সুইসাইড
জুয়েল আশরাফ
আমার নাম পারু। আমি বকুল আপার ছোট বোন ।
নুহাশ অবাক চোখে তাকাল। বকুলের একজন ছোট বোন আছে শুনেছে। কিন্তু সেই ছোট বোন লম্বায় এত বড়ো এবং তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে, তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন লজ্জা লাগছে। সে প্রায় বলতেই যাচ্ছিল, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।’ ভাগ্য ভালো এই কথা বলতে হলো না। বলার আগেই পারু বসেছে। নুহাশ আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলো সামান্য।
পারু বসে বলল, আমাকে এক গ্লাশ পানি খাওয়াতে পারবেন? খুব পানি খেতে ইচ্ছা করছে।
নুহাশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। এমন ব্যস্ত যে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টেবিলের সাথে তার হাঁটু লেগে ব্যথা সৃষ্টি হলো। কিন্তু সে চেপে গেল। পারু টের পায়নি। টের পেলে বাড়ীতে গিয়ে বকুলকে বলতো ব্যাপারটা অবশ্যই। তারপর একদিন এটা নিয়েও বকুল রাগ করতে পারে তার সঙ্গে। বকুলের রাগ যা ! সামান্য ব্যাপারগুলিও সে রাগ করার উপাদান বানাবে। রেগে গলায় বলবে, ‘ওর সামনে তুমি এত ব্যস্ত হয়েছিলে কেন? সে আমার ছোট বোন। তাকে ভয় পাবার কি আছে?’
নুহাশ অবশ্যি ভয় পাচ্ছে না। তার লজ্জা লাগছে। বকুলের সঙ্গে তার প্রণয় চার বছর। এই চার বছরে বকুলদের বাড়ীর কারুর সঙ্গেই তার চেনা-জানা নেই। আজ হঠাৎ ওর ছোট বোন আসবে অবাক লাগছে, অবাক হবার চেয়েও যেটা বেশি কাজ করছে সেটা হচ্ছে লজ্জা জড়তা সঙ্কোচ। বকুল কেন তার ছোট বোনকে পাঠাবে ভেবে পাচ্ছে না নুহাশ। যে কোনো প্রয়োজনেই বকুল ফোন করতে পারতো।
একগ্লাশ শীতল জল নুহাশ পারুর সামনে এনে রাখল। পারু গ্লাসটি হাতে ধরে চুপচাপ বসে রইল। পানি খাবার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাল না। পারু বলল, ফ্যানটা একটু ছাড়–ন। গরমে কীভাবে বসে থাকেন!
নুহাশ ফ্যান ছেড়ে দিল। দুদিন হলো তার বেশ সর্দি লেগে আছে। মারাত্মক সর্দি লেগে গেলে ফ্যানের বাতাসের প্রয়োজন পড়ে না তার। বরং বাতাস থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলে শরীর তখন ভালো থাকে। কিন্তু এই মেয়েটার তো সর্দি লাগেনি, ফ্যানের বাতাসের তার প্রয়োজন আছে অবশ্যই। কে জানে! হয়তো বাড়ীতে গিয়ে বকুলকে বলবে, ‘আপা গরমে ঘেমে যাচ্ছি তবু মানুষটা ফ্যান ছাড়েনি।’ আর এই কথা শুনতে শুনতেই বকুল ফোন করবে তখন। রেগে যাওয়া গলায় বলবে, ’ এই ! কতদিন ধরে তোমার সর্দি লেগে আছে শুনছি। এখনও ডাক্তার দেখাওনি কেন?’
অনেকদিন বকুলের রেগে যাওয়া কন্ঠ শোনা হয়না। শুনতে শুনতে এমন একটা অভ্যাস এসে দাঁড়িয়েছে যে সপ্তাহে একদিন বকুল যদি তার সঙ্গে রাগ না করে তাহলে পরের দিনগুলি কেমন পানসে পানসে লাগে। শুধু রেগে যাওয়া কন্ঠ না, আজ নয়দিন বকুলের রাগ-কন্ঠ, মিষ্টি-কন্ঠ কোনটাই শুনতে পায় না সে। বকুল গিয়েছে তার খালা বাড়ীতে। যাবার আগে বলে গিয়েছে বাড়ীতে না আসা পর্যন্ত কথা বলতে পারবে না। যেখানে যাচ্ছে সেখান থেকে সম্ভব নয় কথা বলার। বকুল ফিরেছে কিনা কথাটা পারুকে জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু হঠাৎ করে এই প্রশ্ন তাকে করা কি ঠিক হবে?
পারু পানি খেয়ে বলল, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। জানা থাকলে সঠিক জবাব দেবেন। আর না জানলে নিজের জ্ঞান জাহির করার জন্যে উল্টা-পাল্টা কিছু বলবেন না। কোনো মানুষ সুইসাইড করে মারা গেলে সে জান্নাতে যাবে না জাহান্নামে? পরকাল বিষয়ক আপনার জ্ঞান থাকলে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিন।
নুহাশ বিচলিত ভঙ্গিতে বলল, আপনি আমাকে হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করছেন? বকুল ভালো আছে? সে যে খালার বাড়ীতে গিয়েছিল ফিরেছে?
পারু মৃদু হেসে বলল, আপা ভালো আছে। কাল এসেছে। আপার জন্যে আপনার চিন্তা করতে হবে না।
নুহাশ লাজুক মুখে শুধু বলল, ওহ্।
আমার প্রশ্নের জবাবটা?
কোন প্রশ্ন?
আশ্চর্য মানুষ আপনি ! এখনই ভুলে গেলেন? আমার আপার কোন গালে তিল আছে বলুন তো?
নুহাশ আগের চেয়ে আরও লাজুক মুখে বলল, বকুলের দুই গালেই তিল আছে।
পারু বলল, আচ্ছা।
নুহাশ বলল, বকুল তোমাকে আমার কাছে কেন পাঠিয়েছে?
আপনার এই প্রশ্নের জবাব পরে দিচ্ছি। আগে ঠিক করুন আমাকে ‘আপনি’ না ‘তুমি’ করে বলবেন।
নুহাশ কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। পারু বলল, আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? কোনো লাজুক মানুষ প্রেম করতে পারে না। আপনি আমার আপার সঙ্গে কিভাবে প্রেম করছেন?
এই ধরনের প্রশ্নের জবাবের জন্যে নুহাশ প্রস্তুত নয়। সে চটজলদি বলে ফেলল, হ্যাঁ মনে পড়েছে এখন। আপনার প্রশ্ন মনে পড়েছে।
কি প্রশ্ন?
আপনি জানতে চেয়েছেন সুইসাইড করা একজন মানুষ জান্নাতে যাবে না জাহান্নামে।
হ্যাঁ। সঠিক জানা আছে আপনার?
নুহাশ বিনয়ের সাথে বলল, আমি জেনেছি কেউ যদি লোহা অথবা ধারালো জাতীয় কোন জিনিস দিয়ে আত্মহত্যা করে তবে সে পরকালে সেই জিনিস দিয়েই বার বার নিজেকে মারতে থাকবে, সেখানে কোনদিনই তার মৃত্যু হবে না, এভাবেই চলতে থাকবে। কেউ যদি পাহাড় কিংবা উঁচু কোনো জায়গা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে আত্মহত্যা করে তাহলে পরকালেও সে উঁচু জায়গায় বার বার উঠবে, এবং বার বার লাফিয়ে নিচে পড়বে। আবার তার জীবন ফিরে আসবে আবার তাকে উঁচুতে উঠানো হবে। এভাবেই আত্মহত্যাকারীর জীবন পরকালে চলতে থাকবে। দুনিয়াতে যে যেভাবে আত্মহত্যা করবে পরকালেও সে সেভাবেই নিজেকে বার বার আত্মহত্যা করতে থাকবে।
আশ্চর্য ব্যাপার, পারু চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল। নুহাশ অবাক চোখে তাকাল। সে বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে আপনার? আপনি কাঁদছেন কেন?
পারু সেই প্রশ্নের জবাব দিল না। সে শুধু বলল, আপনার নাম ঠিকানা ফোন নম্বর আমি আপার ব্যাক্তিগত কাগজ থেকে বের করেছি। আমি যে এখানে এসেছিলাম আপাকে কিছু বলবেন না।
বলতে বলতেই পারু চলে যাবার জন্যে পা বাড়াল। পেছন থেকে নুহাশ চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, আমি আপনার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে পরিস্কার বলে যান দয়া করে।
দয়া দেখানোর জন্যে পারু ঘুরে তাকাল। কিন্তু সে নির্দয়ের মতো বলল, আপাকে জোড় করে বিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল। বিয়ের রাতেই সে সুইসাইড করেছে।
নবাবগঞ্জ, ঢাকা।