ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ১৫





(গত সংখ্যার পর)
বিছানায় ছটফট করি। নিঃশ্বাসে গরম হাওয়া অনুভব করি। বাৎসায়নী উন্মাতাল বাতাস। প্রিয় দীপু ভাই চৌষট্টিকলার পাঠমগ্ন নারীর অন্তর্বাস ছিন্ন করা পরাক্রম পুরুষ হিসেবে আইবলে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে। আর বিছানায় কাতর একজন উর্মিলা কেবলি খুন হতে থাকে। দীপু ভাই আমাকে সুবোধ ঘোষের ‘ভারত প্রেম কথা’ উপহার দিয়ে বলেন, ‘এরা  পুরাণের নায়িকা। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ও পাপ-পুণ্যির আওতায় থাকে না।
সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির টেলিফোন করে বলেন, ‘উর্মিলা, শহীদ জননী তোমার ইন্টারভিউ পড়েছেন। আমিও। তুমি গুছিয়ে কথা বলেছ। সত্য বলেছ। তোমাকে ধন্যবাদ।’
অবাক করা কা-! জীবন যে এত প্রশান্তিময়! তা অজানাই থেকে যেত।
এতকিছু ছাপিয়ে দীপু ভাইয়ের জন্য একরকম দাহসারা অন্তর পোড়াতে থাকে।

১.১.১৯৯০
ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন নিখিলেশ চক্রবর্তী বলে বাবার এক ছাত্র এসেছিল অফিসে। এজি অফিসে চাকরি করে। সুদর্শন। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। চোখের মণি পিঙ্গল। কথাবার্তায় ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে। প্রমিত উচ্চারণে কথা বলে।
‘জি ম্যাম, স্যার আপনার খবর নিতে বলেছে।’
আমি বললাম, ‘ম্যাম নয় উর্মিলা। শুভপুরের উর্মিলা।’
নিখিলেশ বাবু হতাশ না হয়ে বলেন, ‘সত্যি  তাই। আমার ভুল হয়ে গেছে।’
‘ধন্যবাদ।’
‘স্যার আপনার জন্য দুশ্চিন্তা করে।’
‘কেন? তাকে আমার বলা আছে চিন্তা না করতে। তার শরীর ভালো নেই।’
‘জি’
‘আপনি তো দেশজুড়ে পরিচিত এবং আলোচিত নাম।’
‘আমি সময়ের ফসল। অন্য কিছু নয়।’
‘এরশাদ কি পদত্যাগ করবে?’
‘জানি না। তবে তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চাই না।’
‘আমি আপনাকে চার বছর আগে দেখেছিলাম। আজ আবার দেখলাম। আপনার রূপান্তর ঘটেছে।’
‘গ্রহ-নক্ষত্র-বিশ্বব্রহ্মা- স্থির থাকে না। ধাবমান।’
‘তা ঠিক।’
‘তাহলে সমস্যা কোথায়?’
‘না। কোনো সমস্যা নেই।’
‘আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন।’
‘না।’
‘তাহলে আমি বাইরে যাব। বাবাকে বলবেন, চিন্তা না করতে।’
‘জি বলব।’
তারপর নিখিলেশ বাবু আরো দু’বার এসেছে। কিছুই বোঝা যায়নি।
নিখিলেশ বাবু আমার একজন পাণিপ্রার্থী। বাবার নির্দেশেই। বাবার দিক দিয়ে বাবা সঠিক। মধ্যবিত্ত ঘরের বিবাহযোগ্যা হিন্দু রমণীর জন্য কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার উৎকণ্ঠা থাকবেই। নিখিলেশবাবু পাত্র হিসেবে যোগ্য। আমার ধারণা, আমি নিখিলেশ বাবুর যোগ্য নই।



নিখিলেশ বাবু বুঝতে পেরেছেন। আমি তার যোগ্য নই।
‘আমাকে ক্ষমা করবেন।’
নিখিলেশ চক্রবর্তীকে বলতে হয়নি।
আমার কেন জানি মনে হলো, আমি রমণী হয়ে উঠেছি। নিখিলেশ চক্রবর্তীর কোনও দোষ নেই। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেছে যুবকের দল।’
ইত্তেফাক পত্রিকায় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আমাকে উৎসর্গ করে কবিতা লিখেছেন, অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎ¯œায় পাক সামান্য ঠাঁই, কিছুটাতো চাই কিছুটাতো চাই।’
দীপু ভাই বলেন, ‘কোনো নারী আমার জন্য এমন কবিতা লিখলে আমি গৃহত্যাগ করতাম। দেবী অন্নপূর্ণা সত্যি ভাগ্যবান।’
কবি রুদ্রের সঙ্গে একবারই দেখা হয়েছে। টিএসসিতে। বেবী আপা ছিল।
বেবী আপা বললেন, ‘কবি, তোমার সর্বশেষ কবিতার আমি একনিষ্ঠ পাঠিকা। কত বক্তৃতায় তোমার কবিতা উদ্ধৃতি করি। আর আমার পাবলো নেরুদার কথা মনে হয়।’
কবি রুদ্র স্মিত হেসে বলেন, ‘আপা, আমি নোবেল পুরস্কার পেয়ে আছি।’
কবি রুদ্র ওর কবিতার মতো ঋজু। ক্যামন হৃদয়কাড়া অক্ষিযুগল। যেকোনো নারীর হৃদয় চাঞ্চল্যের জন্য দায়ী।
আমাকে বলেন, ‘উর্মিলা, এ পৃথিবী যদি ধ্বংসের শেষ প্রান্তে চলে যায়, আমি আপনাকে অনুসন্ধান করব।’
কবিকে কিছু বলা হয়নি। চোখে চোখে জানিয়ে দিয়েছে আপনি অপেক্ষা করলে সঙ্গী হব। আগামী পৃথিবী নির্মাণের জন্য একজন স্বাপ্নিক মানুষ তো চাই। তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত লিখেছেন, ‘তুমি আমার কোমল প্রাণ মৌমাছি, চোখ তোমার মধুর যত মিষ্টি।’
দীপু ভাই কি এমন করে বলবে? বিহ্বল প্রেমিক।
অথবা কবি বদরুল হায়দারের কবিতার ভাষায় গেয়ে উঠবে, ‘প্রেমের প্রথম পাঠ থেকে শিখে নাও ভুলে যাওয়া।’

১০.৩.১৯৯০
সাত চল্লিশে উপমহাদেশ ভাগ হওয়াতে অনেকের মতো আমারও ক্ষোভ আছে। দরকার ছিল না। উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের সত্যিকার মৃত্যু হয় ওই সময়। রাজনীতিবিদরা ভারত ভাগকে ইস্যু করে যে সাম্প্রদায়িক রক্তাক্ত প্রান্তরের সৃষ্টি করেছে তার মানবিক বিপর্যয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আঘাত হেনেছে। নেহেরুর একদিক দিয়ে লাভ হয়েছে। ধর্মের বাতাবরণে দিয়ে প্যাটেল সঙ্গরা মনুষ্যত্ব হারালেও জিন্নাহ্ তার অপরিণামদর্শীতার জন্য চৌদ্দশ মাইল ব্যবধান রেখে যে ভূখ-ের জন্ম হয় তা সঠিক ছিল না। প্রমাণ করতে বেশি দিন লাগেনি। সংস্কৃতির মেলবন্ধনে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের বাসিন্দারা দুই মেরুর মানুষ। যা হবার তাই হয়েছে। তেইশ বছরে পাকিস্তান ভেঙে খান খান। পূর্ব পাকিস্তানবাসী তিন হাজার বছরের বাঙালি সত্তা নিয়ে যে ভিত নির্মাণ করেছে তা একত্রিত করতে  এত বছর লাগলেই শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জয় ছিনিয়ে নতুন ভূখ-ের জন্ম দেয় তার নাম বাংলাদেশ। আমার প্রিয় বাংলাদেশ। আমার জন্মভূমি। দীর্ঘকাল  উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীকে বহুধা ধর্মীয় আবহের মধ্যে আবদ্ধ করলেও তার একটি সৌহার্দ্য-চরিত্র ছিল। নইলে একাত্তরের সর্ব ধর্মের মানুষ যুদ্ধের মাঠে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠত না।
গত ক’দিন যাবত ভারতের অযোদ্ধায় অবস্থিত চারশত বছর আগে মোগল বাদশাহ জহির উদ্দিন বাবর কর্তৃক নির্মিত বাবরি মসজিদ নিয়ে উত্তেজনা থাকলেই কট্টরপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি জঘন্য অসাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রকাশ করে যা ভারতবর্ষের চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। তাদের দাবি অযোদ্ধার ওই জায়গা রামের জন্মভূমি। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী অবতার রামের জন্য রাম মন্দির নির্মাণ করাই শ্রেয়। না কেউ এটা মেনে নেবে না। চারশত বছর আগের মোগল স্থাপত্যকলায় নির্মিত বাবরি মসজিদের এনশিয়েন্ট মূল্য অনেক। ধর্মীয় উন্মাদনা এটা বুঝতে চায়নি। রাজনৈতিক কুটিলতায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে উপমহাদেশের ধর্মীয় উপসনালয়গুলো অতি মূল্যবান। স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হতো। বাবরি মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে হিংসার যে বিষবৃক্ষের জন্ম হলো তার ভবিষ্যৎ কী? আমরা সেই কঠিন সময়ের জন্য সংশয় হৃদয় নিয়ে বসে আছি। শুধু ভারতে কেন এদেশেও তার হাওয়া এসে লেগেছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর কারণহীন হামলা হতে লাগল। যার দায় স্বয়ং স্বৈরাচার এরশাদ এড়াতে পারে না। নইলে আগৈলঝোড়া কুমোর সম্প্রদায়ের বাড়িঘর লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগ, হত্যার বিস্তার ঘটত না। দেশের সর্বত্র থেকে লজ্জাজনক সংবাদ আসতে থাকে। শুভপুরের দরিদ্র স্কুল মাস্টার বসন্ত পালের গোয়ালে গরু রাতের আঁধারে জবাই করে খেয়ে ফেলে যারা তারা তার অতি আপনজন। পুত্রবৎ স্নেহে যাদের মধ্যে এক জীবন জ্ঞানের আলো বিতরণ করেছেন। হায়, রবিঠাকুর বলেছেন, ‘যাহারে করেছো অপমান, অপমানে হতে হবে সবার সমান।’



শহীদ জননী, বেবী আপার সঙ্গে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে  ছুটে যেতে হলো। বলতে হলো, ‘আমি উর্মিলা পাল। এ মাটিতে জন্ম নেয়া মানুষ। আমি বংশাইয়ের জলে অবগাহন করেছি। যে নারীর দুগ্ধপান করে বেড়ে উঠেছি সেও এ মৃত্তিকাতে ছাইভস্ম হয়ে মিশে আছে। আমি কোথা যাব? এই ভূমিকে মমতা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই শিখিনি। আমারও মসজিদের আজান শুনে ঘুম ভেঙে যায়। কাশরের ঘণ্টাধ্বনি শুনে ভোর হয়। সেই ভোরের রূপ-রস-গন্ধ আমার মতো করে সবাই ভালোবাসে।’
বক্তৃতা শেষে শহীদ জননী বললেন, ‘উর্মিলা, আমি তোমার বক্তৃতা শুনে কেঁদে ফেলেছি। জনতা তোমার পক্ষে। ক্যামন সেইম সেইম করে চিৎকার করে উঠল।’
এর দু’দিন পর ফাদার রিগানের কাছ থেকে পত্র পাই। ফাদার রিগান এই মৃত্তিকাকে ভালোবেসে একাত্তর সালে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ফাদার লিখেছেন, ‘উর্মিলা, প্রিয় কন্যা, জন্মভূমি তোমার মতো সন্তান আশা করে। আক্রান্ত জননীর জন্য বুক পেতে দিতে হয়। জননী, সন্তান হিসেবে পাশে দাঁড়াতে দাও।’
ওইদিন রাতে আমার সারা শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এল। (চলবে)






শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট