ভালোবাসি
সালমা বিনতে শামছ
ক’দিন যাবত খুব ব্যস্ততার মাঝে আছি, ভার্সেটির ক্লাস, এদিকে সংসার, সব মিলিয়ে ব্যাস্তময় দিন গুলো যাচ্ছে,
সামীর সাহেবের আজ মনটা ভালো মনে হচ্ছে, অফিস থেকে ছুটিও নিলো, এমনিতে সামীর খুব কম ছুটি কাটায়, কাজের প্রতি তার দায়িত্ব অনেক।
আমার আবার ক্লাস আছে বিধায় সকালে উঠে নাস্তা বানিয়ে দু’জনে খাওয়ার পর্ব শেষ করলাম।
তোমার কি বিশেষ কোনো কাজ আছে? ছুটি নিলে যে, (আমি)
না তেমন কিছু না, ভাবছি আজ সারাদিন ঘুমাবো।, (সামীর)
কি বলো, ঘুমের জন্য ছুটি কাটাচ্ছো? তুমি কি পাগল?
রাতে ও তো নাক ডেকে ঘুমাও, এত্ত ঘুম কই থাকে তোমার? যাও অফিসে যাও কোনো ছুটি কাটানো যাবে না।
হে হে হে, ছুটি তো পাস হয়েই গেছে, এখন অফিসে গেলেও আমার ছুটি ই উঠবে।
ওক্কে, থাকো তুমি তোমার ছুটি নিয়ে আর বাসায় পরে পরে ঘুমাও, আমার ক্লাস আছে আমি ভার্সেটিতে গেলাম।
আজ না গেলে হয় না পাখিতা,
না হয় না, আমি তোমার মতো অকারনে ছুটি কাটাই না, রান্না করা আছে আমার আসতে দেরি হলে খেয়ে নিও।
ঠিক আছে, সাবধানে যেও,
হুম্মম্ম, তুমি ও সাবধানে থেকো, আর হ্যাঁ খেয়াল রেখো বারান্দার গাছের ফুল গুলো যাতে কেউ না ছিঁড়ে, না হলে কিন্তু তোমার খবর আছে।
ঠিক আছে ম্যাম,
আচ্ছা আমি যাই তাহলে,
পাখিতা শুনো..
বলো
তাড়াতাড়ি এসো... অপেক্ষায় আছি।
সামীর কে বাসায় একা রেখেই ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম, মনটা কেমন জানি খচখচ করছে, সামীর আজ কেন ছুটি নিলো, আর নিলোই যখন তখন আমাকে কেন ক্লাস করতে আসতে দিলো, ও তো বাসায় একাই আছে, ভাবছিলাম, আমি সহ বাসায় সময় কাটাবো, কই আমাকে তো থাকার জন্য তেমন জোর করলো না।
না না আমি সামীর কে কখনোই সন্দেহ করিনা।
কারন আমার স্বামী জগৎ এর শ্রেষ্ঠ স্বামী।
এমনিতেই কেমন জানি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি, কারন তাকে তো আমি ভালো করেই চিনি, বিয়ের পর পর প্রথম একদিন ইচ্ছে করে এরকম বাসায় একা ছিলো,
বিকেলে ফিরে এসে দেখি, কি কান্ড, পুরো ঘরের কি অবস্থা করেছে, একা একা তিনি সাইন্স এক্সপ্রিমেন্ট করেছিলেন, পানি , এসিড, ধোঁয়ার গন্ধে ঘরের অবস্থা বিশ্রী করে ফেলেছিলো।
তিনি বয়সে বড় হয়েছেন বটে অথচ মস্তিষ্কটা বাচ্চাদের মতোই রয়ে গেলো।
তার সাথে আমার যথেষ্ট মনের মিল ও ভালোবাসা থাকা সত্বেও, একটা জায়গায় অনেক বড় পার্থক্য,
তা হলো উনি বিজ্ঞান এর ছাত্র আর আমি সাহিত্যের ছাত্রী।
তার মাথার মাঝে সার্বক্ষণিক নানান এক্সপ্রিমেন্ট ঘুরতে থাকে, তিনি বিজ্ঞানের বিষয়াবলি নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন, এক কথায় বিজ্ঞান প্রেমী।
আর আমি সাহিত্য প্রেমী, সারাক্ষণ গল্প কবিতা, প্রবন্ধ, ইতিহাসে ডুবে থাকি, অবশ্য আমরা কেউ কারো কাজে এবং চিন্তাধারর কুটুক্তি কিংবা বিরুপ মন্তব্য করি না।
আবার সামীর সাহেব আমার কবিতা ও পছন্দ করেন।
যাক গে এটা সেটা ভাবতে ভাবতে ক্লাস শেষ হলো দুপুর দু’টো, এদিকে আমার মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষন হয়ে গেলো, অথচ উনি আমায় একটিবার ও ফোন দিলেন না, কি নিষ্ঠুর মানুষরে বা বা,
যার কথা ভেবে ভেবে দিন রাত আমি ক্লান্ত হই আর সে আমার একটু খবরও নিচ্ছে না।
হয়েছে আমিও ফোন দিবো না।
ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাসে বসে আছি, আর মনে মনে জিদ ধরেছি উনি আমায় ফোন দিবে, তারপর আমি বাসায় যাবো।
বেশিক্ষন বসতে হলো না, পাঁচমিনিট বাদেই ফোন আসলো।
পাখি তুমি কোথায়?
ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাসেই আছি, কেন কি হইছে?
এক মুহুর্ত দেরি না করে, তুমি এক্ষনি লিপি ফুফুর বাসায় যাও,
কেন, ফুফুর বাসায় যাবো কেন কি হইছে,?
ফুফু, অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে, ডক্টর বাসায় চেকাপ করছে, তুমি এক্ষুনি গিয়ে দেখে আসো।
কি বলো? কখন ? তো তুমিও আসো এক সাথে যাই।
আরে তুমি এখন যাও না, আমি পরে যাবো।
কি আর করা, এমনিতেই খুব খুদা লেগেছে, তারপরও ক্যাম্পাস থেকে সরাসরি ফুফুর বাসার দিকে রওনা দিলাম, তার উপর ঢাকার যে জ্যাম, এক ঘন্টার রাস্তা যেতে যেতে দু’ঘন্টা লাগলো।
ফুফুর বাসায় গিয়ে দেখলাম ফুফু বেডে শুয়ে, চেহারা স্বাভাবিক’ই আছে।
ফুফুর পাশে গিয়ে বসলাম
কি হয়েছে ফুফু আপনার, এখন কি অবস্থা?
আর বলো না পাখি হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম, বাসায় তো এক বুয়া ছাড়া কেউ নেই, তাই সামীর কে ফোন দিলাম, সামীর বললো তুমি ভার্সেটিতে,
তোমাকে কষ্ট দিলাম মা।
আরে না কি যে বলেন ফুফু, আসেন আপনাকে ভালো হসপিটালে নিয়ে যাই
না না লাগবে না, ডাক্তার এসে ঔষধ দিয়ে গেছে,
এখন কিছুটা ভালো লাগছে, তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও, এখনো তো কিছু খাওনি, আরো জার্নি করে এসেছো।
ক্ষুদা, ক্লান্তি দু’টো এক সাথে, তবুও ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম, বাহ্ ফুফুর বাসায় এত ভালো ভালো রান্না, আরো আমার প্রিয় প্রিয় সব রেসেপি।
দেখিই তো ভালো লাগছে, তাও আবার ফুফুর হাতের রান্না, বুয়ার হাতের রান্না না।
হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগলো, ফুপু না অসুস্থ? রান্না করলো কে?
সম্ভবত আমার মনে করা প্রশ্নটি ফুফু শুনতে পেলেন তাই বলতেছে,
‘রান্না করতে করতে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেছি”
সারাদিনের ক্ষুদার পর প্রিয় খাবার পেয়ে পেট পুরে খেয়ে নিলাম, সামীর ফোন দিলো
ফুফুর কি অবস্থা,
এখন মোটামুটি ভালো
ওহহ তাহলে তো আমার আসতে হবে না।
কি বলো আমি কি একাই আসবো নাকি?, তুমি এসে আমায় নিয়ে যাও।
লক্ষী পাখিতা আমার, তুমি একাই আসো না প্লিজ, আমি শুয়ে আছি উঠতে ইচ্ছে করছে না।
হইছে এত্ত আদর দেখাতে হবে না আমি একাই আসছি।
এত তাড়াহুড়ো করতে হবেনা, রেস্ট নাউ সন্ধ্যায় রওনা দিও।
বিকেলটা ফুফুর সাথে কাটিয়ে সন্ধ্যায় রওনা দিলাম বাসার উদ্দ্যেশ্যে, ফুফু রাতের জন্য কিছু খাবার প্যাক করে দিলেন।
যেতে যেতে প্রায় আট টা বেজে গেলো,
বাড়ির সামনে গিয়ে অবাক হলাম, আমারদের দু’তলার বাড়িটাতে আমরা ছাড়া মাত্র দু’টো ফ্যামেলি ভাড়া থাকে, তো এদের কারো কোনো অনুষ্টান হলে অবশ্যই আমি জানতাম, তাহলে কার বা কিসের অনুষ্ঠান,?
পুরো বাড়িটা সুন্দর করে সাজানো, নানান রং এর বাতি দিয়ে, বেলকুনি গুলো কাচা ফুল দিয়ে সাজানো, মনে হয় কোনো বিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম,
গেট খুলে বাড়ির ভিতরটাতে পা দিতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না, অনেকগুলো লাল গোলাপের মাঝে নানান রঙ্গের বাতি দিয়ে লেখা “হ্যাপী এ্যনিভার্সারি পাখিতা”
ওহহ মাই গড “২১ জুন” আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী,
উফফফফ, আমি ভুলেই গেলাম।
সামীর সাদা পান্জাবী পরে দাড়িয়ে আছে, আমার দিকে তাকিসে হাসছে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম,
দোড়ে গিয়ে সামীরকে জড়িয়ে ধরলাম, এতটা সারপ্রাইজ আমি কখনোই আশা করিনি,
সামীরের বুকে মাথা রেখে বললাম
সরি আমি ভুলে গেছিলাম।
ধুর পাগলী, তাতে কি আমি তো ভুলি নাই।
পাগল, তুমি কি এ জন্য ছুটি নিছিলা?
সামীর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলছে “উঁহু আরো অনেক কিছু বাকি আছে”।
পরে জানতে পারলাম এসব কিছু প্লান করা, আমাকে ভার্সেটিতে পাঠানো, ফুফুর বাড়িতে পাঠানো, ফুফুর অসুস্থতা ছিলো না, ফুফুকে দিয়ে আমাকে ভালো কিছু রান্না করে খাওয়ানো এবং ইচ্ছে করে সন্ধ্যার পর বাড়িতে আনানো সবটাই ছিলো সামীরের প্লান
আমার চোখ বেধে ঘরে নিয়ে গেলো।
চোখের বাঁধন খুলে আমি তো আরো অবাক, বাড়ির বাহিরে থেকে ঘরের ভেতরটা আরো সুন্দর করে সাজিয়েছে, বিশেষ করে আমাদের বেডরুম টা, ঠিক আমাদের ফুলসজ্জা রাতের মতো করে সাজানো,
আমি সাদাফুল পছন্দ করি বিধায়, পুরো রুমটা ও বেডটা সব ধরনের সাদা ফুল দিয়ে সাজানো, রুমে কোনো লাইটের আলো নেই অনেক গুলো সাদা মোমবাতি জ¦ালানো, অপূর্ব একটা ঘ্রান পুরো ঘরটা জুড়ে বিরাজ করছে, আমি এতটা মুগ্ধ আগে কখনো হয়েছি বলে মনে পড়ছে না।
সামীর আমাকে একটা শাড়ী গিফট করলো, একদম পাতলা সাদা রঙ্গের তার উপর সাদা স্টোন বসানো।
বললো এটা পরে নিতে,
আমি স্নান করে শাড়ীটা পরলাম,
দু’জন এক সাথে রাতের খাবার খেলাম।
ফুফুর দেওয়া প্রিয় খাবারগুলো।
অনেক দিন পর সামীর কে নিজ হাতে তুলে খায়িয়ে দিলাম।
আমি সামীরের দিকে তাকাতে পারছিনা,
খুব লজ্জা করছে আজ।
কেনো জানিনা,
সামীর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এক ঝাপটায় আমায় কোলে তুলে নিয়ে, ছাদে গেলো, আজ অবশ্য পূর্নিমা না, আবছা চাঁদের আলো, আর অনেক গুলো তারার ঝলকানি। তারপরও আমার মনে হচ্ছে সারা পৃথিবি আলোকিত করে আছে চাঁদটা।
সামীরের কাঁধে মাথা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি, কারো মুখে কোনো কথা নেই, তবুও মনে হচ্ছে, তার পাশে বসে আমি হাজার বছর এভাবে পাড়ি দিতে পারি।
সামীর শক্ত করে আমার হাত ধরে আছে, ঘোর কেটে বলতেছে
পাখিতা,
হুমমম
আমি তো তোমার মতো কবিতা লিখতে পারি না, নয়তো তোমার জন্য আজ হাজার লাইনের একটা কাব্য লিখতাম, তবে তুমি যদি শুনতে চাও তাহলে এক শব্দের একটি মহাকাব্য তোমাকে শুনাতে পারি।
হুম্মম্ম,, বলো শুনি
“ভালোবাসি”
এ যে আমার হাজার লাইনের কাব্যের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।
পাখিতা ’ আজকের দিনে কি চাও আমার কাছে বলো,
দিবা তো যা চাই।
হুম্মম্ম, বলো।
-আমি চাই, এই যে তুমি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছো, আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ হাত যেন আমায় শক্ত করে ধরে রাখে”।
ঠিক আছে পাগলীটা তাই হবে।
চলো যাই।
না যাবো না এখানেই রাত কাটাবো,
তাতো হবেনা পাখিতা, আজ তো আমাদের ফুলশয্যা, আমিতো মিস করবো না এ ফুলশয্যা।
ইশশশশ! পাগল একটা
হুম্মম্ম আমার পাগলীটা।