ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ১৬






[গত সংখ্যার পর]
৩.৫.১৯৯০
বাবাকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম। বাবা নিতে চায় না। বাবা বলে, আমি একা মানুষ। টাকা দিয়ে আমি কী করব? বরঞ্চ তুমি নগরে ভালো থেকো। নগরে কত খরচ। সারাদেশে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার জের চলছে। বাবার মন ভেঙে গেছে। একাত্তরে যে দেশ ও মানুষের জন্য বুক পেতে দিতে দ্বিধা করেনি। সেই মানুষ ক্যামন হায়েনার মতো আচরণ করছে। গভীরতম অসুখ নিয়ে বাবা বেঁচে আছেন। প্রতিনিয়ত শঙ্কিত থাকেন অন্ধকারে কারা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কলেজ ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। কলেজ থেকে বের হতেই দেখি দীপু ভাই ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন ।
‘দেবী হেরা, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘কেন?’
‘ফুটপাতের ওই দোকানে বসে এক কাপ চা খেতে খেতে বলি।’
‘চলুন।’
চায়ের অর্ডার দিয়ে দীপু ভাই বলেন, ‘ঈশ্বর জানেন, আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।’
‘কেন বিশ্বাসে ঘাটতি হয়েছে বলে মনে হয় না।’
‘না না ভুল বুঝবে না আমার একটি স্কলারশিপ হয়েছে। সুইডেনে। হিউম্যান রাইটস-এর ওপর। দু’বছরের কোর্স।’
‘আনন্দের সংবাদ। বেবী আপা কি জানেন?’
‘জানাতে পারছি না। আসমাকেও না।’
‘বেবী আপা খুশি হবেন। মাসীমা-আসমা দিদিও।’
চায়ে চুমুক দিয়ে দীপু ভাই সিগারেট ধরালেন।
‘আসমা মায়ের কী হবে? আপনাকে প্রথম বললাম।’
‘অসুবিধা নেই। আপনি আমার লোকাল গার্জিয়ান ছিলেন। এখন আমি আপনার।
‘কী যে বলেন। আপনি হলেন গিয়ে অবিসংবাদিত নারী। দেশজুড়ে আপনার অজস্র ফ্যান তৈরি হয়েছে। আমিও তার মধ্যে একজন।’
‘দীপু ভাই ওভাবে বলবেন না। আমি বিলাপ করে কাঁদব।’
‘কাঁদুন। আপনাকে কাঁদতে দেখলে জগৎ কেঁদে উঠবে।’
চা খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই দীপু ভাই ছেলেমানুষির মতো বলে ওঠেন, ‘আমার কী হবে?’
‘কিছুই হবে না। বেবী আপাকে আমি বলব। মাসীমা-আসমা দিদিকে আপনি বলবেন।’
‘বলব।’
‘সমস্যা কোথায়।’
‘মা-আসমা?’
‘যার কেউ নেই তার ঈশ্বর আছেন। চার বছর বয়সে আমি মাতৃহারা। মা’র সান্নিধ্য পাইনি। ওই যে বললাম, আমি আপনার গার্জিয়ান।’



দীপু ভাই জলদ কণ্ঠে বলেন, ‘দেবী আমাকে বাঁচালেন। আপনার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে।’
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দীপু ভাই রিকশায় উঠে বসলেন।
‘চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।’

দীপু ভাই চলে যাবেন ছাব্বিশ মে। বেবী আপা তার চলে যাওয়া উপলক্ষে অফিসের সবাইকে মিষ্টিমুখ করালেন।
শুধু আমাকে বললেন, ‘ওর মা-বোনের দায়িত্ব তুমি পালন করবে।’
আমি বলি, ‘আমি পারব?’
‘পারবে। সংসার রাষ্ট্রের মতো। চালিয়ে নিতে হয়।’
আর মিতালী দিদির কী উচ্ছ্বাস।
‘দেবতা তো চলে যাচ্ছে। দেবীর কী হবে রে, উর্মি?’
শিমু দিদি বলেন, ‘তোকে খুব বেদনার্ত লাগছে। লাগবেই তো।’
নাজনীন আপা বলেন, ‘জীবন যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’
মঞ্জু ভাই বলেন, ‘উর্মিলা হলো গিয়ে আমাদের সম্মান। আমি ওর সঙ্গে কাজ করি, তাতেই আমার সম্মান।’
জাকির সাহেব বলেন, ‘জগতের সব মানুষ এক রকম না। দু’একজন ভিন্ন হয়। উর্মিলা কন্যা-জায়া-জননী।’
মিতালী দিদি কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন, ‘ছাগলটারে মানুষ করার জন্য তোকে ধন্যবাদ।’
আমি প্রচ- লজ্জার মধ্য দিয়ে অনুভব করি শিমু দিদি আমার চুলে বিলি কাটছেন।
এ সময় বেবী আপা করিডরে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘উর্মি, অফিস পুলিশ রেড হতে পারে। ভয় করো না। ২রা জুন পল্টনে সর্বদলীয় সমাবেশ আছে। তুমি থাকবে।’
‘জি আপা।’
‘দীপুর জন্মান্ধ বোন আসমার দিকে চোখ রেখো। দীপু অনেক মহৎ ছেলে। আমার ছেলেটি দেশে ফিরবে না। স্কটিশ একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। ওর থিসিস পার্টনার। দেশের প্রতি মমতা কম। ওর বাবার মতো হয়নি। ওর বাবার জন্য এই আমি আছি।’
বেবী আপার কণ্ঠ ভারি হয়ে এল।
আমি বললাম, ‘জগৎ-সংসার অত্যন্ত কঠিন জায়গা। শুধু প্রেম দিয়ে হয় না, আঘাতও পেতে হয়। আমি আমৃত্যু পথ হাঁটব।’
‘আমি বিশ্বাস করি।’
‘ধন্যবাদ, আপা।’
দীপু ভাই সুইডেন চলে যাবার আগের রাত দশটার দিকে বাসায় এলেন। শমসের চাচা দীপু ভাইকে নিচে বসিয়ে রেখে খবর দিয়ে যায়।
রুবী বলে, ‘দীপু ভাই এখানে আসুক।’
আমি বলি, ‘না।’



সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলি।
‘দীপু ভাই। এত রাতে।’
দীপু ভাই কথা বলেন না।
আমার আত্মা দুরু দুরু করতে থাকে। ঊনিশের তরুণী উর্মিলার হৃদয়ে ঝড়ের বাতাস বইতে থাকে। মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।
‘দেবী, আপনার মতো নারীর সঙ্গে ইতিপূর্বে দেখা হয়নি। যে আমাকে মনে রাখবে।’
দীপু ভাই আমার হাত ধরেন। আমি কিছু বলি না। মনে হয় নদীর মোহনায় আমি একা নই।
হাতের তালু তার ঠোঁট স্পর্শ করে।
‘তৃষ্ণায় আমার বুক খাক হয়ে আছে। আপনি আমাকে করুণা করুন।’
আমি দীপু ভাইয়ের হাত চেপে ধরি। অনন্ত তৃষ্ণার দাহ আমাকে কষ্ট দিতে থাকে।
‘করুণা বলবেন না। তাপিত হৃদয় আপনার জন্য প্রতীক্ষা করবে।’
আকস্মিক দীপু ভাই আমার ঠোঁটে গাঢ় চুম্বন এঁকে গেট পেরিয়ে অন্ধকারে মিশে  গেলেন। আমি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি।

৫.৮.১৯০

রুবীর বিয়ে হয়েছে তিন দিন আগে। বর গ্রাসরুট কমিনিউকেশনের কর্মী। রুটস লেবেল গণস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে। সুদর্শন তরুণ যুবা। উভয়ের পছন্দের বিয়ে। রুবীর খুব নায়িকা হওয়ার সখ ছিল। নায়িকা হয়নি। নায়ক পেয়েছে।
রুবী ওর পছন্দের কথা কখনও বলেনি। মিতালী দিদিকে বলেছে। ব্যস। আর যায় কোথায়। ঘটকের ভূমিকায় মিতালী দিদি এতটা পারঙ্গম যে বেবী আপা পর্যন্ত অবাক! বরের বাড়ি কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুর। শিক্ষিত পরিবার। ঢাকার শুক্রাবাদে ভাড়া বাসায় থাকে। বরের পিছুটান বলতে বৃদ্ধ বাবা, যিনি গ্রামের বাড়িতে থাকেন। বিয়ে উপলক্ষে রুবীকে পনের দিনের ছুটি দিয়েছে অফিস। বেবী আপা রুবীর বাবার হাতে তুলে দিয়েছে পঞ্চাশ হাজার টাকা।
বিয়ের জন্য রুবী যখন ধোবাউড়া চলে যায়। তার আগের রাতে রুবী বলে, ‘উর্মি, তুমি খুশি হওনি?’
আমি বলি, ‘খুশি না হওয়ার তো কোনো কারণ দেখছি না।’
‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
‘কেন।’




‘এই জীবনে আর তোর সঙ্গে এভাবে রাত কাটাব না।’ বলেও হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
আমি ওকে সান্ত¡না দিয়ে বলি, ‘কেঁদে তুই আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস। সব মেয়ের স্বামীর ঘরে চলে যেতে হয়। নারীজন্ম ইহাই।’
‘উর্মি, আমি কি ভুল করলাম?’
‘ভুল করবি কেন? তোর বরকে অফিসের সবাই দেখেছে। শিমু দিদি তো তোকে হিংসে করতে শুরু করেছেন। বলে, ‘রুবীই ভালো, জ্যাকি শ্রফ-এর মতো বর পেল। ও রকম সুদর্শন নাগর কত জনের কপালে জোটে?’
‘শিমু আপা তাই বলেছে!’
‘শুধু জাকির সাহেবকে দেখলাম ম্লান। তোর বাবাকে টাকা দেওয়া নিয়ে তার মধ্যে অসন্তুষ্টি ছিল। বেবী আপার এক ধমকে চুপসে গেছে।’
‘ওই হারামি বেটার গা জ্বলে ক্যানে। ওর বাবার টাকা?’
‘ওভাবে বলিস না।’
‘বলবই। লুচ্চা বেটা।’ ওর চোখে ক্ষোভ ভেসে ওঠে। রুবী ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় এমনভাবে বলে যে আমার বুক ফেটে হাসি আসে।
‘উর্মি অফিস থেকে কেউ যাবে না ধোবাউড়ায়?
‘মঞ্জু সাহেব যাবে। বেবী আপা, আমি, সীমু দিদি চট্টগ্রামে যাব। নারী সমাবেশ আছে।’
‘তুমি বিয়েতে আসলে আমার কোনো দুঃখ থাকত না। না। আমাদের এলাকার অনেকেই তোকে চেনে।’
‘চিন্তা করিস না। বর নিয়ে সুখে থাকো। ঢাকার বাসায় যাব।’
পরদিন রুবী ধোবাউড়ায় চলে যায়। নাখালপাড়ার নারীমুক্তি কেন্দ্রে আমি আজ একাকী। শমসের চাচা দিনরাত আমার খোঁজ নিতে থাকে। শমসের চাচার ধারণা আমি একা ভয় পাব।
‘মা-জননী, ভয় পাবেন না। আমি আপনার দরজার কাছে বিছানা করে থাকব।’
‘না না আপনার তা করতে হবে না। আমি একাই থাকতে পারব।’
‘বেবী জননীর আদেশ। আমি তো আপনাকে একা থাকতে দিতে পারি না।’
রুবী চলে যাবার দু’দিনের মাথায় চামেলী আপা এলেন নেত্রকোনা মোহনগঞ্জ থেকে। চামেলী আপা বিএ পাস। স্বামী পরিত্যক্তা। বয়স সাতাশ-আটাশ। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয়নি। বেবী আপার সঙ্গে মোহনগঞ্জ এক মহিলা সমাবেশে পরিচয়। তার তেজোদীপ্ত বক্তৃতা শুনে তার পছন্দ হয়েছে। ঠিক এ জন্য চামেলী আপার নারীমুক্তি কেন্দ্রে আগমন। ওই তো রুবীর বিছানায় নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। চামেলী আপা একটু মোটা মহিলা। ঘুমালেই নাক ডাকে। যা আমার  প্রাথমিক অপছন্দ।
চামেলী আপা আমার সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে এখনও জানা যায়নি।
তিনি বলেন, ‘বইনরে আমি এসব পারতাম?’
[চলবে]






শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট