ক্যাফে টাইম ভ্যালেনটাইন টাইম









ক্যাফে টাইম ভ্যালেনটাইন টাইম
আশরাফ খান

তার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। এখন নেই। নাকি আছে। মেঘে ঢাকা সূর্যের মত। খুব ভালবাসতাম তাকে। সে নয়। মাঝে মধ্যে একটু আধটু। তাতেই ধন্য। অতটা চাইনা। শিশিরের ছোঁয়ায় বন্যা হয় পিপিলিকায় বাসায়। খুব বেশি প্রয়োজন নেই। আমি বৃত্তহীন। সে বৃত্তবান। আমি বিশ্রি। সে সুশ্রি। লেখাপড়ায় দু’জন প্রায়  ইকোয়াল। কিঞ্চিৎ এগিয়ে আমি। বন্ধুরা বলত। আমি মানি না। ধরা যাক মেয়েটির নাম অধরা। শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষা বর নির্ণয়ের যথার্থ মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হলোনা অধরার বাবা মার কাছে। রিজেক্ট করা হলো আমাকে। বাবা মায়ের পছন্দে  বিয়ে হলো অধরার। বর উচ্চশিক্ষিত। বৃত্তবান। সুশ্রী। সুপ্রতিষ্ঠিত।

ছুটির দিন। অলস সময়। কাজ নেই। আনমনে হাঁটছি। তখন সন্ধ্যা। সোডিয়াম আলোয় চকচক করছে শহর। ক্যাফেতে মসৃণ আলো। একটু আলো একটু আঁধার। আধো আলো আধো ছাঁয়া। পহেলা ফাল্গুন। ফুল ফুটুক বা নাই ফুটুক আজ বসন্ত। সেই সাথে ১৪ ফেব্রয়ারি। দি ভ্যালেনটাইন ডে। একই সাথে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ত্রিমাত্রিক উৎসবে মেতে আছে ক্যাফে। কোথায় ফাঁকা নেই। শুধু শেষ কোণার কক্ষটি ফাঁকা। নিরবে বসে পড়তাম। যেন কারোর ধ্যান ভঙ্গ না হয়। পিন পতন নিরবতা। কথা হচ্ছে। কথা। গভীর ভালবাসার কথা। কথা হচ্ছে চোখে চোখে। হাতে হাতে। তালুতে তালুতে। কিছুটা ঠোঁটে ঠোঁটে। মুখে মুখে নয়। কথা হচ্ছে নৈঃশব্দে। নিরবে ভালবাসার গভীর লেনদেন। এক কোণে বসে আছি একা। ওই কক্ষে কেবল দুটি চেয়ার। একটিতে বসে আছি আমি। অপরটি ফাঁকা। কফির মগে ভিজে যায় ঠোঁট। যেন প্রেমিকার উষ্ণ ছোঁয়া।

ইদানিং অনেক কিছু ভুলে যায়। বড় ভোলা মন হয়েছে আমার। কখনো ভুলে যায় নিজের নাম।  ঠিকানা। পথ হাতড়ে হাতড়ে ফিরি নিড়ে। কফির মিষ্টি ছোঁয়ায় মিষ্টি হয় ঠোঁট। হঠাৎ মনে পড়ে দশ বছর আগের কথা। দশ বছরই হবে বোধ হয়। একটু প্লাস মাইনাসও হতে পারে। ক্যাফের এই কক্ষে আমি কোন আগুন্তুক নয়। আগেই বসতাম। একা নয়। দু’জন। কথা হত দু’জনে এখানে। চোখাচোখি মুখোমুখি। আমি অতোটা ভিতু নয়। তবুও কেঁপে উঠে হৃদপিন্ড। কাঁপে কফির মগ। কাঁপে কন্ঠনালি। সবসময় নয়। শুধুমাত্র অধরোর মুখোমুখি। ও বলত- কাঁপছ কেন। আমি বলতাম- জানিনা। ও বলত- আমি জানি। আমি বলতাম- তাহলে বলো। ও বলত- বলব না। আমি আবারও বলতাম- বলো। ও বলত- অপেক্ষা করো।  অপেক্ষা করছি এবং করব। আজ ক্যাফের সেই কক্ষে আমি একা। আজ নয়। দশ বছর একা।

১৪ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যা থেকে ক্যাফের এই কক্ষটি বুকিং থাকে আমার জন্য। উচ্চমূল্যে বুকিং করে রাখি আমি।  একটি দুইটি বছর নয়। সে প্রায় দশ বছর। মেগা সিরিয়ালের মত হয়ত চলবে আরো বহু পর্ব। কেন করি জানি না। হয়ত ভালবাসার স্মৃতি আকড়ে কিছুক্ষণ নিরব থাকতে চাই এখানে। কফির মগে চুমু দিচ্ছি অল্প। স্মৃতি খুজছি ঢের বেশি। হেড ফোন গান বাজছে। মিতালী মুখার্জীর গান “কেন আশা বেঁধে রাখি। কেন দীপ জ্বেলে রাখি। জানি  আসবে না ফিরে আর তুমি। তবুও পথ পাণে চেয়ে থাকি”। মনে পড়ে গেল লালন উৎসবের কথা। গান গাইতে গাইতে কোন বাউল শিল্পী কবিতার মত আবৃত্তি করলেন “গানই জ্ঞান. গানই ধ্যান, যে বোঝে, সে খোঁজে ”। ভাবলাম হবে হয়ত। আমিই ধ্যানে পড়ে আছি। গানের ধ্যানে। “কেন আশা বেঁধে রাখি......”।

ধ্যান ভাঙ্গলে দেখি। সামনে কেউ বসে আছে। ক্যাফের সমস্ত কক্ষ যুগল আহ্লাদে মেতে উঠেছে। শুধু আমি ছিলাম একা। ভিষণ একা। ভিতরে এবং বাহিরে। এখন একা নয়। দু’জন। আমার সামনে বসে আছে একটি মেয়ে। এটা হওয়ার কথা ছিল না। তবুও হয়েছে। কোন অনিচ্ছাকৃত ভুল নয়। ইচ্ছাকৃত ভুলের উপশম তার উপস্থিতিতে।

আলো আঁধারিতে আমি চোখ তুলে তাকলাম তার চোখে। হঠাৎ আতকে উঠল হৃদপিন্ড। সেই চেনা চোখ। চেনা চাহনি। চেনা ঘ্রাণ। হাতের কফির মগ কাঁপছে। কাঁপছে শরীর। কাঁপছে কন্ঠনালী। হারিয়ে যাওয়া আলোয় অধরা আমাকে বলল-  কতদিন পর দেখা হলো ? কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আমি বললাম- দশ বছর। ও বলল- ভুল বললে- পনের বছর। আমি বললাম- হবে হয়ত।     

সিরাজগঞ্জ।









শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট