সৈন্য হত্যার রহস্য






সৈন্য হত্যার রহস্য
তুফান মাজহার খান

একদা চৈমিনি রাজ্যে একটি সৈন্য হত্যার ঘটনা ঘটেছিল। গণতান্ত্রিক রাজ্য হওয়ায় পুরো রাজ্যে কয়েকবছর অন্তর নির্বাচনের ধুম লেগে যেত। তখন সে রাজ্যে মুক্তফ্রন্ট নামে একটা দল ছিল যারা প্রত্যেক নির্বাচনে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ করত। যদিও প্রধান বিরোধী দল থেকে আর উপরে উঠার সৌভাগ্য হয়নি তাদের কখনোই। অর্থাৎ কিছু ভোটের ব্যবধানে প্রতিবারই হেরে যেত তারা। এভাবে হারতে হারতে তারা একসময় প্রচন্ড রকমের সরকারবিদ্বেষী হয়ে ওঠল। তারা সরকারের নামে পুরো রাজ্যে দুর্নাম ও অপপ্রচার চালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু সরকারের পরিবর্তে নিজেরাই জনগণের অপছন্দের পাত্র হয়ে গেল। তাদের উগ্রবাদী মনোভাব আর স্বেচ্ছাচারিতার দরুন তারা একটি বাজে ও অস্থিতিশীল দল হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। পরেরবার নির্বাচনে তারা বিপুলসংখ্যক ভোটের ব্যাবধানে হারে। তারপরও তাদের হিংসাত্মক মনোভাব আর উগ্রবাদিতা দমন করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে তৎকালীন সরকারপ্রধান সে দলকে উগ্রপন্থী দল হিসেবে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করে। সে দলের সকল কার্যক্রম, প্রচার, পোস্টারিং ও মিটিং-মিছিল সর্বোপরি দলের অনুমতিপত্র বাতিল করা হয়। নিষিদ্ধ হবার পর তারা মোটামুটিভাবে শান্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ রাজ্যে আর কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেনি এবং নিজেদের কার্যক্রমও গুটিয়ে নেয়।
মহারাজ এলেক্স জনসন ছিলেন খুবই চতুর। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এত সক্রিয় একটি দল মহারাজের হুকুমকে এত সহজে মেনে নেওয়ার পাত্র না। যেহেতু মহারাজ মুক্তফ্রন্টকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও তারা কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি অতএব তাদের মনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো ফন্দি রয়েছে। তাই মহারাজ জনসন পুরো রাজ্যে কড়া পাহারা ও গুপ্তচর তৎপরতা বাড়িয়ে দেন যাতে কেউ রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। এমনকি এও ঘোষণা দিলেন যে, যদি কোথাও মুক্তফ্রন্টের কোনো গোপন মিটিং, মিছিল বা প্রচার-প্রচারণা পরিলক্ষিত হয় তাহলে সাথে সাথে যেন তাদের আটক করা হয় এবং মহারাজকে অবগত করা হয়।
বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর হঠাৎ এক ভোরে মহারাজের দরবারে খবর আসে এক রাজসৈন্যকে গতরাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। মহারাজ ঘটনা শুনে ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠেন। মহারাজ তার রাজ্যের সকল নিরাপত্তা বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগকে সৈন্য হত্যার রহস্য উদঘাটন করে আসামীকে বন্দি করার নির্দেশ দেন। টানা একমাস চেষ্টার পরও হত্যার রহস্য যখন বের করা সম্ভব হয়নি তখন তো মহারাজের চোখের ঘুম হারানোর অবস্থা। কারণ মুক্তফ্রন্টের লোকেরা নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে বড় ধরণের কোনো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এভাবে রাতের নির্জনে সৈন্য হত্যা তো শুভ লক্ষণ নয়। এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু মনে করে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তাই কীভাবে সৈন্য হত্যার রহস্য উদঘাটন করা যায় তা ভাবতে ভাবতে মহারাজ দিশেহারা। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। মহারাজ ভাবল, একটা পুরস্কার ঘোষণা করলে কেমন হয়? যে চিন্তা সেই কাজ। মহারাজ রাজ্যে ঘোষণা করল, যে ব্যক্তি সৈন্য হত্যার রহস্য উদঘাটন করে দেবে তাকে একশো স্বর্ণমুদ্রা উপহার দেয়া হবে। ঘোষণা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল গ্রামকে গ্রাম। দলে দলে লোক এসে সৈন্য হত্যার স্পটে গিয়ে ঘটনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করল। কোনোকিছুতেই কিছু হলো না। মহারাজের যখন হাল ছেড়ে দেবার উপক্রম তখন রাজ্যে এক সুদর্শন যুবকের আগমন ঘটল। সে এসে বলল, মহারাজ আমি আপনার সৈন্য হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে পারব। মহারাজ বলল, বলো কী যুবক? তুমি এ কাজ পারবে? যুবক বলল, হ্যাঁ মহারাজ। আপনি শুধু কিছু সৈন্য-সামন্ত দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করবেন। মহারাজ বলল, ঠিক আছে, তোমার যত সৈন্য প্রয়োজন তুমি সাথে নিতে পার। যুবক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিল।
মহল থেকে দু’জন সৈন্য সাথে নিয়ে প্রথমে স্পটে গেল। তারপর সেখানে বেশ কিছুক্ষণ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ করে একটা নিশানা পেয়ে গেল। সে খেয়াল করল, যেখানে সৈন্যকে হত্যা করা হয়েছে সেখানে একটি পোস্টার আধো লাগানো অবস্থায় রয়েছে। প্রথমে পোস্টারটি পড়ে দেখল সেটা মহারাজের বিরুদ্ধে ছাপানো বিদ্রোহী বাণীতে ভরপুর একটি পোস্টার। তার থেকে সামান্য দূরে একইরকম আরেকটি পোস্টার। তার থেকে আরেকটু দূরে আরও একটি। এভাবে একদম মূল সড়ক পর্যন্ত একই পোস্টার লাগানো। যুবকটি আরও একটি বিষয় নিশ্চিত হলো যে, পোস্টারটি শুধুমাত্র সৈন্য যেখানে কতল হয়েছে সে পর্যন্তই লাগানো। এর পরে আরও কোথাও লাগানো নেই। অর্থাৎ সৈন্য হত্যার ঘটনাটি এই পোস্টারকেন্দ্রিকই হবে। যুবকটি আরও চিন্তা-বিবেচনা করে কয়েকজন সৈন্যকে পুরো রাজ্যের সকল ছাপাখানার গত এক মাস আগের যত বর্জ্য আছে সব একে একে এনে দেয়ালে লাগানো পোস্টারের সাথে মিলানোর হুকুম দিল এবং কাজটি খুবই গোপনে করতে বলল। তারপর ছাপাখানায় গিয়ে মহারাজের হুকুমের কথা বলে একে একে বেশ কয়েকটি ছাপাখানা থেকে বর্জ্যসমূহ একত্র করে। সবগুলো কাগজ একটা একটা করে মিলিয়ে দেখার পরও কোনো কাগজের সাথে পোস্টারের মিল পাওয়া গেল না। তখন যুবকটি সৈন্যদের জিজ্ঞেস করল রাজ্যের আর কোনো ছাপাখানা থেকে বর্জ্য আনার বাকি আছে কিনা। সৈন্যদের একজন বলল, না জনাব। আর কোনো ছাপাখানাই বাকি নেই তবে রাজ্যের শেষ প্রান্তে, একেবারে সীমান্তের কাছাকাছি একটা ছাপাখানা আছে। সেটা এখান থেকে তিন দিনের পথ। যুবকটি বলল, তাহলে ওটাতেও যেতে হবে। আমি মহারাজকে কথা দিয়েছি। তাছাড়া আমি এত সহজে হেরে যাবার পাত্রও নই।
পরদিন যুবকটি কিছু সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ঐ ছাপাখানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। তিনদিনে সেখানে পৌঁছে ছাপাখানার মালিকের কাছে বর্জ্যের কথা বললে মালিক প্রথমে রাজি হয় না, নানা বাহানা করে। তখন যুবকটির কাছে আরও সন্দেহ হয়। যুবক বলে, না এসব কথা শুনব না। বর্জ্যগুলো আমার চাই-ই চাই। মালিক বলে, সেগুলো তো আমরা রেখে দিই না। মাসের শেষে সব বিক্রি করে দিই। যুবক বলল, যেখানে বিক্রি করেন সে ঠিকানাই দিন, আমরা সেখানেই যাব। মালিক কেমন যেন কাচুমাচু করে। তখন যুবক সৈন্যদের হুকুম দেয়, ছাপাখানার মালিককে আটক করতে। মালিক পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও শেষে ধরা পড়ে যায়। যুবকের মুখে মহারাজের শাস্তির কথা শুনে মালিক ভয় পেয়ে যায়। সে আস্তে আস্তে সব স্বীকার করে। মালিক বলে, হ্যাঁ, বেশ কিছুদিন পূর্বে আপনাদের রাজ্য থেকে কিছু লোক আসে এবং কয়েক হাজার কাগজ ছাপাতে দিয়ে যায়। আমি যেন কাগজ ছাপানোর কথা কাউকে না বলি সেজন্য আমাকে তারা বেশকিছু অর্থও দিয়ে যায়। যুবক বলল, আপনি কি তাদের চেনেন? মালিক বলল, তাদের একজনকে আমি চিনি। যার নাম ডন স্যামুয়েল সন। তিনি মুক্তফ্রন্টের সভাপতি। এবার আমাকে ছেড়ে দিন। যুবক বলল, আপনি পোস্টারগুলোর বর্জ্য যদি আমাদের না দেন তাহলে আপনাকে ছাড়া হবে না। কয়েদখানায় বন্দি করা হবে। তোপের মুখে পড়ে ছাপাখানার মালিক রাজি হয়। সকল আলামত বের করে দেয়। যুবকটি আলামতগুলো সাথে নিয়ে রাজ দরবারে হাজির হয়। মহারাজকে পুরো ঘটনা খুলে বললে মহারাজ তো রেগে আগুন। মহারাজ সেনাপতিকে হুকুম দেন মুক্তফ্রন্টের সভাপতিকে আটক করার জন্য। ডন স্যামুয়েল সনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে অকপটে সব দোষ স্বীকার করে। সে বলে, যেহেতু মহারাজ মুক্তফ্রন্টকে নিষিদ্ধ করেছিলেন তাই আমরা বাধ্য হয়ে রাতে মাঠে নেমেছিলাম। আমার দু’জন লোক ঐ এলাকায় পোস্টার লাগাচ্ছিল। এমন সময় পাহারারত মহারাজের এক সৈন্য তাদের পাকড়াও করার চেষ্টা করে। কিন্তু সৈন্য যেহেতু একা আর আমার লোক দু’জন তাই তারা অতি সহজেই সৈন্যকে হত্যা করে ফেলে।
মহারাজ সব শুনে মুক্তফ্রন্টের সভাপতি ডন স্যামুয়েল সন ও হত্যাকারী দু’জনকে যাবজ্জীবনের জন্য কয়েদখানায় আটকের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে সেই গোয়েন্দা যুবককে মহারাজের ওয়াদা অনুসারে একশো স্বর্ণমুদ্রা দেয়ার জন্য পুরো রাজ্যে খোঁজা হয়। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকদিন পর এক বার্তাবাহক মহারাজের কাছে একটি বার্তা নিয়ে আসে। বার্তাটি ঐ গোয়েন্দা যুবকই মহারাজের কাছে পাঠিয়েছে।
বার্তাটি নিম্নরূপ:

প্রিয় আব্বাহুজুর
আমার সালাম জানবেন। আমি ঐ গোয়েন্দা যুবক যে কিনা মুক্তফ্রন্টের বৃহৎ ষড়যন্ত্র থেকে আপনাকে রক্ষা করেছে। আমি শুধু সে-ই নই বরং আমি আপনার এক পুত্রও। আপনি আজ থেকে বিশ বছর আগে এক শিশুপুত্রসহ আপনার এক রাণীকে মিথ্যা অপবাদে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন। আমি আপনার সেই শিশুপুত্র যে কিনা আজ তার মায়ের নির্দেশে আপনাকে বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছে। যেহেতু তাদের দলের সভাপতি আটক হয়ে গেছে। সুতরাং আপনার আর ভয় নেই। তারা আর দল পুনরায় গঠন করার সাহস পাবে না।
আপনার সুদীর্ঘ জীবন আর সুন্দর রাজত্ব কামনায়...
আপনার বনবাসী পুত্র
এলেক্স গিয়ারসন

চিঠিটা পড়ে যেন মহারাজের চোখ ছলছল করে ওঠল। সে এত তার হারানো পুত্রকে এত কাছে পেয়েও একটি বার বুকে জড়িয়ে ধরতে পারল না। একটি বার বাবা ডাক শুনতে পারল না। সে ভাবে, আমি বড় অন্যায় করেছি। ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন না। আমার স্ত্রী-পুত্রকে আমি বিনাদোষে এত বড় সাজা দিলাম।
পরবর্তীতে অনেক খোঁজ করেও এলেক্স গিয়ারসন এবং তার মাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট