অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ
[গত সংখ্যার পর]
তারপর সে সত্যিই পড়াশোনায় মগ্ন। রাতে নিলয়ের সাথে কিছু সময় কথা হয়, তাও প্রতি রাতে না। কিন্তু সময় যে হাতে খুব অল্প। যেটুকু আছে তাকে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না। চাঁদে গিয়েছিল এ্যাপেলো-১১। তার গতি নাকি ছিল ঘন্টায় ১৮০০০ মাইল। আর তার এখন মনে হচ্ছে, সময়ের গতি এ্যাপেলো-১১-এর চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি। একটা ঘন্টা যেন সেকেন্ডের চেয়েও ছোট হয়ে গেছে। সামনে পাঠ সমুদ্র। এই সমুদ্র জমেছে সারাটি বছর ধরে। এখন এই অল্প সময়ে সেই সমুদ্র কিভাবে পাড়ি দেবে সে? সে কোনো কাজে সহায়তার জন্য লোক ভাড়া করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এই পাঠস্তুপ শেষ করার জন্য সে কোনো লোক ভাড়া করতে পারবে না। এ কাজ তাকেই করতে হবে। যদি সময়ের কান থাকতো তাহলে সে বলতো-হে সময়, তুমি দীর্ঘ হও। দীর্ঘ নয়, অনন্ত হও। আমি তোমাকে নিয়ে গান গাইবো, কবিতা লিখবো, কিন্তু তোমাকে ভুলবো না।
যেন দিন গোণা শুরু করার আগেই সব দিন ফুরিয়ে গেল। শুরু হয়ে গেল পরীক্ষা।
সে পরীক্ষা দিয়ে এলে বাবা-মা কোনোদিন প্রশ্ন দেখেননি। কোনো ক্লাশেই তারা তা করেননি। শুধু জিজ্ঞেস করেছেন, পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
ভাল।
সব কমন পড়েছে?
হু।
সব উত্তর করতে পেরেছো?
হু।
এবারও তাই। গতানুগতিক প্রশ্ন। গতানুগতিক উত্তর। কেমন নিরানন্দ, কেমন ভাল না লাগা নিয়ে পরীক্ষা শেষ হল। পরীক্ষা শেষ হলে অনেক কিছুই করার পরিকল্পনা ছিল। সব পরিকল্পনা, সব ইচ্ছা যেন উবে গেল। কি এক দুঃশ্চিন্তায় সে আচ্ছন্ন হয়ে রইল। বাবা বললেন, পরীক্ষা শেষ, এখন আনন্দ করো।
কী আনন্দ করবো বাবা ?
যেমন মন চায়। কোথাও বেড়াতে যেতে চাও?
তা যাওয়া যায়।
কোথায় যাবে ?
তুমি বলো বাবা।
আমি তিনটা বলবো। তুমি তা থেকে একটা বেছে নেবে।
বলো।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, খুলনা সুন্দরবন, দিনাজপুর কান্তজিউ মন্দির। শেষেরটায় গেলে কান্তজিউ মন্দিরের সাথে আরেকটা ফ্রি দেখতে পাবে।
সেটা কি বাবা?
রামসাগর।
কক্সবাজার ছাড়া বাংলাদেশে আরও কোথাও সাগর আছে বাবা?
তোমার মাথায় দেখছি পাঠ্য বইয়ের বাইরে বিশেষ কিছু নাই। বঙ্গোপসাগর ছাড়া বাংলাদেশে যে আর কোনো সাগর নেই তা তো ক্লাশ থ্রির একটা বাচ্চাও জানে। তোমাকে আমি জাদরেল ব্যারিস্টার বানানোর স্বপ্ন বুকে নিয়ে বেঁচে আছি। আর উকিল-ব্যারিস্টার মানে দুনিয়ার সব ধরনের নলেজ রাখতে হবে তাকে। মানুষ মারার কেস-এ আসামিকে ছাড়িয়ে আনবে, আর পিঁপড়া মারার কেস-এ আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলাবে এই হল উকিল-ব্যারিস্টার।
বাবা, আমি কোথায় যাব তা কাল জানাবো।
আচ্ছা জানিও। পরীক্ষা যা দেবার দিয়েছো। তা নিয়ে টেনশন না করে এই অবসরে ইংরেজি পড়ো, জেনারেল নলেজ বাড়ানোর জন্য অন্যান্য বই পড়ো।
আমি টেনশন করছি না বাবা।
মুখ তো তা বলছে না। অতীতে কোনো পরীক্ষা দিয়ে এসে এতটা বিমর্ষ থাকোনি।
অনেক চেষ্টার পরও সে মনমরা ভাব কাটাতে পারে না। রাতে ফোন আসে নিলয়ের। নিলয় বলে, কেমন আছো?
আছি মোটামুটি।
মোটামুটি কেন? পরীক্ষা শেষ, এখন তো ফাটাফাটি থাকার কথা। পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
সব পরীক্ষা একরকম হয়নি।
তা কি কখনো হয়? হাতের পাঁচ আঙুল কি সমান? বলো সমান?
না।
যেটা ভাল হয়েছে সেটা খারাপটাকে সাপোর্ট দিবে। টেনশন বাদ দাও। এনজয় করো। লাইফ ইজ ফর এনজয়। বিকজ ইটস ওয়ানলি ওয়ান এন্ড ইউনিক। তোমার জীবন তোমার মতো, আমার জীবন আমার মতো।
নিলয় ভাই, আমি ইংরেজিতে খুব দূর্বল হয়ে গেছি।
কেমন দূর্বল? আমি যে লাইনটা বললাম তা কি বুঝতে পারো নাই? এ ইংরেজি তো ক্লাশ থ্রির বাচ্চাও বুঝতে পারবে। ইংরেজির মাস্টারের সাথে প্রেম করলা আর এখন বালো ইংরজিতে দূর্বল। ভয়াবহ কথা!
নিলয় ভাই, রামসাগরটা কী ?
তোমার কি মনে হয় যে, এটা কোনো সমুদ্র?
আমি তো তাই মনে করেছিলাম।
তুমি তো আমাকে টাসকি মেরে দিচ্ছো। বাংলাদেশে যে একটা মাত্র সমুদ্র তা তো ক্লাশ থ্রির একটা বাচ্চাও জানে। প্রেম করতে গিয়ে কারো এরকম অবস্থা হয় তা আমার জানা ছিল না। সব কিছুকে ইউজ করতে হয়, তাহলেই তা থেকে ভাল কিছু পাওয়া যায়। এ্যাবইউজ করলেই খারাপ ফল। আমার মনে হয়, তুমি প্রেমকে এ্যাবইউজ করেছো।
নিলয় ভাই, রামসাগর সম্পর্কে কিছু বলেন তো।
রামসাগর হল বিশাল এক দিঘী। দেখার মতো একটা জিনিস। দিনাজপুর শহরের কেন্দ্র থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে আউলিপুর ইউনিয়নে অবস্থিত দিনাজপুর মহারাজাদের অন্যতম কীর্তি রামসাগর দিঘী। এর চারিদিকে সবুজ প্রান্তর, পাড়ভূমিসহ দীঘির মোট আয়তন ৪,৩৭,৪৯২ বর্গ মিটার। জলভাগের দৈর্ঘ্য ১০৩১ মিটার। প্রস্থ ৩৬৪ মিটার। গভীরতা গড়ে প্রায় ৯ মিটার। সেচ সুবিধা ও প্রজাদের পানির কষ্ট দূরীকরণের জন্য রাজা রামনাথের আমলে এই দিঘী খনন করা হয়। দিঘীটি খননে তৎকালীন ১৫০০০ টাকা এবং ১৫ লক্ষ লোকের প্রয়োজন ছিল।
সে যারপর নাই অবাক হল। নিলয় এস.এস.সি তে ভাল ফলাফল করতে পারেনি। তাই ঢাকা শহরের ভাল কোনো কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। ফলে এইচ.এস.সি-তেও আরেকটা খারাপ রেজাল্ট। পড়ছে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধীনে জেলা শহরের এক কলেজে। অথচ সে কত কিছু জানে। এমনভাবে তথ্যগুলো বলল যেন তার সামনে বই খোলা আছে। অথবা সে এসব মুখস্থ করে রেখেছিল, কারণ সে জানতো এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে হতে হবে।
সে বলল, আচ্ছা নিলয় ভাই, কান্তজিউ মন্দির সম্পর্কে কিছু জানেন?
তুমি হঠাৎ সব ঐতিহাসিক স্থানের খোঁজ-খবর নিচ্ছো কেন?
বাবা বেড়াতে যাবার কথা বলেছেন। তিনটা অপসন দিয়েছেন। কক্সবাজার, সুন্দরবন, কান্তজিউ মন্দির।
তাহলে কান্তজিউ মন্দিরে যাও, সঙ্গে ফ্রি পাবে রামসাগর।
কান্তজিউ মন্দির সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?
জানবো না কেন ? আমি তো জানোয়ার। ভাল একাডেমিক ফলাফল করতে পারি নাই। তাই পণ করেছি একাডেমিক ফলাফল ভাল না হলেও জানোয়ার ঠিকই হব।
কী বলছেন এসব ?
কেন, খেলতে খেলতে যদি খেলোয়ার হয়, তাহলে জানতে জানতে জানোয়ার হবে না?
হি-হি-হি।
শোন, মহারাজা প্রাণনাথ ১৯৫২ থুক্কু ৫২, ৭১ বলতে গেলেই ১৯শ এসে পড়ে। ১৯৫২, ১৯৭১-এ কি হয়েছিল জানো তো? তুমি যেভাবে সব ভুলে গেছো তাতে তোমাকে নিয়ে আমার টেনশন হচ্ছে যে, ৫২, ৭১ সম্পর্কেও কিছু জানো না। ১৭৫২ সালে এই কান্তজিউ মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরটির মূল বিষয় হল এর কারুকাজ। হাজার হাজার সূক্ষ্ম কাজ করা টাইলস দিয়ে পুরো মন্দিরটি নির্মিত। কারুকাজগুলো পুরনো হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য বহন করে। পোড়ামাটির ফলকের উপর এমন কারুকাজ খচিত শাপলা উপমহাদেশে আর একটাও নাই। আগে পোড়ামাটির উপর আটটি গম্বুজ ছিল। ১৮৯৭ এ একটি ভূমিকম্পে গম্বুজগুলো ভেঙে পড়ে।
আমার ডিসিশন ফাইনাল। আমি কান্তজিউ মন্দির দেখতে যাব। সাথে ফ্রি দেখব রামসাগর। আমার খুব অবাক লাগছে যে, আপনি এতকিছু জানেন।
তারপরেও তো আমি ত্যাজপাতা।
প্লিজ নিলয় ভাই.......।
কিন্তু সারা জীবন ত্যাজপাতা হয়ে থাকতে চাই না। আমি বৃশ্চিক রাশির মানুষ। এই জাতকের মানুষ সবচেয়ে জেদী আর কর্মঠ হয়। মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু পরাজিত হয় না। এ কথা কে বলেছেন জানো? এ কথা বলেছেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দ্যা সী’ বইয়ে। আমিও পরাজিত হব না, দেখে নিও তুমি।
আমি তা জানি।
শোন, মাঝে তো লাভ ভাতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফিরে যখন এসেছো তখন আগের মতোই তোমার মোবাইল খরচ আমার।
না না.......।
তোমার ‘না না’ আমি শুনব না। কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার ফোনে এক হাজার টাকা চলে যাবে।
নিলয় ভাই, আপনি কি যাবেন আমার সাথে কান্তজিউ মন্দির দেখতে?
আমার তো বাংলাদেশে দেখার মতো তেমন কোনো জায়গা বাকি নাই।
তবুও....।
আপনি গেলে আমার ভাল লাগবে। সময়টা সুন্দর কাটবে।
আচ্ছা, যাবার আগে কল দিও, বান্দা হাজির হয়ে যাবে।
তারপর সে বাবার সাথে কান্তজিউ মন্দির, রামসাগরে বেড়িয়েছে। সাথে ছিল নিলয়। গ্রামের বাড়িতেও গিয়েছিল। খালার বাড়িতে থেকেছে কয়েকদিন। তখন প্রতি বিকেলে রিস্কি মটর বাইক ড্রাইভার নিলয়ের পিঠের সাথে নিজের বুক চেপে ধরে ঘুরেছে মটর বাইকে। এই অবসরে নিলয়ও ঢাকায় এসেছে ২/৩ বার। প্রতিবার ২/৩ দিন করে থেকেছে। তখন শপিং করা আর চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাওয়া হয়েছে আগের মতোই।
সাথে ছিল আরেকটা আনন্দ। তাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল দুঃসম্পর্কের এক চাচাতো বোন তার তিন বছরের শিশুপুত্র নিয়ে। থেকে ছিল প্রায় সপ্তাহ খানেক। তার বাচ্চাটা কি যে সুন্দর! গুটি গুটি পায়ে এঘর-ওঘর ছুটোছুটি করেছে। আধো আধো বলে সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রেখেছে। সেই চাচাতো বোনকে নিতে এসেছিল তার দেবর। নাম পলাশ। পলাশ প্রস্তাব তুলে তাদেরকে চাইনিজ খাওয়াবে। সে সহজে সেই প্রস্তাবে রাজি হতে পারেনি। তার চাচাতো বোন বলেছে-অসুবিধা কি? খাওয়াতে চেয়েছে, চল গিয়ে খেয়ে আসি।
পলাশ বড় ব্যাবসায়ি। গাড়ি আছে। বিয়ে করেছিল। বউয়ের সাথে বনিবনা না হওয়ায় ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
চাইনিজ খেতে গিয়ে সে পলাশের সাথে ইজি হয়ে যায়। ইজি না হয়ে উপায় ছিল না। পলাশ খুব মজার লোক। খুব মজা করে কথা বলে। কৌতুকও বলে ফেলল কয়েকটা। আর মুখে তার লেগে থাকে হাসি।
টাকা থাকলেই সবাই খরচ করতে পারে না। খরচের মন থাকতে হয়। পলাশের সে মন আছে। চাইনিজ খেয়ে গেল শপিং-এ। ভাবীকে এটা-ওটা কিনে দিল। সেই সাথে তাকেও। সে খুব লজ্জা পাচ্ছিল। কিছুতেই নিতে চাইছিল না কিছু। তার চাচাতো বোন বলল-আরে এত সংকোচের কি আছে? দিচ্ছে নে। মানুষ কি মানুষকে গিফট দেয় না?
তার দুই দিন পর একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে তার মোবাইলে। সে কলটা রিসিভ করবে কি করবে না ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে নিজের মনে বলল, যেই হোক, কথা বললে কি আমাকে খেয়ে ফেলবে? বাজে লোক হলে কেটে দেব। সে কল রিসিভ করে বলল, হ্যালো।
ক্যামন আছো তুমি?
আপনি কে বলছেন?
আমাকে চিনতে পারছো না?
নামটা বলুন প্লিজ।
দু’দিন আগেও তো আমার সাথে কত কথা বললে।
আচ্ছা, না হয় বলেছি। এখন নামটা বলুন।
এক সাথে চাইনিজ খেলাম, নিউ মার্কেটে কেনাকাটা করলাম।
আপনি কি পলাশ ভাই?
যাক চিনেছো তাহলে।
আপনার বাস্তব কন্ঠের চেয়ে ফোনের কন্ঠ বেশ আলাদা।
আলাদা কেমন, খারাপ?
না না, খারাপ না। তা কেমন আছেন আপনি?
হ্যাঁ, খুব ভাল।
আপনি যে ফোন করবেন তা ভাবতে পারিনি।
মানুষ কি সব কিছু আগে থেকে ভাবতে পারে? কাল থেকে মনে হচ্ছিল, তোমাকে ফোন করি। আবার ভরসা পাচ্ছিলাম না যে, তুমি কিছু মনে করো।
কি যে বলেন! মনে করার কী আছে?
তোমার সত্যি কন্ঠ খুব সুন্দর, ফোনের কন্ঠ আরও সুন্দর।
হি-হি-হি।
আমি সত্যি বলছি। যা বলার আমি তা স্পষ্ট বলে দেই। তোমার কন্ঠ যদি খারাপ হতো আমি তাই-ই বলতাম। মিথ্যা করে কারও প্রশংসা আমার ভাল লাগে না। আমার মনে হয়, তুমি গান শিখলে অনেক ভাল করতে।
কথা বলার কন্ঠ ভাল হলে কি গানের কন্ঠও সুন্দর হয় ?
আমার তাই মনে হয়। অবশ্য সংগীত বিষয়ে আমার বিশেষ জ্ঞান নেই। আমি জানি, নিলুফার ইয়াসমিন আর আব্দুল লতিফের কথা বলার কন্ঠ অতো সুন্দর ছিল না, কিন্তু তারা তো বিখ্যাত শিল্পী হয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, কন্ঠটা সহযোগি হলেও সংগীত সাধনার বিষয়। যাকগে শোন, তোমাকে যদি মাঝে মাঝে ফোন করি তুমি কি বিরক্ত হবে?
কী যে বলেন! বিরক্ত হব কেন? আমার বরং ভাল লাগবে। ফোনে কথা বলার মত আমার তেমন মানুষই নেই।
কেন, স্কুলের বন্ধুরা........ ?
আরে ওরা তো থাকে তাদের বয়ফ্রেন্ড নিয়ে। দিনরাত বয়ফ্রেন্ডের সাথে গুচুর গুচুর-ফুচুর ফুচুর । ওদের সাথে কথা বলা যায়?
তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই?
না, সত্যি বলছি নেই।
আচ্ছা, আমি মাঝে মাঝে ফোন করে একটু হলেও তোমার নিঃসঙ্গতা দূর করবো।
ধন্যবাদ পলাশ ভাই।
তারপর থেকে তার ফোনে কথা বলার সঙ্গী দুইজনঃ পলাশ আর নিলয়।
একদিন পলাশ চাইনিজ খেতে আমন্ত্রণ জানাল। ইতস্তত করতে করতে সে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ফেলল। আসলে চাইনিজ খাবারটা তার দারুন প্রিয় হয়ে উঠেছে এতদিনে। দেশী খাবার তার খেতেই ইচ্ছে করে না। নিলয় তো দূরে থাকে। মাসে দুই/এক বারের বেশি আসতে পারে না। পলাশ ঢাকায় থাকে। তার অনেক টাকা। আছে টাকা খরচের দরাজ মন। সে প্রতিদিনই খাওয়াতে পারে। তবে প্রতিদিন তো আর খাওয়া যায় না। তার উপর গাড়িতে ঘোরাঘুরিটাও হয়।
মনের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হয়ে যেতে সময় লাগল না। পলাশের সাথে চাইনিজে যাওয়াটা তার নিয়মিত হয়ে গেল। সপ্তাহে কম পক্ষে দুই দিন। কোনো কোনো সপ্তাহে চার/পাঁচ দিন। বাবা-মা বাইরে গেলেই সে বাসা থেকে বের হয়। ৩/৪টার মধ্যে ফিরে আসে।
পলাশ নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে। সে বসে ড্রাইভিং সীটের পাশে, মানে পলাশের পাশে। গাড়ি চালাতে চালাতে পলাশ অনেক কথা বলে। সেও কথা বলতে পছন্দ করে। যেমন একদিন কথা হচ্ছিল-পলাশ বলল, তুমি কি ভাবতে পেরেছিলে যে, আমরা এত ঘনিষ্ট হয়ে যাব?
উহুঁ।
আমার কিন্তু প্রথম দিনই মনে হয়েছিল, তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব হবে।
কেন ?
কেন তা জানি না, তবে আমার যা মনে হয় তা হয়ে যায়।
হু।
আমাদের বয়সের পার্থক্য কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব হবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
বন্ধুত্বের জন্য বয়স কোনো বিষয় না, বিষয় হল মন।
ঠিক বলেছো, হানড্রেট পার্সেন্ট রাইট। আমাকে তোমার কেমন মনে হয়?
ফ্র্যাঙ্ক।
তোমার চুলের গন্ধটা আমার খুব ভাল লাগে।
আমি চুলে বিশেষ কিছু ব্যবহার করি না, নর্মাল হেয়ার ওয়াশ।
তাই! এত সুন্দর গন্ধ?
তাহলে চুলগুলো আপনার কাঁধে তুলে দেই?
দাও, একটু কাছে চেপে বসো, তারপর চুলগুলো আমার কাঁধে তুলে দাও।
কাছে চেপে বসবো কেন?
চুলের গন্ধের সাথে শরীরের গন্ধটাও নেই।
শরীরের গন্ধ নিতে নিতে আবার স্পর্শ নিতে চাইবেন। ছেলেদের আমার ঢেড় চেনা।
তুমি না বললে, তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই?
বন্ধুদের আছে না? ওদের কাছ থেকে শুনে শুনে চিনেছি।
আচ্ছা, শরীরের স্পর্শ নিলে ক্ষতি আছে কোনো? মন ছুঁয়েছি বলেই তো বন্ধু হতে পেরেছি। শরীর ছুঁলে দোষ?
হ্যাঁ দোষ।
দোষ, তবে নিশ্চয় বড় কোনো দোষ না। এর জন্য জেল-ফাঁস হবার সম্ভাবনা নেই। প্লিজ, একটু কাছে এসে বসো।
উঁহু।
আরে বসো তো।
উঁহু।
কী উঁহু উঁহু করছো ডাহুক পাখির মতো। বসো বলছি, প্লিজ......।
উহুঁ।
কেমন একরোখা তুমি? এতটা একরোখা আচরণ ভাল না।
এই বসেছি, হল তো?
হ্যাঁ, হয়েছে।
পলাশের এক হাতে স্টিয়ারিং আর এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরা। আচানক হার্ড ব্রেক। মাটিতে চাকার ঘর্ষণের শব্দ। সে প্রায় চিৎকার করে উঠল, আহ! ছেলেটাকে মেরে ফেললেন?
না মরেনি। পায়ে লেগেছে।
থামুন, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
ওকে হাসপাতালে নেবার জন্য থামলে গণধোলাইয়ের হাতে পড়তে হবে। গণধোলাই কি জানো? একেবারে তুলোধুনা। ধুনুরীদের তুলা ধুনতে দেখেছো? না দেখলে একদিন কাওরান বাজারে গিয়ে দেখে এসো। আর পাবলিক এই দিকটা একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
কোন দিকটা ?
গাড়ি চালানোর সময় গার্লফ্রেন্ড নিয়ে লদকালদকি।
ব্যাপারটা নিয়ে কয়েকদিন তার খুব মন খারাপ ছিল। তার ধারণা ছিল, ছেলেটা মরে গেছে। ছেলেটার মৃত্যুর জন্য সে পলাশকে দায়ী করেছে, নিজেকেও দায়ী করেছে অনেকটা। সে যদি এভাবে পলাশের কাছে শরীর ছেড়ে না দিতো তাহলে পলাশ ভুল করতো না।
সপ্তাহ খানেক সে পলাশের সাথে বের হয়নি। পলাশ তাকে ফোন করে বার বার বলেছে, তুমি কি যে ছোট-খাট ব্যাপার নিয়ে ভাবতে পারো।
এটা মোটেও ছোট-খাট ব্যাপার না। একটা মানুষের জীবন। মানুষের জীবন কি ছোট ব্যাপার হয়?
তোমার এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা নেই। ও ছেলের কিছুই হয়নি। ওরা হল পপকর্ন বয়। ওরা জানে পেছন থেকে গাড়ি ধাক্কা দিলে কেমন করে সরতে হবে, সামনে থেকে ধাক্কা দিলে কেমন করে সরতে হবে। ওর গায়ে একটু স্পর্শ লাগতেই ও এমন লাফ দিয়েছে।
এটাকে স্পর্শ বলে না। সরাসরি প্রচন্ড ধাক্কা।
ও কি চাকার নিচে চলে গিয়েছিল? চাকার নিচে না গেলে মানুষ মরে?
সে পলাশের এসব কথায় আশ্বস্ত হতে পারেনি। তার শুধুই মনে হয়েছে ছেলেটা মরে গেছে। সে পলাশের ফোন অনেক সময়ই রিসিভ করেনি। কখনো রিসিভ করলেই দুই/একটা কথা বলে কেটে দিয়েছে এবং এক সময় সে পলাশের সাথে যোগাযোগ এক রকম বন্ধই করে দেয়।
একদিন পলাশ ফোনে আচমকা বলে, শোন, হাসপাতালে গিয়েছিলাম।
হাসপাতালে! কেন?
সেই ছেলেটাকে দেখতে।
কোন ছেলেটাকে?
ভুলে গেছো? এই হল মেয়েদের মন। যার জন্য দুঃখে কেঁদে মরে, পরক্ষণেই তাকে ভুলে যায়। সেই ছেলেটা, যাকে কয়েক দিন আগে ধাক্কা দিয়েছিলাম।
ও, কেমন দেখলেন ওকে?
যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে একটু বেশি লেগেছে।
কতটুকু কি হয়েছে ওর?
বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে একটা হাড় ভেঙেছে। জোড়াও লেগে গেছে এর মধ্যে। কঁচি হাড় না? এখন সে প্লাস্টার বাঁধা পা নিয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটছে। প্লাস্টার খুলে দিলেই ক্র্যাচ ফেলে হাঁটতে শুরু করবে। আমি ওকে দশ হাজার টাকা দিয়েছি।
দশ হাজার টাকা দিয়েছেন ওকে!
হু।
ছেলেটাকে কে হাসপাতালে নিলো, কোন হাসপাতালে নিলো এসব পলাশ জানল কি করে, এরকম কোনো প্রশ্ন তার মাথায় এল না। সে পলাশের কথা বিশ্বাস করে ফেলল। মনে মনে পলাশকে অনেকটা মহান ভাবল। গরিবের জন্য তার অনেক ভালোবাসা। আসলে দূর্ঘটনাটা সে ইচ্ছা করে ঘটায়নি। দূর্ঘটনা তো দূর্ঘটনাই। এর জন্য একজন মানুষকে সব সময়ের জন্য দোষী করে রাখা ঠিক না। আবার সে পলাশের সাথে আগের মতোই বের হতে থাকল।
একদিন পলাশ ফোন করে বলল অন্যরকম কথা। বলল, আচ্ছা, আমরা দু’জন যে খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেছি এ ব্যাপারে কি তোমার কোনো সন্দেহ আছে?
সন্দেহ থাকবে কেন? অবশ্যই আমরা ভাল বন্ধু।
তাহলে আমরা পরস্পরকে যে কোনো কথা বলতে পারি, তাই না?
কত কথাই তো বলছেন।
তারপরও মনে গভীরে কোনো কথা না বলা থেকে যেতে পারে। অনেক কথার ভিড়ে হয়তো আসল কথাটিই হয়নি বলা।
বাহ! আপনি তো সাহিত্যও করতে পারেন দেখছি।
ভালোবাসা তো সাহিত্যই। পৃথিবীর সবচেয়ে সৃজনশীল কাজ হল সাহিত্য। আর সেই সাহিত্যের সবচেয়ে কাঙ্খিত উপাদান হল প্রেম-ভালোবাসা।
আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
সুমাইয়া, অনেক ভেবে দেখেছি যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আমি অনেক-অনেক ভালোবেসে ফেলেছি।
তা কি করে হয়?
কেন হয় না সুমাইয়া?
আপনার আর আমার মাঝে বয়সের বিরাট পার্থক্য।
ভালোবাসার জন্য কি বয়স কোনো বিষয় সুমাইয়া? ভালোবাসার জন্য তো মনটাই আসল। এর চেয়ে বয়সের অনেক বেশি পার্থক্য নিয়েও অনেকের মধ্যে ভালোবাসা হয়েছে। আমার প্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথা ভাব?
আপনি কি নিজেকে হূমায়ুন আহমেদ মনে করেন? হূমায়ুন আহমেদ ৬৩ বছর বয়সে এসে আমাকে এখন প্রেম প্রস্তাব করলে আমি রাজি হতাম। সুযোগ থাকলে তাকে আমি নিজেই প্রেম প্রস্তাব করতাম। কিন্তু আপনি.......।
আমি হূমায়ুন আহমেদ নই, তুমিও মেহের আফরোজ শাওন নও। আমি পলাশ আহমেদ আর তুমি.....।
আপনি ডিভোর্সি আর আমি ভার্জিন।
ভার্জিন কথাটা বলে সে থমকে গেল। তার মনে পড়ল তূর্যের সাথে গাজীপুরের সেই রিসোর্টের সময়টার কথা।
পলাশ বলল, মেহের আফরোজ শাওনও কিন্তু ভার্জিন ছিল।
আপনার অযৌক্তিক প্রস্তাব মানানোর জন্য কেন জাতির সম্মানিত ব্যক্তিদের উদাহরণ টেনে আনছেন?
উদাহরণ হিসাবে তো সম্মানিত-বিখ্যাত ব্যক্তিদেরকেই আনতে হবে। তারা পাবলিক ফিগার। পাবলিক ফিগার কি জানো? পাবলিক ফিগার হল পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীর মত। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার বিক্রি হয় বাজারে। যে কেউ সে শেয়ার কিনতে পারে। তেমনি পাবলিক ফিগারদের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কথা বিক্রি হয়। রাম-শ্যাম, যদু-মদু কি উদাহরণ হিসাবে আসে কখনো? তুমি পরীক্ষার প্রশ্নে উদাহরণ হিসাবে কিছু লেখ না? কাদের নাম বা কথা লেখ? রহিম-করিমের কথা?
চুপ করেন। আপনার এই প্রস্তাবে আমি কিছুতেই রাজি হতে পারব না। আমকে আর এসব ব্যাপারে ফোন করবেন না।
[চলবে...]