লুইজালে’র
মাহমুদ নোমান
অমিত গোস্বামী
নন্দিতা ও শিবপ্রসাদ পরিচালিত ‘বেলাশেষে’ সিনেমাটা দেখেছেন ? ইউটিউবে আছে। অভ্যাস বনাম প্রেম এই দ্বন্দ্বের ওপরে ছবি। লেখার ক্ষেত্রে গদ্যরচনা অনেকটা অভ্যাস, কিন্তু কবিতা রচনার সাথে প্রেমের তুলনা করা যায়। কারণ ছোট পরিসরে বেশি সূক্ষ্মতা দাবী করে। গতকাল এই ‘বেলাশেষে’ ছবিটি দেখতে দেখতে কবি মাহমুদ নোমানের প্রকাশিতব্য কবিতা সংকলন ‘লুইজালে’র কথা মনে পড়ল। প্রথমত নামটা অসাধারণ। এপার বাংলায় তথাকথিত এলিট কবিরা এর অর্থ বুঝবেন না। কিন্তু কবিতা পড়ার পরে বুঝবেন। মাহমুদ নোমানের সাথে আমার কখনও দেখা হয় নি। ফেসবুকে ওর কবিতা পড়েছি। ভাল লেগেছে। সে কথা বলেছিও। কিন্তু সে যখন ‘লুইজালে’র পা-ুলিপি পাঠালো খুব একটা গুরুত্ব দিই নি। কিন্তু পা-ুলিপি খুলে বসতেই কবিতাগুলি আমাকে বেশ টেনে ধরল। বুঝলাম স্বল্প পরিসরে শব্দ নিয়ে খেলার মুন্সিয়ানা সে ভালই রপ্ত করেছে। তাহলে কি সে এমন কবিতা লিখেছে যা জয় গোস্বামী, রুদ্র, শ্রীজাত বা কামাল চৌধুরীর আবির্ভাব লগ্নের কবিতার সাথে তুলনীয়? নাহ, তা নয়। তবে ভাল কবিতার আক্রার বাজারে তার আবির্ভাব অবশ্যই সাড়া জাগানো।
মাহমুদ নোমান একটি অনলাইন পত্রিকার সাথে কথা প্রসঙ্গে বলেছেন ‘কবিতায় শব্দের ব্যবহারে আমি যে ভাষায় বেড়ে উঠেছি তাকে অস্বীকার করি নি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার আমি কবিতার বাক্যে জুড়ে দিয়েছি পুরোপুরি আনন্দে’। এখানেই নোমানের অকপট স্বীকারোক্তি। এখানেই মাহমুদ নোমান সার্থক। তাই ও লিখতে পেরেছে-
‘আমি মরলে সিনার উপর রুয়ে দিয়ো মান্দার ফুলের গাছ। /
লাল টুকটুকে ফুল ফুটেছিলো বেহেশতের জমিনে,/
গায়ে যুবতী কাঁটা বিঁধেছে এ কলিজায় ফাগুনের মুরালি বাতাসে।/
ফেসবুক এখন অনেক নতুন ফর্ম, অনেক নতুন ভাবনার ভার্চুয়াল পৃষ্ঠপোষক। কখনও কখনও কবিদের নাম গৌণ হয়ে যায়। শব্দ বা ছন্দগুলো জেগে থাকে পাঠকের মনে বহুকাল। বিশুদ্ধবাদীরা নাক কুঁচকোতেই পারেন। কিন্তু সময়ের বহমানতা অনেক সো-কল্ড নন-সিরিয়াস প্ল্যাটফর্মকেও সিরিয়াস করে তোলে। ফেসবুকের একটা বড় সুবিধে, ইমিডিয়েট ফিডব্যাক। মাহমুদ নোমান এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করেছেন নিজস্ব স্টাইলে। সেক্স নিয়ে তার সরাসরি সাহসী মস্তব্য যে কোন স্বাভাবিক মননের মানুষকে মুগ্ধ করবেই।
‘চৈত্র ষোড়শীর স্তন দেখাল ডুবুডুবু পুকুরের জলে...’
বাঙালি কবিরা মধ্যরাতের জোছনায় দাঁড়িয়ে থাকা নিয়তির সামনে ঘাড় গুঁজে বসে লিখে চলেছেন। দেবী নিয়তি মাঝে মাঝে এক বাটি খাবার, এক ঘটি জল এগিয়ে দিচ্ছেন। এই ঘটিবাটিই হল বাংলা কবিতার একটা লাইফলাইন। তাই মাহমুদ নোমান তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন ‘বাবার সংসারের উদাসীনতায় লেখাপড়ায় অতদূর এগোন গেল না। আর্থিক অস্বচ্ছলতা আমাকে সাহিত্যের বিভিন্ন পাঠে বেশ ভুগিয়েছে। কোন সাহিত্যের আড্ডায় এ পর্যন্ত যাই নি বা কারো পরামর্শ আমি পাই নি’। তথাকথিত পড়াশোনায় এগোন বা না এগোন কোন বিষয় নয়। কিন্তু কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রয়োজন আছে। কবিতা পড়ার একটা পাঠ কিন্তু নিতেই হয়। সে জন্যে পরামর্শ বা গুরু প্রয়োজন। এই পাঠ পেলে নোমান লিখতেন না এই পঙ্ক্তিটি।
‘চ-ালি মেঘ দেখে দেখে চাষা
ধানের গলা কাটছে,
তপ্ত বালুকণার জলে...’
তর্ক করা যায়। কিন্তু পাঠকের চিত্রকল্প নির্মাণে বাধা সৃষ্টিকারী শব্দ এড়িয়ে যাওয়া ভাল। বাংলা কবিতায় এখন অনেক জ্ঞানীগুণীজন। কেউ বেঁচে আছেন চামচে পরিবৃত দোহারিদের নিয়ে, কেউ বেঁচে আছেন ফেসবুকে অন্যকবিদের স্রেফ খিস্তি করে। অন্যদের অকবি, আধা কবি বা ল্যাদা কবি বলে নিজেদের প্রকৃত কবি বলে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টায়। কিন্তু শেষ কথা বলেন পাঠক। কে কী তার নির্বাচন হয় পাঠকের হাতে। মাহমুদ নোমান আশা রাখি এই ধরনের আক্রমনের সামনে ভবিষ্যতে পরবেন। কিন্তু পীড়িত হবেন না। হবেন না যে তার প্রমাণ তিনি অবশ্য রেখেছেন। তার সাহসী সংলাপ...
‘মাকে যেদিন পতিতালয় থেকে আসতে দেখেছিল বরুণ-
কথারা অমনি এতিম হয়ে গিয়েছিল।‘
ফেবুতে নজর রাখলে চোখে পড়বে কবিতা নিয়ে হরেক কিসিমের খিল্লি খলবল করছে। কবিতা নিয়ে একশত আট প্রকারের গ্রপ। কবিতার পেজ। লাইক আর কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়। এই বন্যা প্রবণতা মাথায় রেখেই কি না কে জানে, সে দিন এক ফেবুকবি পোস্ট করেছিলেন, ‘এসো কমেন্ট এসো লাইক রাশি রাশি/নিসর্গের বিবমিষায় কবিতা আজ বানভাসি।’ এই চক্করে মাহমুদ নোমানের পড়লে চলবে না। পুরস্কারের প্রত্যাশায় ঘুরলে চলবে না। তাকে লিখতে হবে। সবকিছুই লিখতে জানতে হবে। মনে রাখতে হবে তার কাজ শুধু লেখা এবং ফলের আশা না করেই। মা ফলেষু কদাচন। অনেক লিখলে অনেকে তাকে ‘সবজান্তা’ বা ‘অলরাউন্ডার’ বলতেই পারে। তাতে আশা করি তার সাহিত্য অঙ্গনের কোন ঘাস ছিন্ন হবে না। কাজেই এবার মাহমুদ নোমানের ‘চরৈবেতি’ বলে এগিয়ে চলার পালা এবং কোন দিকে না তাকিয়েই....