ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : পর্ব ০৫






ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন

[গত সংখ্যার পর]
জানি না কার ডাক শুনে ঘুম ভাঙল।
মিঃ সোম মজুমদার, শুনতে পাচ্ছেন?
কে? চোখ বন্ধ রেখেই জিজ্ঞেস করলাম।
আপনার সাথে জরুরি কথা আছে। ওঠে বসুন। আমি পুরোপুরি জেগে গেলাম। ওঠে বসতে গিয়ে পায়ের ব্যথা আবার অনুভব করলাম। ঘরটা অন্ধকার। কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। মিজান মিয়া কোথায়? সে তো এখানেই ঘুমিয়েছিল।
প্লিজ, ভয় পাবেন না?
কেউ আমাকে অভয় দিচ্ছে। এবার দেখতে পেলাম কেউ আমার চেয়ারে বসে আছে।
কে আপনি?
রুমের বাতি জ্বেলে দিতে পারেন। আমি আজ বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। আমার উদ্দেশ্য, আপনার সাথে কথা বলা। তাই আবারও বলছি, প্লিজ ভয় পাবেন না।
সুইচ অন করলাম। বাতিটা জ্বলে ওঠল।
একি! এ তো সেই তরুণ, যে আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।
তুমি আবার এসেছ? কেন এসেছ?
মিঃ সোম, উত্তেজিত হবেন না। সে রাতের আচরণের জন্য দুঃখিত।
আমি আমার জুনিয়র আমিকে দেখতে পাচ্ছি। সে আজ কী মতলব নিয়ে এসেছে কে জানে?
আমিও, দুঃখ প্রকাশ করছি। তোমাকে মেরে রক্তাক্ত করার জন্য। ভদ্রতার খাতিরে কথাটা বললাম।
মিঃ সোম আমি আপনার এ কথা শুনে খুশি হয়েছি।
খুশি হবার মতো তোমাকে কিছু বলিনি।
না বললেও, আমি খুশি হলাম। সে রাত্রে আমি রক্তাক্ত হইনি। রক্তপাত হলে এখানে সে চিহ্ন থাকত নিশ্চয়ই। তাছাড়া চতুর্মাত্রিক জগতের কারোর দেহ রক্ত-মাংসে গড়া নয়। সে রাত্রে আপনার সাথে আমার কথা-ঝগড়া, সংলাপ হয়েছিল স্নায়ু কেন্দ্রিক যোগাযোগের মাধ্যমে। বাস্তবে আপনার স্নায়ু সম্পূর্ণ সজাগ ছিল, সে স্মৃতি এখনও আপনার মস্তিষ্কে সঞ্চিত আছে।
ওকে আমি হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলাম। তোমার ওসব কথা শুনতে চাই না। একটি প্রশ্ন করব তোমাকে।
নির্ভয়ে করুন।
তোমার এ চেহারা আমাকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে।
জানি মিঃ সোম। এ চেহারা আপনার উড়তি বয়সকে মনে করিয়ে দেয়, তাই তো? আমার নিজস্ব কোনো চেহারা নেই, কারণ আমি চতুর্মাত্রিক জগতের বাসিন্দা। সেখানে সবই অদৃশ্যমান। প্রথম থেকেই বুঝতে পারছি, এ চেহারা আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। বলতে পারেন আমি আপনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছি। তবে এখন আর সেটা করতে চাই না, আপনি চাইলে অন্য কারোর অবয়ব নকল করতে পারি।
ঘুমিয়ে আছি না, জেগে আছি তা বুঝার চেষ্টা করলাম। না, জেগেই আছি। মিজান মিয়া কোথায়? মেঝেতে তাকিয়ে দেখলাম, সে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।
তরুণটির কথা শুনে সামান্য কৌতূহল উঁকি দিলো।
ঠিক আছে, তাই করো।
আপনার পছন্দের কারোর কথা চিন্তা করুন, যার সাথে আপনার ভাল বন্ধুত্ব। আমি তার অবয়ব ধারণ করতে চাই।
সেটা কী করে সম্ভব?
কারণ, আপনার মস্তিষ্কের স্নায়ুর সাথে আমি অনেক আগেই যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়েছি।
একমুহূর্ত উৎসবের কথা ভাবলাম। তরুণটি উৎসবের চেহারায় আমার সম্মূখে দাঁড়িয়ে। এখনো ওর মূল উদ্দেশ্য ধরতে পারিনি। তাই ঝটপট জিজ্ঞেস করলাম, তোমার আসল কথা বলো।
আপনার দাদাজানের, ডায়েরিগুলো কেন পড়েছি সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই জানতে চান?
হ্যাঁ।


তাহলে একটু পেছন থেকে বলি, আপনার দাদাজান নিঃসন্দেহে একজন অসাধারণ মেধাবী গণিতজ্ঞ ছিলেন। গাণিতিক উপায়ে তিনি মহাজাগতিক নানা রহস্য উদঘাটনে মনোযোগী হন। সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছেও হতাশ হয়ে যাচ্ছিলেন। এর পেছনে কারণ ছিল, তিনি সারাজীবনে একটি মাত্র প্রেম করেছিলেন। সে প্রেমের ব্যর্থতা তাঁকে সবসময় কুঁড়ে কুঁড়ে কষ্ট দিত। প্রকৃতপক্ষে তিনি সে স্মৃতি মনে করে কষ্ট পেতে ভালোবাসতেন। মেঘাদ্রি, নামের মেয়েটির মুখম-ল তিনি প্রায়ই তাঁর মস্তিষ্কে আঁকতেন। যাক সে কথা, আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছিল, আপনার দাদাজানকে সাহায্য করার জন্য, উৎসাহ দেবার জন্য। কারণ, আমরা সবাই বহুমাত্রিক জগতের বাসিন্দা, আমাদের মধ্যকার যোগাযোগ এক নতুন বিপ্লবের জন্ম দিতে পারে। ত্রিমাত্রিক জগতের সাথে চতুর্মাত্রিক জগতের স্বল্পস্থায়ী ভ্রমণ সম্ভব হয়েছে, যে উপায়ে আমি আপনার কাছে এলাম। এ পদ্ধতিটি চতুর্মাত্রিক জগতের বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছিলেন। কিন্তু স্থায়ীভাবে কোনো যাতায়াত বা যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। আপনার দাদাজান, তাঁর থিওরিতে একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক ও চতুর্মাত্রিক জগত ভ্রমণের একটি সরল ফর্মূলার কথা উল্লেখ করেছেন। এ চারটি জগতের জন্য তিনি মোট আটটি সমীকরণও সাজিয়েছেন। সে সমীকরণগুলো প্রতিটি জগতে প্রবেশ ও প্রস্থান সংক্রান্ত। আমি আপনার দাদাজানের সাথে সর্বপ্রথম সাক্ষাত করি পদ্মার পাড়ে। তখন তিনি মর্নিং ওয়াক করছিলেন। তাঁর সাথে কথা বলতে গিয়ে, আমি অনেক নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। তিনি কিছুতেই আমার অস্তিত্বকে স্বীকার করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি আমাকে তাঁর কাল্পনিক চিন্তা বলে বরাবরই অগ্রাহ্য করেছেন। বার বার প্রমাণ দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। তবু আমি হাল ছাড়িনি। নিরবে তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলাম।
একদিন ড. রিয়ন সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচ- জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যায়। তাঁকে সাহায্য করার জন্য অনুমতি চাইলাম। তিনি হেসে বিদ্রুপ করে বললেন, তুমি তো আমার কল্পনা, তুমি আমাকে কিভাবে সাহায্য করবে? আমাকে বিরক্ত করো না, আমি এখন কল্পনায় মেঘাদ্রির সাথে কথা বলব।
মানুষটা অসুখে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। মৃত্যুর পথে ধাবিত হচ্ছে। অথচ এখনো সে তাঁর প্রেমিকার স্মৃতি আঁকড়ে আছে। আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম, রিয়ন সাহেবকে কোলে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। যখন তাঁকে নিয়ে যাচ্ছি, তিনি সব কিছুই বুঝতে পারছেন। তবু এ ঘটনাকে স্বপ্ন ভেবে নিলেন। তখন বলে ওঠলেন, স্বপ্ন নিয়ে সূত্র ও সমীকরণ তৈরি করা খুব জরুরি। এর ফলে স্বপ্নে দেখা জগত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত। স্বপ্নও এক ধরনের জগত ভ্রমণ।
আমি তখনও কারোর অবয়ব গ্রহণ করিনি। ড. রিয়ন সাহেবের অসুস্থ্য দেহটা দু’হাতে তুলে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার অসাবধানতা একটি নতুন ঘটনার জন্ম দিলো। যা আমার জন্য কল্যাণকর, ও পরিশেষে আজো পর্যন্ত অকল্যাণকর হয়ে আছে। একটি মানুষ ভেসে ভেসে হাসপাতালে আসছে দেখে, আশপাশের লোকজন অবাক দৃষ্টিতে দেখছিল। ডাক্তার, রিয়ন সাহেবকে দেখেই চিনতে পারলেন। তাঁকে শূন্যে দেখে তিনি খানিকটা ভড়কে গেলেও, পরে এটা নিয়ে ভিন্ন কিছু ভেবে নিলেন। রিয়ন সাহেব সুস্থ্য হবার পর, ডাক্তার সাহেব তাঁকে অভিনন্দন জানাতে এসে বলেছিল, রিয়ন সাহেব, আপনার শূন্যে ভ্রমণের দৃশ্য সত্যিই অবাক করার মতো। এটা নিশ্চয়ই, আপনার নতুন কোনো সমীকরণের কেরামতি? সত্যিই, অভিকর্ষ ত্বরণকে এভাবে কেউ কন্ট্রোল করতে পারবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। অথচ চোখের সামনে তা দৃশ্যমান প্রমাণ। অতুলনীয় রিয়ন সাহেব, ধন্য এদেশ, আপনাকে নিয়ে সারাবিশ্বের বুকে আমাদের কত গর্ব।
রিয়ন সাহেব ডাক্তারের আচরণে রেগে গেলেন। ডাক্তারকে চিকিৎসা নেবার পরামর্শ দিলেন। হতভম্ব ডাক্তার পিছু হটে গেলেন। ঠিক তখন আমি রিয়ন সাহেবেকে বললাম, ডাক্তার সাহেব যা বলেছেন, সবই সত্যি। কারণ আমি আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। হাসপাতালের সবাই সে দৃশ্য দেখে অবাক হয়েছিল। তাই তো ডাক্তার সাহেব বিষয়টা আপনাকে বলেছেন।
এ কথা শুনে এই প্রথম রিয়ন সাহেব আমার দিকে কড়া নজরে তাকালেন। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সবকিছু জিজ্ঞেস করলেন। সবাই বিস্তারিত জানাল।
বাসায় ফিরে আসার পর, তিনি আমার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলেন। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করে বাসার সবধরনের কাজে সাহায্য করতাম। এই ধরুন, চা তৈরি করা, রান্না-বান্না, বিছানা গুছানো, কাপড় কাঁচা, মেঝে পরিষ্কার করা, পদ্মার পাড়ে ঘুড়ি উড়ানো, দোকান থেকে খাতা-কলম কিনে আনা প্রভৃতি। কদিন পড়েই তিনি বাসা পরিবর্তনের জন্য ওঠে পড়ে লাগলেন। সেখানেও, সবধরনের কাজ করেছি। ট্রাক ভর্তি চেয়ার, টেবিল, আলমারি, খাট, বই-খাতা, ডায়েরি সবধরনের মালামাল, ওঠানো নামানোর দায়িত্ব ছিল আমার উপর। শালবনের ভেতর দিনগুলো ভাল কাটছিল। তিনি ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলার সমীকরণগুলোর দিকে মনোযোগ দিলেন। একে একে তিনি সাফল্যের সাথে তা সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু.....
আমি তরুণটির দিকে মাথা তুলে তাকালাম।
কিন্তু কী? বলো
তিনি ইচ্ছে করেই, এমন এক দুর্বোধ্য ভাষায় সে লেখাগুলো লিখলেন যা, তিনি ব্যতীত অন্য কারোর পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়। খসড়া কাগজগুলো একদিন মাঝরাত্রে পুড়িয়ে দিলেন।
এ পর্যন্ত বলে তরুণটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো কিছু একটা ভাবছে। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল, টেবিলের দিকে। সেখানে পানির জগের পাশে একটি ডায়েরি। এই সেই ডায়েরি যা আমি প্রথমরাতে দেখেছিলাম। ডায়েরিটি দখল করার মনোবাসনা জেগে ওঠল। পরক্ষণেই মনে পড়ল, সে আমার মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছে।
বলে ওঠলাম, তুমি একটু এদিকে আসবে? আমি পানি পান করব।
তরুণটি হুশ ফিরে পেয়ে বলল, হু, ঠিক আছে।
সে চেয়ারের কাছ থেকে সরে এসে আমাকে সেখানে যাবার সুযোগ করে দিলো। চেয়ারে গিয়ে বসলাম। একগ্লাস পানি ঢক ঢক গিলে ফেললাম।
হ্যাঁ, তারপর কী হলো? আমি তোমার কথা শুনতে আগ্রহী। তোমাকে কী নামে ডাকতে পারি?
আমার সাংকেতিক নাম গঞ৬৬৯। এ নামটি আপনার কাছে পছন্দ না হলে অন্য যেকোনো নামে ডাকতে পারেন।
হেসে বললাম, ঠিক আছে। তোমার নাম দিলাম অযুত।
আমার সাবলীল আচরণে সে খানিকটা স্বস্তি পেল। আমি ওর দিকে চোখ রেখে ডায়েরিটি লুকানোর চেষ্টা করছি।
অযুত, তারপর কী হলো?
রিয়ন সাহেব, একদিন আমাকে বললেন, তুমি এখান থেকে বিদেয় হও, আমি তোমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছি। তারপর তিনি বাসার কাজের জন্য একজন লোক ঠিক করলেন। লোকটার নাম শাজান মিয়া।
অযুত কথা বলা থামিয়ে চুপ করে রইল।
মিনিট পাঁচেক পর বলল, আপনার দাদাজান, মারা যাননি। তিনি বেঁচে আছেন।
আমি চমকে ওঠলাম। কী বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি। তিনি আমার সাথে একটি চালাকি করেছেন। ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা ব্যবহার করে যে সমীকরণ তৈরি করেছিলেন, সে ক্ষেত্রে তিনি আমার সাহায্য নিয়েছিলেন।
কী ধরনের সাহায্য?
চতুর্মাত্রিক জগত থেকে ত্রিমাত্রিক জগতে ভ্রমণ সম্পর্কিত আমাদের নিজস্ব একটি সমীকরণ রয়েছে। এটি স্বল্প স্থায়ী ভ্রমণের জন্য। যেভাবে আমি ত্রিমাত্রিক জগতে এলাম। সে সমীকরণটি রিয়ন সাহেবের কাছে স্বেচ্ছায় প্রকাশ করার প্রস্তাব দেই এই শর্তে যে তাঁর সমীকরণগুলো আমার সাথে শেয়ার করবেন। আমাদের সমীকরণটি ফলো করে তিনি দ্রুত ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলার সমীকরণগুলোর সমাধান শুরু করেন। তিনি সবগুলো সমীকরণের সমাধানেও পৌঁছতে পেরেছিলেন। সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর নিজস্ব ভাষায়, যাতে আমি বুঝতে না পারি। তিনি ইচ্ছে করে আমাকে ধোঁকা দিয়েছেন।
তারপর দাদাজান কী করলেন? এ প্রশ্নটা করে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ওর চোখে চোখ রেখে তাকালাম। তরুণটি কিছু একটা ভাবতে লাগল। আমি এক হাত পেছনে প্রসারিত করে ডায়েরিটাকে চেপে ধরলাম। ধীরে ধীরে ডায়েরিটা নিচের দিকে নিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। একটা অস্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। অযুতের সন্দেহভরা দৃষ্টি আমাকে বিদ্ধ করছে।
এরপর আপনার দাদাজান ঐ সমীকরণগুলো ব্যবহার করে দ্বিমাত্রিক জগতে প্রবেশ করেন। আপনারা যার মৃতদেহ পেয়েছেন, তিনি আপনার দাদাজান নয়। ড. রিয়ন সাহেব এখনো জগত ভ্রমণে ব্যস্ত, তাঁর মৃত্যু এই মুহূর্তে ধ্রুবক হয়ে আছে।
অযুতের এ কথাটা আমার মধ্যে একধরনের আশা বা ভালোলাগা তৈরি করলেও পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতে পারিনি।
অযুত বলল, আমার ধারণা, তিনি কোনো ডায়েরি বা খাতায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমরা সে সূত্র ও সমীকরণগুলো খুঁজে পেলে এক মহাবিপ্লবের সূচনা করতে পারি। আমি জানি মিঃ সোম, আপনি আপনার দাদাজানকে দেখতে চান, তঁঝার ¯েœহ-মমতা পেতে চান। আপনি ইচ্ছে করলে এটা সত্যও হতে পারে। আমি আপনাকে একটি বিনীত অনুরোধ করব।
অযুত, কী অনুরোধ বলো।
আমাকে এ ডায়েরিগুলো সার্চ করার সুযোগ দিন প্লিজ। আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনার দাদাজানের মতো আচরণ করব না, চতুর্মাত্রিক জগতে কেউ শর্ত ভঙ্গ করে না। আমি আপনাকে আপনার দাদাজানের সাথে সরাসরি সাক্ষাত স্থাপন করে দেবো।
অযুতের কথা বলার চমকপ্রদ বিনয় ভঙ্গির কাছে আমি কিছুটা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। ওর কথায় কিছুটা ভেবে রাজি হয়ে বললাম, ঠিক আছে। তোমাকে সে সুযোগ দেবো। আরেকটা শর্ত তোমাকে মানতে হবে। তোমার অস্তিত্ব যেন আমি ব্যতীত অন্য কেউ বুঝতে না পারে।
ঠিক আছে মিঃ সোম। অযুত এ কথা বলে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। একটি ডায়েরি খুলে পড়া শুরু করল।
বললাম, এই মুহূর্তে যদি মিজান জেগে ওঠে?
আমি চলে যাব। কেবলমাত্র নির্জন পরিস্থিতি বা আপনার উপস্থিতিতে আবার আসব।
ঠিক আছে, অযুত। জেনে রেখো, যদি শর্ত ভঙ্গ করো, তবে চরম শাস্তি ভোগ করবে।
অযুত বাধ্য রোবটের মতো মাথা নাড়ল।
আধঘণ্টা কেটে গেল। অযুতকে লক্ষ্য করছি। সে একটানা পড়ে যাচ্ছে, ডায়েরির একটার পর একটা পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। ওকে বিদেয় করার একটা ভাবনা মাথায় উঁকি দিলো। আমি জগ থেকে সামান্য পানি মিজান মিয়ার গায়ে ছিঁটিয়ে দিলাম। মিজান মিয়া সজাগ হতেই, মুহূর্তে অযুত অদৃশ্য! আজ ঘর গরম হবার মতো কোনো পরিস্থিতির সম্মূখীন হইনি, বিগত দিনগুলোতে তাপমাত্রা বেড়ে যাবার পেছনে ওরই হাত ছিল। ওর উদ্দেশ্য ছিল আমাকে দাদাজানের ঘর থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। উষ্ণ গ্যাস কিংবা অন্য কোনো উপায়ে নিশ্চয়ই সে এ কাজটা করেছে।
পেছনে ফিরে তাকালাম, টেবিলের উপর লাল বর্ডারের সে ডায়েরিটি নেই। ওর অতিশক্তির মাত্রা আমার জানা নেই, তবে সে নিঃসন্দেহে অতিচালাক ও অভিনয়ে পারদর্শী।


অনেকদিন ধরে দাদাজানের ডায়েরিগুলো পড়ছি, উৎসাহের একমাত্র উৎস নীলা। বেশিরভাগ বিষয় আমার কাছে দুর্বোধ্য ও ধোঁয়াচ্ছন্ন লাগছে। প্রতিটি পাতা গাণিতিক সমীকরণ ও হিসাব-নিকাশে ভরপুর। সমীকরণগুলোর প্রয়োগক্ষেত্র তিনি বর্নণাসহ লিখে রেখেছেন, সেটাও আমার ভাবনার বাইরে।
নীলা প্রতিদিনের মতো সকালে এখানে আসে। ডায়েরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে ওর দুপুর হয়, তারপর ফিরে যায় গেস্টহাউজে। সেদিন রাতের পর ওর গেস্টহাউজে আর যাওয়া হয়নি। একটা প্রশ্ন আমাকে হঠাৎ ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল। গেস্টহাউজে সেদিন নীলা ব্যতীত অন্য কাউকে চোখে পড়েনি। জানি না গভীর রাত হবার কারণেই কি এমনটি দেখলাম, না সত্যিই সেখানে কেউ নেই। এত বড় গেস্টহাউজে নীলা একা থাকবে, সেটা কি সম্ভব? সম্ভব-অসম্ভব যাইহোক, আরেকটা দিন সেখানে আমার যাওয়া উচিত। এবার মিজান মিয়াকে সাথে নিয়ে যাব। কারণ এ এলাকা সম্পর্কে তার অজ্ঞতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া উচিত। সে রাতে গেস্ট হাউজের কাছে একটি বড় বটগাছ দেখেছিলাম। সে গাছে কি বটফল আছে? যদি থাকে তাহলে কী হবে? কিছুদিন আগে দেখা সেই স্বপ্নের সাথে মিলে যাবে? নীলা কি বলবে, সোম এই ফল খেতে যেও না, এ ফলে বিষ আছে। তারপর কি বলবে চলো নদীর ওপাড়ে যাই, এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। কিন্তু সে বটবৃক্ষের পাশে তো কোনো নদী নেই। না তেমনটি হতে পারে বলে মনে হয় না।
অযুত নামের তরুণটি আজকাল আমার ঘরে প্রায়ই আসে, ওর আচরণ ভৃত্যের মতো। তার সাথে আমার সম্পর্কটা অনেকটা সহজ হয়ে ওঠেছে। অযুতের সাথে আমার বয়সের পার্থক্যটা জানা নেই। তবে আজকাল সে আমাকে তুমি সম্বোধন করে। ঐ রাতের মতো কুৎসিত আচরণ এখন তার মধ্যে নেই। বাহ্যিক আচরণে সে খুব সরল ভাব প্রকাশ করে। অথচ, তার ভেতরটা কূটচক্রে ভরপুর, যা আমার অজানা নয়। আমার বার বার মনে হচ্ছিল, দাদাজান ডায়েরিতে ঐ মূল্যবান ফর্মূলা বা সমীকরণ কিছুই লিখে রাখেননি। যেহেতু শত্রুর দূরভিসন্ধি তিনি টের পেয়েছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই বিকল্প কোনো পথ বেছে নিয়েছেন, যা কারোরই হয়তো জানা নেই।

দুপুরের পর মিজান মিয়া এসে হাজির।
স্যার, বাপজান আপনার সাথে কথা কইতে চায়। বাপজানের শরীরডা ভালা না।
মিজান মিয়ার কথা শুনে দেরি করতে পারিনি। দ্রুত তার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি, চৌচালা বেড়ার ঘরে শাজান মিয়া মেঝেতে চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছে। শাজান মিয়ার শরীরের চামড়া ভেদ করে পাঁজরের হাড়গুলো বানের শেষে জমির আল জেগে ওঠার মতো স্পষ্ট হয়ে আছে। মিজান মিয়া আমাকে একটি জলচৌকি এনে দিলো। আমি কাছে গিয়ে বসতেই, শাজান মিয়া বালিশের নিচ থেকে একটি ছোট্ট ডায়েরির মতো একটি নোটবুক আমার দিকে এগিয়ে দিলো।
বলল, আপনার দাদাজান আমারে বলছিল, যতœ কইরা রাখতে। জিনিসটা নষ্ট হবার সুযোগ দেই নাই। কইছিল, এইটার পিছনে শত্রু লাগছে। তাই ঐ বাড়িতে রাখা নিরাপদ না।
আমি নোটবুকটি পকেটে রাখলাম। শাজান মিয়া স্বেচ্ছায় ধীরে ধীরে থেমে থেমে নানা কথা বলে যাচ্ছে।
দাদাজান শাজান মিয়াকে চাকুরি দেন, এখানে আসার ঠিক এক বছর পর। এলাকার মানুষজন প্রথমদিকে কৌতূহল নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দাদাজানকে দেখার চেষ্টা করত। এতে তিনি কারোর সাথে রেগে যাননি। বরং সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন, এভাবে যখন-তখন কারোর সাথে দেখা করতে তিনি ইচ্ছুক নন। আশপাশের কেউ তাকে কোনোদিন বাজারে যাওয়া বা অন্য কোথাও যেতে দেখেননি। তাই মানুষজনের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছিল, এ লোকটা কি না খেয়েই বেঁচে থাকে? কথা ওঠেছিল লোকটা সাধারণ মানুষ নয়, দরবেশ টাইপের কিছু। দেখতে তো সাক্ষাত রবীন্দ্রনাথ, আর কাজকর্ম অজানা। সবকিছু তাদের কাছে রহস্যই রয়ে গেল। কৌতূহলের দৌড় বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। তবে শাজান মিয়া কাজে যোগ দেবার পর তা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। না, মানুষটির ক্ষুধা তেষ্টা বলে কিছু আছে, তাই তো তিনি এ গাঁয়েরই একজনকে রান্নার দায়িত্ব দিয়েছেন।

শাজান মিয়া কথার সূচনা পর্ব শেষে কিছুক্ষণ থেমে বলল, আমি কোনো দিন কাজে না গেলেও উনার সমস্যা হইতো না, কোনো এক জ্বীন তাঁর সেবা করত। পুরো বাড়ির কাজ সেরে ফেলত। এই কারণে, রিয়ন সাহেব ঐ জ্বীনের উপর খুব রাগ হইত, বকাঝকা করত। বলত বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে। হাজারবার শুনছি, বলত, ডায়েরিতে হাত দিবি না, বই ধরবি না, আমারে ডিস্টার্ব করবি না। আমি যদি চুলায় চা বসাতাম, ঐ জ্বীনটা আমার আগে সাহেবরে চা বানায়া নিয়া যাইত। তখন রিয়ন সাহেব আমার উপর ফায়ার হইয়া যাইত। আমি ডরে চুপচাপ থাকতাম, কোনো উপায় তো নাই। মাঝে মাঝে কইত, ঐ ছোকরা যদি আবার আশপাশে আসে সোজা ঘাড় ধাক্কা দিয়া বের কইরা দিবি। আমি কেবল শুইন্যা যাইতাম, জ্বীনের লগে তো আমি লড়াই করতে পারমু না। তবে যদি জ্বীন বশ করার মন্ত্র শিখায়া দিত, তাইলে ঠিকই ঐ বজ্জাতটারে সাইজ কইরা দিতাম। একদিন, রিয়ন সাহেবরে কইছিলাম, স্যার মন্ত্রডা শিখায়া দেন। ঐ বজ্জাত জ্বীনের শাস্তির ব্যবস্থা করি। সাহেব প্রথম দিকে রাইগ্যা গেলেও, পরে হাসা শুরু করল। কইল, আরে বোকা, ঐটা জ্বীন না, জ্বীন-ভূত বলতে দুনিয়াতে কিচ্ছু নাই। মন্ত্র-টন্ত্র সব মিথ্যা। সত্য অইল গিয়া সূত্র। ঐ ছোকরা আমার পিছে লাগছে ফর্মূলাটা চুরি করতে, তা কি হইতে দিবো?
আপনার দাদাজানের কথা ভেদ করতে পারলাম না, ঐ ছোকরা যদি জ্বীন না হইয়া থাহে, তাহলে ঐটা কী?
শাজান মিয়া আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল। তাঁর উত্তর দিতে পারলাম না, বরং তাকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদাজান যেদিন মারা গেল, সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন?
প্রশ্ন শুনে আঁতকে ওঠল শাজান মিয়া। দম নিয়ে বলল, সেদিন ঐ বাসায় ছিলাম না। ছুটি নিয়া বাড়িতে আইসা পড়ছিলাম। সন্ধ্যা রাতেও মানুষটা দিব্যি ভালা, বয়স অইলেও একদিনও অসুখে পড়তে দেহি নাই। এমুনকি দাঁত ব্যথা, বাত ব্যথা, শরীর ব্যথা এইসব পর্যন্ত ছিল না। বিদায় নিয়া বের হইব, তহনই ঐ ছোটো বইটা দিলো। কইলো, এটা যতœ করে বাসায় রাখবা। বিড় বিড় করে কইল, শত্রু পিছে লাগছে, তাই নিরাপত্তার অভাব।
শাজান মিয়া কয়েকটা কাশির আক্রমণ প্রতিহত করে বলল, সাহেব, কইছিন ঐটা অইল কাইটিরিন সূত্র জানার সিঁড়ি।
শাজান মিয়া আর কিছুই বলতে পারল না, কাশিতে লুটিয়ে পড়ছে। আমি মিজান মিয়ার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, তোমার বাবার ওষুধ কেনার জন্য রাখো। বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

শেষ বিকেলে বাড়িতে পৌঁছলাম। শাজান মিয়ার কথাগুলো অসংলগ্ন হলেও অনেক তথ্য সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। অযুত যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে দাদাজানের কাছে এসেছিল, তা শাজান মিয়ার জবানবন্দিতে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠল। অযুতের কথার কিছু সত্যতাও মিলল। দাদাজানের মতো আমারও উচিত তাকে এখান থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করা। কিন্তু কিভাবে? এখন আমার কী করা উচিত? এসব ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দরোজার ওপাশে আকাশের দিকে তাকালাম। পশ্চিমাকাশের আবিরের রূপ রেশ পূর্বাকাশকেও ছুঁয়েছে। পকেট থেকে ছোট নোটবুকটা বের করলাম। এক অচেনা অজানা ভাষায় লেখা অজ¯্র বাক্য, সাথে কিছু বাংলাও রয়েছে। গণিতের সংখ্যা বা চিহ্নের ছিটেফোঁটাও সেখানে নেই। পৃথিবীতে এ ভাষা বুঝার মতো কেউ নেই। তবে কেন দাদাজান এ ভাষায় ফর্মূলা লিখবেন? তাতে তো কোনো লাভ হয়নি, বরং একটি ধাঁধা সৃষ্টি হলো। তবে প্রতিটি লেখার পাশে এমন কিছু চিত্র রয়েছে, যা দেখতে চমৎকার।
উদ্দেশ্যহীনভাবে দাদাজান কোনো কাজ করতে পারেন বলে, মনে হয় না। তিনি নিশ্চয়ই এর ভেতর কিছু রহস্যকে সাজিয়ে রেখেছেন। এ রহস্য উদ্ধার করা সম্ভব হবে কিনা জানি না, নীলাকে সাথে নিয়ে একটিবার চেষ্টা করতে পারি। আজ রাতেও অযুত আসবে, ওর কবল থেকে এ নোটবুকটাকে সরিয়ে থাকতে হবে। কোথায় রাখা যায়?
ব্রিফকেসে রাখাটাই নিরাপদ হবে ভেবে, দ্রুত নিচ তলায় নেমে যেতে থাকলাম। কাপড়-চোপড় বের করার পর থেকে ব্রিফকেসটি নিচের ঘরেই রয়েছে। করিডোরে নেমে দেয়ালের সুইচ বক্সে কয়েকবার চাপ দিয়ে উঠোনের বাতিটা জ্বেলে দিলাম। সামনে পা বাড়াতেই চোখে পড়ল সেই বাচ্চা সাপটি। ঘাড় নাড়িয়ে খুঁটির আশপাশে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ দৃশ্য দেখামাত্র এক অজানা আনন্দে আমার মন নেচে ওঠল। মিজান মিয়া বলেছিল, সাপের বাচ্চাটি মেরে ফেলেছে। বুঝতে বাকি রইল না, সে বাড়িয়ে মিথ্যা গল্প তৈরি করেছিল।
মুহূর্তে ঘরে গেলাম। চোখ বুলাতেই চা বক্সের পাশে গুঁড়ো দুধের প্যাকেটটা খুঁজে পেলাম। চুলোয় বসানো কেটলি থেকে খানিকটা গরম পানি বাটিতে ঢেলে গুঁড়ো মিশিয়ে তরল দুধ তৈরি করলাম। বাটিটা নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম করিডোরে। সাপের বাচ্চাটি সেখানেই আছে, আমাকে দেখে মাথা তুলে সোজা হয়ে তাকাল। এগিয়ে দিলাম, দুধের বাটি। কিছু বুঝে বা না বুঝেই সে বাটিতে চুমুক দিলো। এক চুমুকে সবটুকু দুধ শেষ। আবার বাচ্চা সাপটি মাথা তোলে তাকাল। ওর মায়াবী চোখ দুটি আমার দৃষ্টিতে স্থির রেখে তাকিয়ে আছে। কচি চোখে একি তৃপ্তির ভাষা, অভিনব সাধুবাদ, কৃতজ্ঞতার ইঙ্গিত। মিনিট খানেক পরে সাপের বাচ্চাটি মাথা নিচু করে উঠোনে ঘাসের ভেতর মিলিয়ে গেল। আমি আনন্দের নিশ্বাস ফেলে কালো ঘাসগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম, জানি না। নোটবুকটার কথা মনে হতেই ঘরে গেলাম।
ব্রিফকেসটা খুলে ভেতরের দিকে নোটবুকটা রেখে দিলাম। জিনিস পত্র একটু গুছিয়ে রাখতে গিয়ে চোখে পড়ল নীল পাথরদুটি। আলোয় চকচক করছে। মার্বেলের মতো খেলতে খেলতে সময় কাটানো যাবে, ভেবে পাথর দুটি পকেটে পুরে দোতলায় ওঠলাম।

রাতের খাবার খেয়ে অযুতের অপেক্ষায় আছি। ওর ডায়েরি পড়ার ধাঁচটা উল্টো। ২০০০ সাল থেকে আরম্ভ করে সে পেছনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গতরাতে ১৯৭৩ সালের ডায়েরি পড়েছে। আজ নিশ্চয় ৭২ সালের ডায়েরিটির দিকে হাত বাড়াবে। কখনো মনে হয় সে সংখ্যাগণনা ঠিকভাবে জানে না। বিন্যস্ত বোধ ওর মধ্যে থাকলে নিশ্চয়ই সে ডায়েরির সিরিয়ালটা অনুসরণ করে পড়ত। অযুত বলেছিল, আমার মস্তিষ্কের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে। প্রথমদিকে বিষয়টা বিশ্বাস করেছিলাম, তবে এ কয়েকদিন ধরে কথাটা সাংঘাতিক মিথ্যে ঠেঁকছে। আমার শত শত ভাবনাতে যে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তা স্পষ্ট।
টেবিলের উপর পাথর দুটো নিয়ে খেলায় মেতে ওঠেছি। মার্বেল খেলা। একটি পাথরের গায়ে আরেকটি পাথর টোকা দিচ্ছি। একটু জোরে লাগতেই একটি পাথর মেঝেতে পড়ে নেচে ওঠল, কয়েক ড্রপ দিতেই আমি পাথরটি হাতের মুঠোয় তুলে নিলাম। খাটের তলায় চলে যাওয়ার ভয় সম্ভাবনা, আমার ভুরু কুঁচকে দিলো। এর আগে একবার একটি পাথর খাটের তলায় ছুটে যায়, সে রাতে কি বিরক্তিই না লেগেছিল। ধূলির সমুদ্র থেকে হামাগুড়ি দিয়ে পাথরটা এনেছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, সে রাতেই প্রথম ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা লেখাটা দেখেছিলাম। খাটের কাঠে খোদাই করা লেখা। ওখানে এ লেখাটা থাকবে কেন? নিজেকে প্রশ্ন করে নিরুত্তর বসে আছি।
সাত-পাঁচ না ভেবে হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় চলে এলাম। থাকুক ধূলি-বালি, কৌতূহলের বেড়াজালে আটকে থাকার চেয়ে রাতে গোসল করার কষ্টটা খুব বেশি কিছু না। চিৎ হয়ে শুয়ে উপরে কাঠের দিকে তাকালাম “ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা-১৯৬৯”। খেয়াল করলাম খোদাই করা লেখাটা একটা কাঠের বক্সের উপরে, সে বক্সটা খাটের সাথে চমৎকারভাবে সেঁটে দেয়া হয়েছে। লেখাটার দুপাশে ছোটো ছোটো দুটো গর্ত। মুঠোফোনের টর্চ জ্বেলে গর্তদুটো ভালোভাবে দেখলাম। গর্তের ভেতরে একটিতে ১ অন্যটিতে ২ লেখা। দুটো গর্তের পাশেই ছোট করে লেখা নীলকান্তমণি। ভাবনার ¯্রােত কোন দিকে মোড় নিবে জানি না, হঠাৎ মনে হলো এ পাথরদুটোই কি নীলকান্তমণি। পাথরদুটো হাতে নিলাম টর্চের আলোয় স্বচ্ছ নীলাভ রঙের ভেতর দাগ দেখা যাচ্ছে। কিছু না বুঝেই অবুঝ বালকের মতো একটা কাজ করে ফেললাম। যে পাথরের ভেতরে এক দাগ সেটি ১ নম্বর গর্তে, অন্যটা ২ নম্বর গর্তে ঢুকিয়ে দিলাম।
বিস্ময়ে আমার দু’চোখ জ্বলে যাচ্ছে। পাথরদুটি ভেতরে দিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চাপ দিতেই বাক্সটা খুলে গেল। পায়ের কাছে ধপাস করে একটি ডায়েরি পড়ল। নীল পাথরের মতো আরো অনেকগুলো পাথর পড়ে স্বশব্দে মেঝেতে ছড়িয়ে গেল। সবগুলো পাথর কুড়িয়ে নিলাম, ডায়েরিটাও সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এ পাথর আর ডায়েরিতে কী আছে জানি না। তবে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য এখানে জড়িয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে অযুত চলে আসতে পারে। ওর কবল থেকে সবকিছু দূরে রাখা উচিত।
ডায়েরি ও পাথরগুলো পরিষ্কার করে ব্রিফকেসে গুছিয়ে রাখলাম।
ঘরে ঢুকতেই অযুতের অস্তিত্ব টের পেলাম। তার আগমনের পরপরই একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়। চেয়ারে বসতে গিয়ে চমকে ওঠলাম। আরেকটু হলে ওর উপরেই বসে পড়ছিলাম। অযুত দৃশ্যমান হয়ে বলল, রিয়ন সাহেবের চালাকির কাছে আমি হারতে চাই না।
[চলবে...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট