শব্দমিছিল : মাহাবুবা লাভীন





শব্দমিছিল
মাহাবুবা লাভীন

মায়ের স্বস্তি

বৃষ্টি নামুক, অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামুক
পথ ঘাট মাঠ ভিজে যাক,
সব নদী নালা ডোবা ভরে যাক,
এবার উপচে যাক রহিম আলীর বড় পুকুরটা,
সবগুলো মাছ উপচে গিয়ে ছুটে বেড়াক দ্বীগবিদিগ।
ভারী বর্ষণে আগাম বন্যা নামুক,
যেদিকে মন চায় নদীর ¯্রােত স্বাধীনভাবে ছুটে যাক,
পারলে আসমানীদের ঘরটাও ভাসিয়ে নিয়ে যাক।
নদীপাড়ের শেষ চিহ্নটুকু মুছে দিয়ে নদী এবার পুরো গ্রাম জুড়ে বিস্তৃত হোক,
সারারাত খোলা আকাশের নিচে কাটুক হাজার হাজার মানুষের,
আশ্রয়কেন্দ্রগুলো মানুষে মানুষে গিজ গিজ করুক।
এত বর্ষণ হোক-সবগুলো জঞ্জাল ভেসে যাক
ভেসে যাক,
সেদিনে পত্রিকায় বেরুনো নর্দমায় ভেসে থাকা পিতৃপরিচয়হীন ভ্রুণ।
সারাদিন ঝুম বৃষ্টি হোক
ধোয়ার মত বৃষ্টি হোক,
চারদিক অন্ধকার হোক, যেন কিচ্ছু দেখা না যায়
প্রেমিক যুগোল ভিজে চুপসে যাক,
ভেঁজা কাপড়ে শরীর থরথর কেঁপে উঠুক
ভেঁজা ঠোঁটের আস্বাদেই কেঁটে যাক প্রেমিকের সারাদিন।
বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি হোক
টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে মলিন হয়ে যাক- একটানা খেতে না পারা শিশুটির চিৎকার।
একটানা বৃষ্টিতে সদ্য ডিম ফুটে বেরুনো শালিক পাখির বাচ্চা দু’টো খাবার না পেয়ে চিউ চিউ করে কাঁদতে থাকুক।
একটানা বৃষ্টিতে বাড়ির একমাত্র রোজগার করা মানুষটা চিৎকার করে বলতে থাকুক ‘না খেয়ে মরুক সবকটা, তবু এ বৃষ্টিতে কাজে যেতে পারব না।’
বৃষ্টির ঝাপটায় সবফুলের গায়ে আঁচড় লেগে ছিড়ে ছিড়ে মাটিতে পড়ে থাক
তারপর বৃষ্টিতে ধুয়ে যাক ওদের শরীরের গন্ধ।
বাজারে ছাতার দাম বেড়ে যাক,
সারাবছর রেইনকোর্ট বিক্রির যে দোকানটার ঝাপে বড় তালা ঝুলছিল
তার সামনে আজ লম্বা লাইন দাঁড়িয়ে যাক,
বেড়ে যাক প্লাস্টিক চপ্পলের দাম,
শাক সবজি সহ সকল পণ্যের গায়ে বাড়তি দাম যোগ হোক।
এই একটানা বর্ষণে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়–ক,
পত্রিকার পাতায় বড় বড় করে লেখা হোক ‘শতাব্দীর সেরা ভারী বর্ষণ, জনজীবন স্থবির’
পত্রিকার পাতা খুলে চোখ কপালে উঠুক 
কপালে হাজারটা ভাঁজ তুলে শিক্ষাবিদরা বলে উঠুক, ‘না, না এই ভারী বর্ষণে ছেলেমেয়েগুলো স্কুলে যেতে পারবে না, কিছুতেই না।’
এরপর একটানা বর্ষণে অনির্দিষ্ট কালের জন্য দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে দেয়া হোক।
এবার অন্তত এই বৃষ্টিতে মায়ের মুখে হাসি ফুটুক
মা উল্লাসে বলে উঠুক
‘না খেয়ে মরি তাতে কি! সড়কে মৃত্যুর মিছিলে আমার সন্তানকে যেতে হলো না, এই আমার স্বস্তি।’





বৃত্ত

সবগুলো মুখ এখন বৃত্তাকার ফ্রেমবন্দি
তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই,
নেই কোন অনুযোগও,
তবে দু একটা ঘাম ঝরানো স্মৃতি আমাকে
তাড়া করে-
এটাই আমার কষ্টের কারণ!
বৃত্ত দেখলেই আমি ভয়ে কুকড়ে যাই
সেই ছোট্টবেলায় খেলাচ্ছলে পড়ে গিয়েছিলাম কুপের ভেতর
চারদিকে গভীর ঘন অন্ধকার! কেউ শুনছে না চিৎকার!
কতবার মা মা বলে ডেকেছি, কোথাও কেউ নেই,
কেবলি যেন আমাকে আমি ডাকছি
বুকে যেটুকু আলো ছিল তাও কেমন বৃত্তের ভিতরে বন্দি-ছড়াবার কোন পথ নেই।
সেই থেকে বৃত্তকে আমার এত ভয়!
বৃত্ত দেখলেই মনে হয়- সব রাস্তা বন্ধ,
কেবলি একটি বিন্দুতে শেষ-
যেন এক শূন্য গহ্বর।
যেন একটা কেন্দ্রের দিকে ছুটে যাচ্ছি আমি,
আর ওরাও-যারা বন্দি বৃত্তাকার ফ্রেমে।
কেন্দ্র মানে-
সেখানে ধনাত্বক আর ঋণাত্বক চার্জের মান সমান, মানে নিরপেক্ষতা।
বৃত্ত মানেই তাই আমার কাছে কেমন গা শিউরে ওঠা এক অনুভব,এক শূন্যতা!



দূরত্ব

প্রতিনিয়ত দূরত্ব কমানোর তাগিদ
সম্পর্কের সুতোয় বেঁধে কমে যায়
আপাত দূরত্ব
যোজন যোজন দূরত্ব কমে,
হিসেবের কত নিয়ম কানুন-
কখনও নটিক্যাল মাইল অথবা কখনও আলোকবর্ষ
বেহিসেবিও কত দূরত্ব কমে!
দূরত্ব কমে কখনও হাতের মুঠোয়
আবার কখনও কমে গ্রীবার উপর গরম শ্বাসে
দূরত্ব কমে গিয়ে কখনও কর্ণিয়া থেকে চোখের পাতা
কখনও তর্জনী থেকে মধ্যমা
মাঝে মাঝে তো এমন হয়-
দূরত্ব কমে হৃৎস্পন্দনে অনুভূত হয়।
সাগরে চোখ রাখলেই তো-
এতদূর আকাশের নীলও মুহুর্তেই কমিয়ে ফেলে দূরত্ব
ডিজিটাল স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়ালেই তো এখন দূরত্ব কমে যায়-
একমানুষ থেকে অন্য মানুষের,
এক জীবন থেকে অন্য জীবনের।
দূরত্ব কমতে কমতে কখন যে শূন্যের কোটায় নামে আমরা টের পাই না।
অথচ একটি চোখের উপর আর একটি চোখ রাখলেই কেবল বুঝতে পারি-
আমরা পরস্পর থেকে কত দূরে!







শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট