এ সময়ে কেবলি ইচ্ছে করে পাখির মত ডানা মেলে উড়তে। পড়াশুনা বাদ দিয়ে কেবলি ডাক দেয় গ্রামের মেটো পথ। ঠিক এমনি ভাবনা থেকে কবি আল মাহমুদ রচনা করেন ‘পাখির মত’ ছড়াটি। তিনি লিখেন-
‘আম্মা বলেন, পড়রে সোনা,
আব্বা বলেন, মন দে,
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মত ডাকতে।
********
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো
পাখির মত বন্য।
এ যেন শৈশবের প্রতিটা শিশুর মনের চিন্তা। তাঁর ভাইয়ের ছোটে ছড়াটি এমন-
অঙ্ক নিয়ে বসলে আমার কখন কী যে হয়,
টেবিলটাও পর হয়ে যায়, বইগুলো সব ভয়।
ভয়ের ছোটে ভাবতে থাকি শহর ভেঙ্গে কেউ,
দালানকোঠা বিছিয়ে দিয়ে তোলে খেতের ঢেউ।
রাস্তাগুলো নদী এবং গলিরা সব খাল,
ইলেকট্রিকের খাম্বাগুলো পাল্টে হলো তাল।
মোটরগাড়ি গরুর পালে হাম্বা তুলে হাঁটে,
পুলিশগুলো গুলিস্তানে নিড়ানি ঘাস কাটে।
শিশুদের ভাবনাকে তিনি নিয়ে গেছেন বাংলার শ্বাশ্বত বাংলার রূপে। নিড়ানি, ঘাস, গরুর পাল, তাল, নদী, খাল এসব যে আবহমান বাংলার অনুষঙ্গ। ঠিক তেমনি তাঁর আরেকটি ছড়া ’নোলক’। গ্রামের মহিলারা তখনকার দিনে নাকে নোলক পড়তেন। এখন হয়ত তা পাওয়াই যাবে না। এমনি এক ঐতিহ্যের সাথে তিনি শিশুদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি ছড়ার মাধ্যমে। মায়ের নোলকই যেন সারা বাংলা।
‘আমার মায়ের সোনার নোলক হরিয়ে গেল শেষে,
হেথায় খুঁজি, হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
তিনি এভাবেই শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেন বাংলার নদী, খাল, হরিণ, বোয়াল, তিতাস নদী, টিয়ে ইত্যাদির সাথে।
তাঁর ভর দুপুরে ছড়াটি এক মায়ের মুখের জবানিতে রচিত। মা তাঁর সন্তানকে ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এ যেন সেই খনার বচন-
ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দিবো কিসে!
‘ভর দুপুরে’ ছড়ার শেষ চার লাইনে তিনি বলেন,
কোথায় নাকি শালুক পাতার চাদরে,
জলপিপিরা ঘুমায় মহা আদরে।
শাপলা ফুলের শীতল সবুজ পালিশে,
থাকবে খোকন ঘুমিয়ে ফুলের বালিশে।
আজকালকার বাবা মারা শুধু চান তাদের সন্তানেরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হোক। তাই তাকে বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানানোর জন্যে তার কাঁধে তুলে দেয় গাঁদা গাঁদা বই। সে মানুষ হয় ঠিকই কিন্তু তার মাঝে মনুষ্যত্ববোধ জন্মায় না। সে হয় রোবটের মত। আল মাহমুদ তাঁর ‘হায়রে মানুষ’ ছড়ায় লিখেছেন-
একটু ছিলো বয়স যখন
ছোট্ট ছিলাম আমি,
আমার কাছে খেলায় ছিলো
কাজের চেয়ে দামি।
*******
তারপরে যে কী হলো,
এক দৈত্য এসে কবে,
পাখনা দু’টো ভেঙ্গে বলে,
মানুষ হতে হবে।
মানুষ হওয়ার জন্য কত
পার হয়েছি সিঁড়ি,
গাধার মত বই গিলেছি
স্বাদ যে বিচ্ছিরি।
তিনি বাংলার প্রকৃতি ও বর্তমান অবস্থাকে শিশুদের কাছে তুলে ধরেছেন, ঠিক তেমনি বাংলার ইতিহাস, সংগ্রাম ও ঐতিহ্যকে ছন্দে, ছন্দে ছড়ার মাধ্যমে শিশুদের সামনে তুলে ধরেছেন। তাই তো তাঁর ছড়ায় বেজে উঠে-
‘ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
ট্রাকের মুখে আগুন দিতে
মতিয়ুরকে ডাক।
(ঊনসত্তরের ছড়া-১)
আবার তিনি ভাষা শহীদের স্মরণে রচনা করেন ‘একুশের ছড়া’ ছড়াটি। এ ছড়ায় যেমন এসেছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, তেমনি এসেছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহা নায়ক তিতুমীরের কথা। আছে ক্ষুদিরামের কথা।
‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত,
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতেরি রক্ত।
******
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা,
বিষাদগীতি গায়ছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে নাকি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে।
এভাবেই আল মাহমুদ তাঁর ছড়ায় ফুটিয়ে তুলেছেন শিশু মনের বিভিন্ন চাওয়া পাওয়া। সাথে সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন বাংলা প্রকৃতির সাথে। এঁকেছেন বাংলার সংগ্রামি জীবনের চিত্র। আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তেমনি তিনি সেই ছড়াকার, যাঁর ছড়ায় এসেছে শিশু মনের ভাবনা, দেশপ্রেম, ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক চমৎকার মেলবন্ধন। শিশুসাহিত্যে তাঁর এই অমূল্য সৃষ্টিগুলো তাঁকে শিশুদের কাছে প্রিয় করে রাখবে শ্বাশ্বতকাল।