অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ
১৪.
এ পর্যন্ত যার সঙ্গে তার ফোনে পরিচয় হয়েছে সে-ই এক সময় তাকে প্রেম প্রস্তাব করেছে। সুমনও কি এমনটি করবে? না করার বিশেষ কারণ নেই। প্রথমে বলেছিল, সে চব্বিশ ঘন্টায় একবার ফোন করবে। কিন্তু এখন চব্বিশ ঘন্টায় কমপক্ষে চারবার ফোন করে। আর সেও প্রতিবারই ফোন রিসিভ করে। কথা বলার সময়ও দীর্ঘ হয়ে গেছে। কথা বলার বিষয়ও বিচিত্র হয়ে গেছে। সে এখন অনেক সহজ সুমনের কাছে। অনেক ধরনের ব্যাক্তিগত কথা শেয়ার করে দু’জনে। এরকম পরিস্থিতি প্রেম প্রস্তাব আসার সম্ভাবনাই অধিক।
যদি সত্যিই সুমন তাকে প্রেম প্রস্তাব দেয় তাহলে সে কী করবে? এরকম একটা প্রশ্ন তার মাথায় আসে। ভাবতে ভাবতে সে ভাবনা রেখে দেয়। ধ্যাৎ! আগে আসুক তো প্রেম প্রস্তাব। আগেই এ নিয়ে ভেবে লাভ কী?
যখন সে ভাবনা রেখে দিল তখনই সুমনের কাছ থেকে প্রেম প্রস্তাব এল। দীর্ঘ কথার পর কোনো রকম রাখঢাক না করে সুমন বলে ফেলল, আমি আপনাকে ভালোবাসি।
ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। প্রবাদটা তার জানা। সে সত্যিই ভাবতে বসল। গভীরভাবে ভাবতে বসল। সুমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। উজ্জ্বল ভবিষ্যত আছে তার। কিন্তু এক লহমায় তার প্রেম লুফে নেয়া ঠিক হবে না। যাচাই করতেই হবে। সে সিদ্ধান্ত নেয়-
১। তূর্যের সাথে তার স্বল্পকালীন প্রেম সুমন জানে না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারপরেও আরও টাচ দিতে হবে।
২। তার অন্য কোথাও প্রেম আছে কি না। সে সত্যিই ভালোবাসায় মজেছে নাকি জাস্ট টাইম পাস।
এই দু’টো ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে তারপর অ্যানসার-ইয়েস অর নো। সে তূর্যের ব্যাপারে বার বার প্রশ্ন করেছে-আচ্ছা, স্বপ্নার বাইরে তূর্য স্যারের আর কখনোই কোনো প্রেম কি ছিল না? খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও?
বার বার সুমনের কাছ থেকে একই উত্তর পেয়েছে-আপনার স্যারের ব্যাপারে আপনার বেশ আগ্রহ। সত্যিকারে শিক্ষকদের ব্যাপারে ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ একটু বেশিই থাকে। আমাদেরও এমনটি আছে। ছোট বেলায় এক শিক্ষককে দেখতাম পাম্প স্যু পড়ে মচমচ শব্দ করে হাঁটতেন। আমারও তেমন হাঁটতে ইচ্ছা হতো। কিন্তু তখন পাম্প স্যু পাবো কোথায়? আর শিক্ষক যদি হয় একজন আদর্শ শিক্ষক তাহলে তো কথাই নেই। সত্যিকারে টিচার হিসেবে তূর্য খুবই ভাল। আমরা বন্ধুরা মনে করি, ভবিষ্যতে ওর টিচিং পেশায়ই যাওয়া উচিত। আমি আবার টিচিং পেশাকে আমার জন্য উপযুক্ত মনে করি না। কারণ, আমি ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সেভাবে কমিউনিকেট করতে পারবো না। ও যা জানতে চাইছিলেন-সত্যি বলছি, স্বপ্নার বাইরে ওর কোনোদিন কোনো প্রেম ছিল না, থাকবেও না। ওরা জনম-জনমের সঙ্গী। আমিও পণ করেছি, প্রেম যদি করি তো ওদের মতোই করবো।
আজকাল কিন্তু এরকম নিখাদ প্রেম পাওয়া কঠিন।
তা ঠিক, তারপরেও যে ব্যতিক্রম থাকবে না তা তো নয়। ওর মুখে আপনার তারিফ শুনে শুনে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আপনিই হবেন আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা।
কিন্তু একজনকে চোখে না দেখে তার প্রেমে পড়া যায় কেমন করে ?
কে বলল আপনাকে আমি চোখে দেখিনি মনের চোখ দিয়ে আপনাকে আমি প্রতি মুহূর্তেই দেখছি। এই যে এখনও আপনি আমার চোখের পাতায়।
হি-হি-হি। আপনি তো আমার টিচারের ফ্রেন্ড। আপনার উচিত আমাকে ‘তুমি’ করে বলা।
সেটা আমি বলবো তখনই যখন আপনার সাথে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
হি-হি-হি।
সে শত ভাগ নিশ্চিত হল যে, তূর্য তার স্বল্পকালীন প্রেমটা ঘনিষ্ট বন্ধুর কাছে লুকিয়েছে। এবার জানতে হবে সুমনের অন্য কোথাও কোনো প্রেম আছে কিনা। আর এ জন্য অবশ্যই তার সাথে সাক্ষাত করতে হবে।
পনেরো।।
সুমনকে প্রথম দেখেই সে বিমুগ্ধ। সে যে সুমনের ব্যাপারে দ্বিতীয় তথ্যটা জানতে চেয়েছিল সেটার কথা একেবারেই ভুলে যায়, অথবা তার কোনো প্রয়োজনই বোধ করে না। তূর্যকে দেখার পর তার কাছে নিলয়কে মনে হয়েছিল ত্যাজপাতা। সুমনকে দেখার পর শুধু নিলয় আর তূর্য নয়, তার দেখা আর সব ছেলেকেই মনে হল ত্যাজপাতা। সে আর কোনো ভাবাভাবির মধ্যে না গিয়ে ঝাপ দিল সুমনের প্রেমে, ঠিক যেমন পতঙ্গ ঝাপ দেয় আগুনে।
অবশ্য এর পেছনে তার সুদূরপ্রসারি ভাবনাও ছিল। সে ইতিমধ্যে নিজেকে পুরোপুরি জেনে ফেলেছে। বাবা তাকে ব্যারিস্টার বানানোর ভাবনায় যতই বিভোর হোন, সে ঠিকই জানে যে, তার পক্ষে বাবার চেম্বারের পিয়ন হওয়াও সম্ভব নয়। কলেজে উঠে প্রতিটি বিষয়ই তার কাছে কূলহীন উত্তাল সাগরের মতো মনে হচ্ছে। মাধ্যমিক তো যেমন-তেমন একটা রেজাল্ট নিয়ে উতরে গিয়েছিল। কলেজ মনে হচ্ছে একবারে উতরানোও সম্ভব হবে না।
বাবা বলেন-মানুষের অসাধ্যে কিছু নাই। সে এই কথাটা নিজের মনকে অনেক করে বোঝাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু মন যেন তা বুঝতে চাইছে না। যদি সত্যিই কলেজ একবারে উতরাতে না পারে তো ভবিষ্যতে তার বিয়ের জন্য উচ্চ শিক্ষিত ভাল একটা বর যোগার করতেও বাবা-মাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। বর্তমান সময়ে উচ্চ শিক্ষিত কোনো ছেলে নিশ্চয় তার মতো ডাব্বা কাত করা মেয়ে পছন্দ করবে না। এর চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোর ও সুদর্শন একটা ছেলেকে সে যদি প্রেমের খাচায় বন্দী করতে পারে তাহলে লাভটা তারই।
নতুন করে শুরু হল উথাল-পাথাল প্রেম পর্ব। সত্যিই সে সুমনের ভালোবাসার মধ্যে কোনো খাদ খুঁজে পায় না। সেও সুমনকে হৃদয় উজার করে ভালোবাসা দেবার জন্য ব্যকুল। সে সুমনকে যতই ভালোবাসে তারপরও তার কেবলই মনে হতে থাকে, আরও বেশি দিতে হবে। কিছুতেই যেন সবটা দেয়া হচ্ছে না।
সে পলাশের সাথে সম্পর্ক (যেটা ভালবাসা ছিল না, ছিল অসম বয়সের বন্ধুত্ব) পুরোপুরিই চুকিয়ে দেয়। পলাশ গাড়ি নিয়ে তার কলেজের গেটে বসে থাকে। সে এমন ভাব করে যেন সে পলাশকে চিনেই না-দেখেনি কোনোদিন। এ নিয়ে পলাশের সাথে তার কলহ বাধে। পলাশ তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। শত হলেও সে মাঝারি গোছের একজন উকিলের মেয়ে। কারও দেখে নেয়ার হুমকিতে সে সহজে ভীত হতে পারে না। সে দাঁত খিচিয়ে বলে-আমি উকিলের মেয়ে, আমার বাবাকে বলে এমন প্যাঁচে ফেলবো যে, সারা জীবনেও প্যাঁচ খুলতে পারবেন না। নিজের ভাল চাইলে সরে পড়েন।
আর দুঃসম্পর্কের আত্মীয়তা থাকার কারণে পলাশও জানে যে, সে বিশেষ কিছু করতে পারবে না। তাই সে দূরে সরে যায়।
আর নিলয় তাদের বাসায় এলে নিলয়ের সামনে বসেই সে ফোনে সুমনের সাথে তুখোর প্রেমালাপ চালিয়ে যায়। নিলয় শুধু কষ্ট পায় না, অপমানিত বোধ করে যারপর নাই। তার শরীরেও তো মানুষের রক্ত। তূর্যের সাথে সম্পর্ক ভাঙার পর সে নিজে থেকেই নিলয়ের সাথে যোগাযোগ করেছিল। নিলয় তিল পরিমাণ বাদানুবাদে না গিয়ে নিঃশব্দে চলে যায়।
আর সে? তার পৃথিবীকে একেবারেই সংকুচিত করে ফেলে। হ্যাঁ, তার পৃথিবী বলতে শুধুই সুমন।
সকালে কলেজে যায়। একটা/দুইটা ক্লাশ করে। তারপরই সুমন এসে হাজির কলেজ গেটে। কোথাও ঘোরা বা খাওয়ার প্রতি তখন আগ্রহ খুবই কম। জড়াজড়ি করে বসে থাকায়ই সবচেয়ে সুখ। এর জন্য টিএসসি’র নিরিবিলি লবি, কার্জন হল, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলদা গার্ডেনই খুবই উপযুক্ত জায়গা। সুমনের বুকে আর ঠোঁটে তার যত মাদকতা। কি করে যে সময় কেটে যায় তা তারা কেউ বুঝতে পারে না। শুধুই মনে হয়, দিনের প্রতিটা প্রহর-সকাল, দুপুর, বিকেল খুবই সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। এই সংক্ষিপ্ত সময়েও ক্ষিধে পায়। এটা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। তখন খেতে যেতে হয়। তারপরও সুমন তাকে এটা-ওটা গিফট দেয়। দিতে হয়। উপহার ছাড়া ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। সুমনের পার্ট টাইম চাকরির ছয় হাজার টাকা চলে যায় তার পেছনে। আগে সুমন বাড়ি থেকে কোনো টাকা আনতো না। নিজের চাকরির ছয় হাজার টাকায় দিব্যি চলে যেতো। উপরন্তু ছুটি-ছাটায় বাড়িতে যাবার সময় সে বৃদ্ধ বাবা-মা’র জন্য কিছু হাতে করে নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু আবার সে বাড়িতে টাকা চেয়ে পাঠায়। কারণ হিসাবে তাকে একটু মিথ্যে বলতেই হয়-লেখাপড়ার চাপে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ির মানুষ সেটাকে খারাপ ভাবে না দেখে ইতিবাচকভাবে দেখে। লেখাপড়ার জন্য তারা সন্তানকে রাজধানী শহরে পাঠিয়েছেন। চাকরি করতে গিয়ে তার রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাক সেটা তারা চাইতে পারে না। আসলে প্রেম মানেই যেন কম অথবা বেশি মিথ্যা গুরুজনদের কাছে। মিথ্যা ছাড়া প্রেম হয় না। তবু প্রেমের জয় হোক এটাই আজীবন সবাই চেয়ে আসছে।
রাতে বাসায় ফিরে পরদিন কলেজে যাবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার খুবই অস্বস্তিকর সময়। তখন সুমনের বুক আর ঠোঁটের স্পর্শহীন সময়। খুব বিশ্রী সময়। বাধ্য হয়ে শুধুই শ্রবণ স্পর্শ।
ষোল।।
এই বেচারা একটু ভিন্ন টাইপের মানুষ। আমি তার গৃহ শিক্ষক, যিনি তাকে ইংরেজি পড়ান সেই আসাদুজ্জামানের কথা বলছি। তার জীবনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষকতা। মাস্টার্স শেষ করে ঢুকেছিলেনও শিক্ষকতায়। একটা বেসরকারি কলেজে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাল লাগেনি। কলেজের চেয়ারম্যানের কাছে শিক্ষাটা ব্যবসা। তার স্কুলও আছে। কলেজের শিক্ষক দিয়েই স্কুল চালান। নয়টা-পাঁচটা গাধার খাটনি। স্কুল-কলেজ মিলিয়ে একটার পর পর একটা ক্লাশ। অনেক সময় সাতটা পর্যন্ত কলেজে থাকতে হয়। পরীক্ষার খাতা চেক করা, প্রশ্নপত্র তৈরি এসব কলেজে বসে করতে হয়। প্রশ্নপত্র তৈরি বা পরীক্ষার খাতা চেকের ব্যাপারটা বাসায় করা যেতে পারে। চেয়ারম্যান সেটা করতে দেবেন না। আবার শিক্ষক দিয়ে অফিসিয়াল দায়িত্বও পালন করান চেয়ারম্যান।
তার মেজাজ প্রায়ই খিটমিট হয়ে যেত। একবার টানা তিন/চারটা ক্লাশ নিয়ে তিনি মাত্রই রুমে গিয়ে বসেছেন, তখন স্বয়ং চেয়ারম্যান এলেন টিচার্স রুমে। তাকে বললেন, আপনি ক্লাশ নাইনের একটা ক্লাশ নিয়ে আসেন তো।
তিনি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। বললেন, স্যার, আমার চাকরি হয়েছে কলেজে।
চেয়ারম্যান বললেন, তা আমার জানা আছে।
তাহলে আমি স্কুলে ক্লাশ নেব কেন?
এখানে চাকরি করলে তা করতে হবে।
আচ্ছা, টিচিং-এর প্রতি দূর্বলতা থাকার কারণে না হয় তা করলাম, কিন্তু কেরানীর দায়িত্ব পালন করব কেন?
সেটাও করতে হবে। এখানে যারা চাকরি করে তারা সবাই সেটা করে।
আমি সেটা করবো না।
তাহলে চাকরিও করতে পারবেন না।
পরদিন তিনি চেয়াম্যানের বরাবর রিজাইন লেটার পাঠিয়ে দিলেন। চেয়ারম্যান বললেন, আপনি ভুল করছেন।
ভুল-শুদ্ধ নিয়েই মানুষের জীবন।
আমি আপনাকে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে অনুরোধ করছি।
আমি সিদ্ধান্ত পাল্টাবো না।
রিজাইন লেটার দিয়ে যখন তিনি রাস্তায় নামলেন, তখন তার শরীর দিয়ে ঘাম বেরিয়ে গেল। তখন ছিল মাঘ মাস। বাঘ কাঁপা শীত ছিল। তখন শরীরে ঘাম বের হবার কথা না। কিন্তু তার বের হল। বের হল বাবার কথা চিন্তা করে। বাবা মাত্রই রিটায়ার্ড করেছেন। ঘাম বের হল তিনটি ছোট ভাই-বোনের কথা চিন্তা করে। তারা সবাই তখন পড়াশোনায়। পরিবারে উপার্যনক্ষম সে একা। এ অবস্থায় এই দেশে কেউ চাকরি ছেড়ে দেয়? ভেবে দেখলো, চেয়ারম্যানের কথাই ঠিক। চাকরিটা ছেড়ে দেয়া তার ভুল হয়েছে। বিরাট ভুল। তিনি তখন কি করবেন? ফিরে গিয়ে কি চেয়ারম্যানকে বলবেন-স্যার, আমি ভুল করেছি। আমার রিজাইন লেটারটা ফিরিয়ে নিতে চাই? এতটা নিচে কি তিনি নামতে পারবেন? না, তিনি তা পারলেন না। তিনি টলতে টলতে পা ফেলতে লাগলেন বাসার দিকে।
সব শুনে মা চুপ করে রইলেন। যে কোনো ব্যাপারেই মা চুপ করে থাকেন। কোনো এক ফুরসতে নিচু কন্ঠে নিজের মতামত ব্যাক্ত করেন।
বাবা চুপ করে থাকার মানুষ নন। নিচু কন্ঠে কথা বলার মানুষ নন। এঘর-ওঘর লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলেন আর চিৎকার করে ইনডাইরেক্টলি বলতে লাগলেন-কাজ না করিয়ে চেয়ারম্যান তাকে বেতন দেবেন! নবাব সলিমুল্লাহর বেটা আহসানউল্লাহ। সে কলেজে কি আর কেউ চাকরি করে না? আরে, স¤্রাট আকবরের পুত্ররাও তো বসে খেতে পারেনি। কাজ করতে হয়েছে তাদের। ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ পর্যন্ত করতে হয়েছে। তার কাজটা কি যুদ্ধ করার চেয়ে কঠিন ছিল? ছেড়ে দিয়ে এল চাকরি। চাকির কি বিয়া করা যে, তিন/টারটা করলাম? এই দেশে........। দেখবো আবার চাকরি কই পায়।
মা নিচু কন্ঠে বললেন, চুপ করেন তো।
চুপ করেন তো মানে কী? চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এল কারও কাছে একবার জিজ্ঞেস করছে? দিন-রাত তো ছেলের সাথে গুচুর-পুচুর করো। তোমাকে একবার জানিয়েছে যে, এমন একটা সর্বনেশে কাজ করবে? নাকি জানিয়েছে কিন্তু তুমি আমার কাছে তা গোপন রেখেছো? নাকি ছেলের কষ্টের কথা শুনে তুমি........ ? ছেলেকে এবার কোলে বসিয়ে দুধ-ভাত খাওয়াও। দেখবো কেমনে চলে। আমার পেনশনের টাকায় বাসা ভাড়া দেবে, নাকি খাবে, নাকি ছোটগুলার লেখাপড়া করাবে?
আরেকটা চাকরির চেষ্টা করবে।
একটা যে করতে পারল না সে আরেকটা করবে কেমনে? আরেকটায় কি তাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবে? সেটায়ও তো কাজই করাবে।
মা আর কিছু বললেন না। বললে বাবার কন্ঠ বাড়তেই থাকবে। বাড়তে বাড়তে চলে যাবে আশেপাশের বাসার মানুষের কানে।
তিনি জান-প্রাণ দিয়ে চাকরি খুঁজতে লাগলেন। চাকরির এ্যাপ্লিকেশন করেন। ইন্টারভিউ দেন। এসব করতেও তো টাকার দরকার। তিনি তার ছাত্র জীবনের কাজটা কঠিনভাবে আকড়ে ধরলেন। কি সেটা? প্রাইভেট টিউশনি।
আর এরই মাঝে তার মাঝারি গোছের একটা সরকারি চাকরির এ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটার এসে গেল। তার ইচ্ছা ছিল শিক্ষা ক্যাডারে বিসিএস দেবে। চাকরি করলে বিসিএস-এর প্রিপারেশন নেয়া সম্ভব হবে না। আর চাকরি না নেয়টাও সম্ভব হবে না বাবার জন্য। বেসরকারি কলেজের চাকরি ছেড়ে দেয়াটা বাবা কোনো মতে সয়ে নিয়েছিলেন, সরকারি চাকরিতে জয়েন না করলে তিনি নিশ্চিত হার্ট ফেইল করে মারা যাবেন। আর পরবর্তী বিসিএস সার্কুলার-এর জন্য অপেক্ষা করাও তার সম্ভব ছিল না। দীর্ঘ সেশন জট পেরিয়ে লেখাপড়া শেষ করেছে। বয়স খুব বেশি হাতে নেই।
তিনি যোগ দিয়ে ফেললেন মাঝারি গোছের সরকারি চাকরিটায়। নয়টা পাঁচটা অফিস। তারপর হাতে থাকে অনেকটা সময়। আর সপ্তাহে দুইদিন তো ছুটি আছেই। তার উপর ক্যাজুয়াল, আর্ন, মেডিক্যাল আরও কত রকম লিভ। তিনি চাকরির সাথে পুরো দমে শুরু করে দিলেন ছাত্র-ছাত্রী পড়ানো। ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স। ভাল পড়ান। এলাকার সবার কাছে সুপরিচিত। তার উপর আছে ছবি আঁকার হাত, আবৃত্তির কন্ঠ, গানের দক্ষতা। এলাকার ছেলেপেলে এবং তাদের গার্ডিয়ানদের কাছে এমনিতেই সে খুব পরিচিত। চাকরির বেতনের তিন/চার গুণ আয় করেন টিউশনি থেকে।
আসাদুজ্জামান আসাদ। এলাকায় সবার কাছে পরিচিত আসাদ স্যার হিসাবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক না হয়েও শিক্ষক। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে লাগলেন। তিনি প্রথম থেকেই রোমান্টিক। ছাত্র-ছাত্রীরা সহজেই তার সাথে সহজ হয়ে যায়। তার সাথে সহজভাবে সবাই কথা বলতে পারে। তাই বলে একটা সীমা থাকে। সে সীমা তিনি অতিক্রম করেন না। কাউকে অতিক্রম করতেও দেন না।
ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপারেও অনেক সময় তার সাথে কথা বলে। তবে, তার মত হল জীবনের জন্য প্রেম। প্রেমের জন্য জীবন নয়। জীবন সবচেয়ে মূল্যবান। জীবন সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে ব্যর্থ হয়ে গেলে যে কোনো স্বার্থকতাই মূল্যহীন। তার জীবনেও প্রেম এসেছে। কেউ না কেউ কখনো না কখনো তাকে ভালোবেসেছে। আবার তারও কাউকে না কাউকে ভাল লেগেছে। কখনো পরস্পরের মধ্যে সেটা জানাজানিও হয়েছে। তবে তিনি নিজের জীবনকে নিয়ে সত্যিই খুব ব্যস্ত থাকতেন। তিনি সব সময় স্মরণ রাখতেন, নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। তাকে নিজের মতোই বাঁচতে হবে। ভাল লাগা-ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে জীবনে ব্যর্থ হলে শুধু তার জীবনে ব্যর্থতা নেমে আসবে না, অনেকটা বিপর্যয় নেমে আসবে তার ভালোবাসার মানুষটির জীবনেও। আর নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন তো আছেই। একজনের জীবনের সাথে জড়িত অনেকের জীবন। তাই তিনি ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা ভরে হৃদয়ে রেখে নিজের লেখা-পড়ায় ব্যস্ত থেকেছেন। পাশাপাশি তার ভালোবাসা ছিল ছবি আঁকা, আবৃত্তি, সংগীতে। এসবে তিনি সময় দিয়েছেন যথেষ্ট।
তাই বলে কেউ ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল হবে না, ভালোবাসাকে স্বার্থক করতে আপ্রাণ করবে না তা তিনি মনে করেন না। কিন্তু ভালোবাসার জন্য জীবনকে ব্যর্থ করে দেবে এটাও তিনি সমর্থন করেন না। তার মতে নিখাদভাবে ভালোবাসতে পারাটাই ভালোবাসার স্বার্থকতা। জুটিবদ্ধ হওয়া না হওয়াতে কিছু যায় আসে না।
আসাদ স্যার বুঝতে পেরেছিলেন, জীবনের চেয়ে প্রেমকেই সে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। আর এর একটা তীব্র তেঁতো ফল তাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু তিনি কী করবেন, মানে তাকে কী রকম উপদেশ দেবেন তা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। আবার এরকম একটা বিষয় নিয়ে তার বাবা-মা’র সাথে কথা বলতেও ভরসা পাচ্ছিলেন না। শেষে সে যদি সব অস্বীকার করে তো উল্টো তিনিই অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়বেন। ফলে চুপ করেই রইলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকতে পারলেন না। এক/দেড় ঘন্টার ক্লাশে যদি দশ মিনিট পর পর ফোন আসে এবং তাকে বসিয়ে রেখে তার সামনেই প্রেমালাপ শুরু করে দেয়, তাহলে তিনি কেমন করে চুপ থাকেন?
এখন আমার টিচার আছেন, তুমি একটু পরে ফোন করো-এ ধরনের একটা কথা সে সুমনকে বলতে পারে না। সুমনের ফোন আসা মাত্র সে আসাদ স্যারকে বলে-স্যার একটু....।
তারপর কথা। নিজের ঘর ব্যতীত কথা বলার তার অন্য কোনো জায়গাও নেই। ফলে স্যারের সামনেই.....। আসাদ স্যার অনেক সময় ইশারায় বলেন-ঠিক আছে, তুমি কথা বলো, আমি তাহলে আজ আসি। এ কথা শুনে সে খুুশি হয়। ফোনে কথা বলতে বলতেই মাথা ঝাকিয়ে বোঝায়-ঠিক আছে আসুন স্যার।
আবার কখনো কখনো তিনি চুপচাপ প্রায় ঘন্টা পার করে দেন। কারণ, প্রতিদিন এসেই চলে গেলে গার্ডিয়ানের কাছে কৈফিয়ত দিতে হতে পারে। বসে বসে শোনেন প্রেম আলাপ, আর ঘেন্নায় তার শরীর জ্বলে যায়।
প্রেমে পড়লে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি কিছুটা লোপ পায়। প্রেমে পড়লে মানুষ অনেকটা নির্লজ্জ হয়। এগুলো পুরনো কথা। কিন্তু এতটা জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায়, এতটা নির্লজ্জ হয় আসাদ স্যার জানতেন না। তিনি একদিন তাকে বললেন, এটা কি বলোতো?
কী অদ্ভূত প্রশ্ন করছেন স্যার?
আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
এটা একটা কলম।
এই মুখটা খুলে ফেললাম। এখন এর নিবটা যদি তোমার চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেই তাহলে কি হবে বলো তো?
স্যার..........!
কী হবে তাই বলো?
চোখ কানা হয়ে যাবে।
আর এটাকেই বলে এ্যাবইউজ।
এ্যাবইউজ মানে কি স্যার?
তুমি এইচ.এস.সি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ো, অথচ এ্যাবইউজ মানে জানো না। স্যাটেলাইট টেলিভিশন, মডার্ন সায়েন্স এসব কমপজিশন পড়াতে গিয়ে আমি তোমাকে শব্দটা পড়িয়েছি, অথচ তুমি এখন তা বলতে পারছো না। তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত।
মানুষ কি ভুলবে না ?
ভুলবে, তবে এইচ.এস.সি ক্লাশের একজন স্টুডেন্ট ইউজ/এ্যাবইউজ শব্দের মানে ভুলে যেতে পারে না।
স্যার, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন তাই বলেন।
আমার যতদূর মনে হয়, তুমি তোমার সেলফোনের অপব্যবহার করছো।
ফোনে কথা বলবো না?
কথা বলা আর অতিরিক্ত এবং অহেতুক কথা বলা এক জিনিস নয়।
আমার কি মনে হয় জানেন স্যার?
কী মনে হয় ?
থাক বলবো না-আপনি আবার মনে কষ্ট পেতে পারেন।
তোমার কোনো কথায় আমার কষ্ট পাবার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। এক/দেড় ঘন্টা সময়ের জন্য পড়াতে আসি। এসময়টা একটু মন দিয়ে পড়া যায় না? এইটুকু সময় ফোনটা বন্ধ রাখলে কি এমন ক্ষতি হবে? নির্লজ্জতা-বেহায়াপনার একটা সীমা থাকা উচিত।
আপনার কাছে আমি অনেক দিন ধরে পড়ছি। আপনার সাথে আমি বেশ ফ্রি.......।
ফ্রি বলতে তুমি কী বোঝাতে চাও? ফ্রি মানে আমাকে বসিয়ে রেখে এভাবে প্রেমালাপ নয়।
আমি মনে মনে যা ভাবছিলাম, ব্যাপারটা আসলে তাই। আমি সিওর। আমি ভাল একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি। আমাদের সম্পর্ক স্থায়ী হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা আপনার ভাল লাগছে না। আমি নিশ্চিত, আপনি আমার প্রতি উইক ছিলেন-আপনি হার্টে ট্যাপ খেয়েছেন। তাই এখন...........।
দুই সন্তানের জনক সেই গৃহশিক্ষক মাটির সাথে মিশে গেলেন, কিন্তু মাটির ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেতে পারলেন না।
একদিন তার ফোনে কথা বলার মুহূর্তে দরজায় কান পাতলেন মা। কান পেতে শুনলেন কিছু কথা। তারপর তিনি সজোরে দরজায় থাপ্পর দিয়ে বাজখাই গলায় বললেন, দরজা খোল।
দরজা খুললে মা চিলের মতো ছোঁ মেরে সেলফোনটা নিজের হাতে নিলেন। বললেন, কী কারণে এস.এস.সি-তে তোর অধঃপাত হয়েছে তা তুই নিজেও জানিস। আবার সেই পথে পা বাড়িয়েছিস! এই ফোনটাই যত সর্বনাশের মূল। এই ফোনটাই তোকে এসব জুটিয়ে দেয়।
মা ফোনটা নিয়ে গেলেন।
এই কাহিনী সে গৃহ শিক্ষককে শুনিয়েছে। সত্যি, কয়েকদিন তার কাছে ফোন ছিল না। তখন সে পড়তে বসে ফোনে কথা বলেনি। কথা বলেছে যখন বাবা-মা কেউ বাসায় না থাকতেন তখন। তারা তো আর ফোনটা সাথে নিয়ে যেতেন না। তারা বাসা থেকে বের হলে সে সুমনকে মিস কল দিতো। সুমন বুঝতো, ফোনটা এখন তার কাছে। সে কল ব্যাক করতো।
কিন্তু এভাবে বেশি দিন চললো না। কয়েকদিন পরেই ফোনটা আবার তার কাছে। আবার আগের মতোই পড়তে বসে কথা বলা। এবার যেন আরও বেশি। শিক্ষককে তিল পরিমাণ কেয়ার না করে। শিক্ষকও চুপ। তবে তার জানার ইচ্ছা-বাবা-মা সব জানার পরও আবার এমনটি হলো কেমন করে। ব্যাপারটা সে-ই একদিন শিক্ষকের কাছে খোলসা করলো।
বলল, জানেন স্যার ব্যাপারটা কি হয়েছে?
না, কিছু জানি না।
মা তো আমার কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে গেলেন। রাতে দু’জন পাশাপাশি বসে আমাদের দু’জনের সব ছবি দেখেছেন। আমাদের ঘনিষ্ট ছবিগুলোও দেখেছেন।
বলো কি!
তারপরও আমাকে বিশেষ কিছু বলেননি। মা তো কিছুই বলেননি। বাবা আমাকে শুধু এইটুকু বলেছেন, পারলে সরে এসো। আর বাবা মাকে বলেছেন, এত ঘনিষ্ট ছবিগুলো সেভ করে না রাখলেও পারতো। আর বলবেনই বা কেন বলেন স্যার? আমি তো আর যা-তা কোনো ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়াইনি। ও দেখতে সুন্দর। ছাত্র হিসাবে ব্রিলিয়ান্ট। ও বলেছে, অনার্স শেষ করেই বিসিএস দেবে। দিলেই হয়ে যাবে। আর তখন তো ও ম্যাজিস্ট্রেট। আচ্ছা স্যার, ম্যাজিস্ট্রেট হবার জন্য কোন দিক থেকে বিসিএস দিতে হয় যেন ?
এ্যাডমিনেস্ট্রশন ক্যাডার থেকে।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ও তাই বলেছিল। ওর বিসিএস হয়ে গেলে আমরা বিয়ে করে ফেলবো। আমি তখন বিবিএ থার্ড সেমিস্টারে পড়বো হয় তো। আমি তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঞ্চ পাবো না। প্রাইভেটে পড়বো।
সুন্দর পরিকল্পনা।
স্যার, আমি খুব ভেবেই পথ চলছি।
তা তো চলতেই হবে। কথায় আছে না, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। তোমার আগের যে রিলেশনটা ছিল-কোচিং-এর টিচারের সাথে সে-ও তো ম্যাজিস্ট্রেটই হবে বলেছিল, তাই না?
আরে ওর তো ঝামেলা আছে। সত্যি কথা কি স্যার, তূর্যের আগে একটা রিলেশন আছে। সে সেই রিলেশনটা ব্রেক করতে চায়নি। তা ছাড়া আমি খুব ফ্রি মাইন্ডের মেয়ে না? সবার সাথে সহজে মিশতে পারি। এটা ও পছন্দ করতো না। আমাকে সন্দেহ করতো। এখনই যে সন্দেহ করে তার সাথে রিলেশন টিকিয়ে রাখা যায়, আপনিই বলুন?
না, তা যায় না।
আর সুমনের অন্য কোনো রিলেশন নেই। ও সত্যিই আমাকে খুব ভালোবাসে। সব সময় আমাকে বলে-আমার খুব ভয় হয়, তুমি আবার আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো। আমিও ওকে খুব ভালোবাসি।
আচ্ছা, এখন বইটা দাও দেখি।
গৃহশিক্ষক বই চান। কিন্তু বই কাছে নিয়েও বিশেষ কোনো ফল হয় না। সে একেবারেই বেপরোয়া। সে অনর্গল তার প্রেমকাব্য বলেই যেতে থাকে। শিক্ষকের মন-মানসিকতার ধার সে ধারে না।
তারপর থেকে প্রতিদিনই শিক্ষক যতক্ষণ থাকেন তার সিংহ ভাগ সুমনের সাথে ফোনে কথা, বাকিটুকু তার প্রেম কাহিনী। কোথায় গেল, কি করলো, কি খেল, কি দেখলো ইত্যাদি। আর কথা বলে কোনোরকম রাখ-ঢাক না করে। বাবা-মা যখন অন্তরঙ্গ ছবি দেখে কিছু বলেননি, তখন টিচার কে? আর ফাঁকে ফাঁকে দেখায় সুমনের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহারগুলো। সে বলে, স্যার, সুমন ঠোঁটে লিপজেল লাগায় কিভাবে জানেন?
লিপজেল লাগানোর আবার বিশেষ ধরন আছে নাকি ?
হি-হি-হি। ও লিপজেল লাগায় আমার ঠোঁট থেকে। আর রাতে তো ঘুমানোর সময় পাই না, কিভাবে ঘুমাই জানেন?
না।
টিএসসির লবিতে সুমনের উড়–তে মাথা রেখে।
ও।
স্যার, বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে-কানাচে এমন কোনো জায়গা নেই যে আমি চিনি না। যেতে যেতে......।
ও।
শিক্ষক মনের দিক থেকে এই টিউশনিটা করতে আর স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। ছেড়ে দেবার পথ খুঁজছিলেন। প্রায়ই এ অজুহাত-ও অজুহাত দাঁড় করান চলে যাবার জন্য। কয়েকবার পড়াতে যাওয়া বাদও দিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলেন না। ছাত্রীর মা যখন বাসায় এসে অনুরোধ করতে থাকেন পড়ানোর জন্য এবং কেন তাকে ছেড়ে দিতে চান তার কারণ জানতে চান, তখন সে বলতে পারে না সত্য কথা। মেয়ে লেখাপড়া করে না, পড়তে বসে তার প্রেমকাহিনী শুরু করে দেয়, আর সে কাহিনীর মধ্যে আছে অশ্লীলতা এসব কথা বলতে পারেন না তিনি। পাশাপাশি ভয়ে থাকেন ছাত্রী আবার বাবা-মা’র কাছে এরকম রটিয়ে দেয় যে, তিনি হার্টে ট্যাপ খেয়ে চলে যেতে চাচ্ছেন।
অনেক ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, শেষ পর্যন্ত থাকবেন। মানে এইচ.এস.সি পরীক্ষা পর্যন্ত। তিনি আরও একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। আবৃত্তি, ছবি আঁকা এসবে তার দক্ষতা আছে। তিনি প্রচুর বই পড়েন। কখনো লেখালেখি করেননি। কিন্তু চেষ্টা করলে যে পারবেন না তা নয়। তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে, একটা উপন্যাস লিখবেন। বাবা-মা’র বেখেয়াল, অসতর্কতা, সন্তানের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা ও বিশ্বাস, আধুনিক প্রযুক্তির অপব্যবহার, লাগামহীন প্রেম শেষ পর্যন্ত কি পরিণতি নিয়ে আসে তা নিয়ে তিনি একটা উপন্যাস লিখবেন। প্রেম কোনো নেগেটিভ জিনিস নয়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিও নয়। অতিরিক্ততা, অপব্যবহার সব সময়ই নেগেটিভ। দুধ একটা সুষম খাবার। কিন্তু শুধু মাত্র দুধ খেয়ে কেউ বাঁচতে পারবে না। তা করতে চাইলে দুধের অপব্যবহারই হবে মাত্র। তিনি মনে করেন, এইচ.এস.সি’র রেজাল্ট হতে হতে তিনি এসবের একটা চূড়ান্ত ফলাফল পেয়ে যাবেন। ফলাফলটা ভয়াবহ হবার সম্ভাবনাই অধিক। আবার পজিটিভও হতে পারে। যেটাই হোক, সেটাকে উপজীব্য করে তিনি একটা উপন্যাস লিখবেন। যদি ফলাফল পজিটিভ হয় তো তিনি কী ধরণের নেগেটিভ হতে পারতো তার বিশ্লেষণ দেবেন।
মনে মনে তিনি শব্দ গোছাতে থাকেন, ঘটনা সাজাতে থাকেন। উপন্যাসের একটা নামও ঠিক করে ফেলেন। উপন্যাসটার নাম হবে-একটি স্মার্ট ফোন। তার বিশ্বাস, এই উপন্যাস থেকে ভবিষ্যতে অনেক সন্তান ও বাবা-মা একটু হলেও উপকৃত হবে। এসব ভাবতে ভাবতে তিনি নিজের মধ্যে একটা দায় অনুভব করতে থাকেন।
আর এক সময় তিনি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনাটা তাকে জানিয়েও দেন। সে খুশিকে আটখান। তার জীবন, তার প্রেম নিয়ে উপন্যাস হবে-বিরাট ব্যাপার। সে টিচারকে উপন্যাস লিখতে উৎসাহিত করতে থাকে। আর উপন্যাসটা যাতে আরও বাস্তব হয়ে উঠে সে কারণে সে টিচারকে তার প্রেমঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে থাকে। [চলবে...]