সময়ের সাহসী কারিগর
ইজাজ আহমেদ মিলন
ইসরাফিল আকন্দ রুদ্র
‘স্বাধীনতা’। এ কেবল নিছক শব্দ নয়। বহু ত্যাগ তিতীক্ষার পর পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ, অর্জন করেছি চূড়ান্ত বিজয়। মুক্তির পতাকা আমাদের হাতে। শত্রুর আসরিক আচরণ, বিকট উল্লাস আর নৃশংসতা স্বল্প সময়ে পরাভৃত করা হয় এদেশের মানুষের মনে কাব্যময় স্নিগ্ধতার সঙ্গে সাহসের ইস্পাতদৃঢ়তা আছে বলে। অনাদি অতীতের সংগ্রাম, ভাষার জন্য রক্ত দানের ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধকালে ছিল বাঙালির প্রেরণার বাতিঘর। এদেশের জনজীবনের বাঁকে আছে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের ঐতিহ্য। আসলে এসবই বাংলা জননীর প্রাণের উত্তপ্ত স্পন্দনজাত, তার মাটি থেকে উঠে আসা সাহসের ফোয়ারাস্নাত। সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে এই বীর জাতি বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে ফিরে এসেছে দেশ মাতৃকার ক্রোড়ে। কেউ এসেছে বিজয়ের স্লোগান দিতে দিতে, কেউ আবার নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। অজানা নয়-ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ‘বাংলাদেশ’।
শহীদ’ (আরবি: شهيد šধযīফ, বহুবচনে: شُهَدَاء শুহাদাʾ ; স্ত্রীবাচক: শাহীদা) শব্দটি হলো পবিত্র কুরআনের তথা আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো সাক্ষী। এছাড়াও এর অন্য অর্থ হলো আত্ম-উৎসর্গ করা। শহীদ শব্দটির আরবি অর্থ সাক্ষী হলেও গ্রিক শব্দ সধৎঃুৎং (গ্রিক: μάρτυς – “সাক্ষী”, নতুন টেস্টমেন্ট এ সধৎঃুৎ) এর কাছাকাছি। নিউ টোস্টামেন্ট বা বাইবেল এ একই কথা উল্লেখ্য আছে। শহীদ কুরআনের শব্দগত মূল অর্থ সাক্ষী হলেও হাদীসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী বিশ্বাসের জন্য আত্ম-উৎসর্গকে বুঝানো হয়েছে। ইসলামিক বিশ্বাসের সাক্ষ্যদানে যে সচেতনভাবে গ্রহণযোগ্য মৃতু কামনা করে এবং আত্ম-উৎসর্গ করে তার উপাধি স্বরুপ শহীদ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘুরে ২৫ জন শহীদ পরিবার খুঁজে বের করেন ইজাজ মিলন। পরিবারের সদস্যদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরি করেন। যা পরবর্তীতে ‘১৯৭১:বিস্মৃত সেইসব শহীদ’ নামক গ্রন্থে রূপ নেয়। স্বীকার করতেই হবে তা পরিশ্রমের কাজ, সেই সাথে আনন্দেরও। তাদের শৈশব, দুরন্ত স্বপ্নচারী হওয়ার গল্প, পড়াশোনা, বিয়ে, যুদ্ধ ময়দানে বীরবেশে শেষ নিঃশ্বাস এর অবসান, তাঁদের পরিবারের বর্তমান অবস্থা- সবকিছুই তুলে ধরেছেন পরমযতœ ও মরমী ভাষায় ‘বিস্মৃত সেইসব শহীদ:১৯৭১’ বইটিতে। সকল শহীদের জীবন সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। আমরা সেখান থেকে পঁচিশ জনের জীবন সম্পর্কে জানলাম, এতেই বা কম কিসে ? ইজাজ মিলন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রবর্তিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কার-‘বজলুর রহমান স্মৃতি পদক’ পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জানানোর জন্য, লেখার ভাষায় মুক্তিযুদ্ধকে দেখানোর জন্য বাহবা পাওয়ার যোগ্য অনেকেই। ইজাজ মিলন তাদের মধ্যে অন্যতম। কারণ তাঁর বইটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় গবেষকদের কাজে লাগবে। বইটি আমি কয়েকবার পড়েছি, আবেগে আপ্লুত হয়েছে, অশ্রুপাত করেছি। “কষ্টগুলো পাথর হয়ে গেছে: শহীদ জহির উদ্দিন”,“৪৩ বছরেও থামেনি কন্যার সে কান্না” -এসব শিরোনামের কাহিনীগুলো আমাকে যুদ্ধের ময়দানে দাঁড় করিয়েছে, নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে দেশ মাতৃকার জন্য। ২৫ জন শহীদের বাড়ি শ্রীপুরের ২৫টি গ্রামে। যুদ্ধ চলাকালীন এরা শহীদ হয়েছেন। কেউ কেউ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছেন। এদের অনেকেই পাক সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। দেশের বিভিন্ন রণক্ষেত্রে এরা শহীদ হন। ঘর থেকে টেনে-হিঁচরে বের করে নিয়ে কাউকে কাউকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। কিন্তু এদের লাশ স্ত্রী, বাবা-মায়ের কাছে, ছেলেমেয়ের কাছে পৌঁছে দেয়নি কোনো নরপশুরা। সেসব শহীদের সন্তানদের কাছে পুরো দেশটাই মনে হয় বাবার কবরস্থান! যে কেউ কাঁদবে এ বইটি পড়ে, পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী মানুষেরও অশ্রু গড়াবে।এ বইতে স্থান পেয়েছে উপজেলার টেপিরবাড়ি গ্রামের শহীদ জহির উদ্দিন, খুজেখানি গ্রামের শহীদ শাহাব উদ্দিন, আতলড়া গ্রামের শহীদ গোলাম মোস্তফা, শহীদ শামসুদ্দিন, চকপাড়া গ্রামের শহীদ খন্দকার আবুল খয়ের, নামা ভিটাপাড়া গ্রামের শহীদ মোফাজ্জল হোসেন, শহীদ আলমগীর বাদশা আকন্দ, দক্ষিণ ধানুয়া গ্রামের শহীদ জামাল উদ্দিন, উত্তর চকপাড়া গ্রামের শহীদ আবদুল হালিম, সোহাদিয়া গ্রামের শহীদ সিরাজুল ইসলাম, শহীদ আবদুর রশিদ চিনু, বড়নল গ্রামের শহীদ আমজাদ হোসেন মোড়ল, কেওয়া পশ্চিমখণ্ড গ্রামের শহীদ তহিজ উদ্দিন ও শহীদ আবদুল হালিম, টেপিরবাড়ি গ্রামের শহীদ নায়েক মুহাম্মদ আলী, শ্রীপুর গ্রামের শহীদ আবদুল বাতেন আকন্দ, নিজখোঁজেখারি গ্রামের শহীদ মাইন উদ্দিন, সাতখামাইর গ্রামের শহীদ আজম আলী সরকার, শহীদ মানিক ও শহীদ সালেহা আক্তার, কেওয়ার শহীদ আবদুস সাত্তার ভাঙ্গী, সাতখামাইর লালবাগ এলাকার শহীদ আতর আলী, শহীদ ইসমাইল হোসেন শেখ, দক্ষিণ ধনুয়া গ্রামের শহীদ মাজম আলী মৃধাসহ ২৫ শহীদ। এসব শহীদের মধ্যে অনেকের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বইটির ভূমিকায় সমকালের প্রাক্তন সম্পাদক প্রয়াত গোলাম সারওয়ার লিখেছেন ‘লেখাগুলো আমাকে অশ্রুসিক্ত করেছে। স্বামী ফিরে আসবেন বলে পথের দিকে আজও চেয়ে থাকা শহীদ জয়া আনোয়ারার কথা লিখতে গিয়েই নয়, অন্যদের গল্পেও আবেগ ও বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।’
লেখক বইটির প্রাক-কথনে লিখেছেন, ‘আমি বিজয় দেখিনি। কিন্তু যারা অর্জন করেছেন এ বিজয়, বাঙালি হিসেবে আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন, উপহার দিয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র- সেসব বীর বাঙালিকে দেখেছি। অনেক বীর যোদ্ধার সংস্পর্শ পেয়েছি। তাদের স্মৃতির অথৈ সাগরে অবগাহন করেছি। যুদ্ধকালীন ভয়াবহতার বাস্তব গল্প শুনেছি। এটাও কি কম সৌভাগ্যের? আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো এ সুযোগও পাবে না’। যথার্থ বলেছেন তিনি। এর মধ্যে অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন, এ বছরের বিজয়ের মাসে আমাদের স্কুলে বিজয়ের গল্প শুনাতে আমন্ত্রণ জানাতে চেয়ে ছিলাম বীরমুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম এম.এ সাহেবকে। আর সুযোগ হলো না বিজয়ের গল্প শোনার। ২৩ নভেম্বর ২০১৯ তিনিও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সবাই চলে যাবে, রয়ে যাবে তাদের স্মৃতিরেখা। স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁরা চিরদিন।