অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ
[গত সংখ্যার পর]
১৯.
এইচ.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। বাবা বাইরে যাননি। শত কাজ ফেলেও তিনি বাসায়। মা আগের দিনই অফিসে ছুটি লিখে এসেছেন।
সকাল নয়টা। তার ঘুম ভেঙেছে বেশ আগে। ঘুম ভাঙার পর থেকেই কেমন যেন বমি বমি লাগছে। বাথরুমে গিয়ে কয়েকবার ওয়াক ওয়াক করেছে। মনে হয় মুখ ভরে গলগল করে বমি বের হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু বের হয় না। সারা শরীর ঘেমে যায়। মাথা ঘোরে। কিন্তু বমি হয় না। অবশ্য কয়েকদিন আগে থেকেই একটু একটু বমি ভাব হচ্ছিল।
রেজাল্টের টেনশনের জন্য কি এমন হচ্ছে? সে জানে, তার পরীক্ষা ভাল হয়নি। সরাসরি না বললেও আকার-ইঙ্গিতে সে বাবা-মাকেও কথাটা বুঝিয়েছে। বাবা-মাও বুঝে গেছেন অনেকটা। মোটামুটি একটা রেজাল্টের জন্যই তারা নিজেদের প্রস্তুত করেছেন। আর সুমনের সাথে সম্পর্কটাও তারা প্রায় মুখ ফুটে স্বীকৃতি দেবার মতোই স্বীকৃতি দিয়েছেন। তারপরও এতটা খারাপ লাগছে কেন?
সে মাত্রই বমি করার আপ্রাণ চেষ্টা করে এসেছে, তখন সে পেটের ভেতর অদ্ভূত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল। সে তখনই বুঝলো, ব্যাপারটা আগেও কয়েকবার ঘটেছে তবে ততটা স্পষ্ট ছিল না। সে তেমন করে বুঝতে পারেনি তাই পাত্তা দেয়নি। এবার ভীষণ স্পষ্ট। দলার মত কি যেন একটা পেটের ভেতর নড়াচড়া করছে। একবার উপরের দিকে ধাক্কা দিচ্ছে, একবার নিচের দিকে, একবার ডানে, একবার বামে। সে হাত দিয়ে উপলব্ধি করল। হ্যাঁ, ঠিক দলার মত।
ঠিক তখন বাবা এলেন তার ঘরে। বললেন, রেজাল্ট নেটে দেবে কখন ?
এত অস্থির হচ্ছো কেন বাবা?
অস্থির হলাম কোথায়? কখন রেজাল্ট নেটে দেবে তা জানতে চাওয়া মানে কি অস্থির হওয়া?
সাড়ে দশটা এগারোটা দিকে দেবে।
বাবা চেয়ার টেনে তার পাশে বসে পড়লেন। বললেন, এজ অব ডিজিটাল। শুধু রোল নাম্বার লিখে বাটন টিপলেই রেজাল্ট এসে হাজির। আর আমাদের সময়ে....। তোর দাদা গেলেন কলেজে রেজাল্ট আনতে....।
বাবা, তোমার এস.এস.সি’র রেজাল্ট পাওয়ার ঘটনা আমি শুনেছি।
এইচ.এস.সি’রটা তো শুনিসনি।
এ ঘটনাও সেরকমই হবে নিশ্চয়। কলেজে গেলেন। রেজাল্ট বুক আসেনি। পাঁচটা পর্যন্ত কলেজে বসে থেকে.......।
না না, এরকম না। একটা ঘটনার সাথে আরেকটা ঘটনার হুবহু মিল হয়না কখনো। এটা একেবারে ভিন্ন রকম।
আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না বাবা।
আরে বোকা মেয়ে, গল্পে গল্পে সময় কেটে যাবে। মুখ-টুখ তো লাল করে বসে আছিস।
বলো।
সকাল দশটায় বাবা গেলেন কলেজে। আমি আর তোর ফুপি থম মেরে বসে আছি। আমি বারান্দায় আর তোর ফুপি ঘরে জানালার পাশে। ভাবছি চার/পাঁচটার মধ্যে হয়তো তোর দাদা রেজাল্ট নিয়ে ফিরবেন। ওমা! বারোটার মধ্যেই বান্দা হাজির। হাতে দুই কেজি মিষ্টি। কিন্তু মুখে মিষ্টতা নেই একেবারে। মুখের সব মিষ্টি যেন প্যাকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি মিষ্টির প্যাকেট মেঝের উপর ঠাস করে নামিয়ে রেখে নিজে ধপ করে খাঁটের উপর বসলেন। মা কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। আমরা দুই ভাই-বোন সামনে দাঁড়িয়ে। আমার ততটা ভয় করছিল না। কারণ, পরীক্ষা দিয়েছিলাম আশানুরূপ। রেজাল্ট যে খারাপ হবে এরকমটা ভাবনায় ছিল না।
বললাম, কী রেজাল্ট হয়েছে বাবা? বাবা চিৎকার করে উঠলেন, তোমার এ্যাকাউন্টিং-এ লেটার মার্কস কই? কমার্সে পড়ে একাউন্টিং-এ লেটার মার্কস পাওনি, তোমার আর কমার্স পড়া হবে না। সোজা আর্টস-এ চলে যাবে।
নম্বরপত্র এলে দেখা গেল, আমরা দু’জনই খুব অল্প নম্বরের জন্য স্টার মার্কস পাইনি। আমার এ্যাকাউন্টিং-এ লেটার মার্কস হলেই স্টার মার্কস হয়ে যেত। তবে বাবার কথা মতো আমি আর কমার্স পড়তে যাইনি। আমি পড়তে গেলাম আইন, আর তোর ফুপি পড়তে গেলো ইংরেজি সাহিত্য। এখন তোর ফুপি কবিতা লেখে। অবশ্য ইংরেজি সাহিত্য পড়েছে বলে নয়, স্কুল জীবন থেকেই.......।
সে ওয়াক ওয়াক করতে করতে বাথরুমে চলে গেল। বাবা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।
সে বাথরুম থেকে ফিরে এলে বাবা বললেন, এতটা নার্ভাস হবার কি আছে বুঝি না। একেবারে বমি-টমি করে.......। হয় পাস নয় ফেল। জীবন মানেই তো এই। পাস করলে এগিয়ে যাও, ফেল করলে আবার চেষ্টা করো। ট্রাই ট্রাই এগেইন। বোকা মেয়ে!
দশটার দিকে বাবা আবার তার ঘরে এলেন। বললেন, তোর স্মার্টফোনটা দে তো।
আমার ফোন লাগবে কেন বাবা? বাসায় কি আর ফোন নাই?
আছে। বাসায় তোর ফোনটাই সবচেয়ে দামি। এইচ.এস.সি’র রেজাল্ট তো আর যেন-তেন কথা না। দামি ফোনটা দিয়ে জানা উচিত। তা ছাড়া, তোর রেজাল্ট তোর ফোনে আসবে-মজাটাই আলাদা।
বাবা রোল নম্বর টিপতে লাগলেন। সে পাশে বসা। মা এসে দাঁড়িয়েছেন কাছেই। মেসেজ সেন্ড করতে না করতেই রিটার্ন মেসেজ এসে গেল। মেসেজ দেখে বাবার ভুরু কুঁচকে গেল। মা বললেন, কী হয়েছে?
ভুল হয়েছে। রোল নাম্বার ভুল দিয়েছে।
তারপর বাবা তাকে ধমক দিয়ে বললেন, যাও, এডমিট কার্ড নিয়ে এসো।
এডমিট কার্ড আনতে হবে কেন? রোল নাম্বার তো আমার মুখস্ত।
তোমার যে কি মুখস্ত তা তো দেখতেই পাচ্ছি। সকাল থেকে শুধু ওয়াক ওয়াক করছো। এডমিট কার্ড আনো বলছি।
সে এডমিট কার্ড এনে বাবার হাতে দিল। বাবা চোখের চশমাটা নামিয়ে গ্লাস খুব করে মুছলেন। তারপর খুব ভাল করে দেখে নম্বর টিপলেন। মেসেজ সেন্ড করলেন। রিটার্ন মেসেজ এল। বাবা থম মেরে বসে রইলেন। মা বললেন, কী হয়েছে?
যা হবার তাই হয়েছে।
কী হয়েছে তাই বলো।
ডাব্বা কাত।
ডাব্বা কাত মানে কী?
মানে এফ গ্রেড।
এফ গ্রেড মানে কী?
এফ গ্রেড মানে কী তাও জানো না? লেখাপড়া কিছু শেখো নাই? এই জন্যই তো তোমার মেয়ের এই অবস্থা। যেমন মা তেমন তার মেয়ে। মা কা বেটি।
আমি ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া স্টুডেন্ট।
তাহলে এফ গ্রেড বোঝো না কেন? নকল করে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলে?
মেয়ে একেবারে ফেল করেই বসল!
হ্যাঁ করল। পরীক্ষা মানেই তো পাস অথবা ফেল। এর মাঝামাঝি কি কিছু আছে ?
বাবা-মা’র এরকম তর্কে মুহূর্তে সে ওয়াক ওয়াক করতে করতে বাথ রুমে চলে গেল।
বাথ রুম থেকে ফিরে এলে মা প্রায় চিৎকার করে বলতে লাগলেন, মেয়েকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তাকাও মেয়ের দিকে। দেখছো কেমন লাগছে। তুমি আজই মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও তো। গিয়ে ভাল করে দেখো, কি হয়েছে মেয়ের। এ কেমন চেহারা! পেটটা এমন.....!
তার পেটের মধ্যে তখন আবার সেই নড়াচড়া। কেমন ধাক্কা দিচ্ছে! ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। নিচ থেকে উপরে, উপর থেকে নিচে। হাত দিলে পেটের ফুলে ওঠাটা স্পষ্ট বোঝা যায়।
সারা দিনে একবারও কেউ ফোন করল না। সে আশা করেছিল, নিলয় ফোন করবে। এস.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্ট পাওয়ার মুহূর্তে সে ফোন করেছিল। তার কাছে রোল নাম্বার আছে। সে নিশ্চয় রেজাল্ট পেয়ে গেছে।
আর সুমন? প্রতি মুহূর্তে যার ফোন আসে। রোল নাম্বার তো তার কাছেও অনেক আগে থেকেই আছে। আগ্রহ ভরে নিজে থেকেই চেয়ে নিয়েছে রোল নাম্বার। সে তো গতকালই বলেছিল, সকালেই সে মেসেজ করে রেজাল্ট জেনে নেবে। তারপরেই পাঠাবে অভিনন্দন বার্তা। ফোন করে মৌখিক অভিনন্দন তো থাকবেই। তার পরে....।
অভিনন্দন পাবার মত কিছু হয়নি তা ঠিক। কিন্তু সান্ত¡না পাবার মত ব্যাপার তো ঘটেছেই। এত ভালোবাসা-স্বপ্ন যাকে নিয়ে সে কিছু সান্ত¡না বাক্য উপহার দেবে না? এ কেমন আচরণ তার?
২০.
সন্ধ্যা শেষ। নেমে এসেছে রাত। তার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে।
তার পেটের ভেতর সেই নড়াচড়া বিরামহীন। সেই বমি বমি ভাব। সেই মাথা ঘোরা।
কী হল তার? আজ রাগ করে বাবা তাকে ডাক্তারের কাছে নেননি। কাল নিশ্চয় নেবেন। তখন কী ধরা পরবে তার? কী বলবে ডাক্তার ? তার কি কঠিন কোনো রোগ হয়েছে? সে কি মরে যাবে? যদি তাই হয়, যদি সত্যিই সে মরে যায় তাহলে কে কে কষ্ট পাবে? বাবা-মা তো পাবেনই। একেবারে শূন্য হয়ে যাবেন। আর কে শূন্য হবে? নিলয়? এখনও কি নিলয় তাকে আগের মতই ভালোবাসে? এত অবহেলা-এত অপমান তারপরও কি সে ভালোবেসেই যাচ্ছে? সে মরে গেলে নিলয়ের চোখ ফেটে কি জলের ধারা নেমে আসবে? আর রিক্ত হয়ে যাবে সুমন। আচ্ছা, ছেলেটা তাকে এত ভালোবাসে কেন? কী দেখল সে তার মধ্যে? একেবারে পাগলের মত ভালোবাসা!
এইসব ভাবতে ভাবতে সে ফোনটা হাতে তুলে নিল। ফোন করল নিলয়কে। ফোন করতে না করতেই ফোন ঢুকে গেল। ঢুকতে না ঢুকতেই ফোন রিসিভ।
তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিলয় বলতে শুরু করল, তোমার রেজাল্ট আমি পেয়েছি। একেবারে ডাব্বা কাতই করে দিলে? তুমি যে মারাত্মক ধরণের প্রেম করেছো তা বোঝাই যাচ্ছে। প্রেম হল দুই প্রকার। এক-জীবনের জন্য প্রেম। দুই-প্রেমের জন্য জীবন। আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। আমার জীবনের জন্য চেয়েছিলাম। তোমার প্রতি আমার এখনও বোধহয় মোহ আছে। কিন্তু সেই মোহের কাছে আমি পরাজিত হতে পারি না। তুমি আমাকে পদে পদে অপমান করেছো, অপদস্ত করেছো, আর আমি তাতে বিপর্যস্ত না হয়ে খুঁজে নিয়েছি জীবনের আপন ঠিকানা। আর তুমি যেটা করেছো, সেটা হল প্রেমের জন্য জীবন। তুমি জীবনকে অবহেলা করে, প্রেম নিয়ে মেতে থেকেছো। যাকগে, তোমার মন এখন নিশ্চয় ভাল নাই। এখন তোমাকে প্রেম শেখানো ঠিক হবে না। শোন, আমি অস্ট্রেলিয়ার ভিসা পেয়ে গেছি। বাকি শুধু প্লেনের টিকিট কাটা। তুমি আর আমাকে ফোন দিও না। তোমার প্রতি আমার এটা অনুরোধ। নাও আই এ্যাম ভেরি বিজি। হ্যাভ নো টাইম টু টক আননেসেসসারিলি। রাখি, আবারও বলছি-নেভার ফোন মি এগেইন। ডন্ট টেক ইট ইন হার্ট, তুমি আমাকে অনেক অনেক অপমান-অবহেলা দিয়েছো, তার শোধ হিসাবে আমি শুধু আমার নতুন নাম্বারটা তোমাকে দেব না।
ঠিক আছে নিলয় ভাই, আপনার নাম্বারটা আমাকে দিয়েন না।
ভাল থেকো, সুন্দর থেকো।
আপনিও।
তারপর সে ফোন করলো সুমনকে। সুমিষ্টি কন্ঠে এক নারী বলল, দুঃখিত, আপনি যে নাম্বারে ফোন করেছেন, সে নাম্বারটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে একটু পরে আবার ডায়াল করুন।
মেয়েটির অনুরোধ মতো সে একটু পর আবার ডায়াল করল। কিন্তু সেই একই অনুরোধ। আবার। আবার। আবার। আবার। একই অনুরোধ।
রাত বেড়ে গেছে বেশ। তার চোখে ঘুম নেই। সে বিছানায় শুয়েছে কয়েকবার। শুলেই কেমন অশান্তি। চোখ জুড়ে আর সেভাবে ঘুম নেমে আসছে না। সে হাঁটাহাঁটি করে ঘরের ভেতর। তাতেও বিতৃষ্ণা-অস্বস্তিবোধ।
এভাবে অনেকটা সময় কাটানোর পর সে আবার দাঁড়ালো তার জানালার সামনে। তাকাল বাইরে। বাইরে নিয়ন বাতির আলো। তার ঘরও ভরে আছে নরম-সাদা আলোতে। কিন্তু তার চোখে যেন কোনো আলো নেই। সে শুধুই জমাট বাধা তীব্র অন্ধকার দেখছে তার চারিপাশে। তার মনে হচ্ছে, সে আদিম কালের কোনো এক অন্ধকার গুহায়, অথবা জন-মানবহীন কোনো বিজন বনে পড়ে আছে, যে বনের ভেতর সূর্যের আলোকছটা প্রবেশের কোনো অধিকার নেই। তার আশে-পাশে এমন কেউ নেই যে, তাকে হাত ধরে টান দিয়ে আলোতে নিয়ে যাবে।
একটু আলোর আশা বুকে নিয়ে সে সুমনকে আবার ফোন করে। আবার সেই মিষ্টি মেয়েলি কন্ঠের একই অনুরোধ। অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হল।
হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠল। একটা অপরিচিত নাম্বার। তারপরেও তার মনটা অনেকটা আশান্বিত হলো, কোথা দিয়ে যেন একটা আলোকছটা এসে ছড়িয়ে পড়ল তার চারপাশে। নিশ্চয় সুমন ফোন করেছে। সুমন মাঝে মাঝে এমনটি করে। হয়তো কোনো কারণে নিজের ফোনটা কাছে নেই, অথবা ফোন আছে তাতে ব্যালেন্স নেই, ব্যালেন্স নেবার কোনো সুযোগও নেই, তখন সে কোনো বন্ধুর নাম্বার থেকে ফোন করে। সে ফোন রিসিভ করল। ভরাট একটা পুরুষ কন্ঠ, কেমন আছেন?
কে বলছেন?
আমি খালেদ।
খালেদ!
হ্যাঁ খালেদ মাহমুদ। শেষ র্পন্ত আপনাকে ফোন করেই ফেললাম।
আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।
ও ভুলে গেছেন? আচ্ছা, মনে করিয়ে দিচ্ছি। আপনি যে একটা ফেসবুক আইডি খুলেছিলেন, সেখানে আমি আপনার বন্ধু তালিকায় ছিলাম। ইনবক্সে মাঝে মাঝে আমাদের কথাও হয়েছে। মনে পড়েছে নিশ্চয়? হঠাৎ আপনি আপনার আইডিটা বন্ধ করে দিলেন। তাবে, আপনার প্রফাইল থেকে আমি আপনার ফোন নাম্বারটা টুকে রেখেছিলাম। তারপর আপনাকে ফেসবুকে অনেক খুঁজেছি। আপনার নাম, ফোন নাম্বার দিয়েও আমি অনেক সার্স দিয়েছি। আপনি বোধহয় আর নতুন কোনো আইডি খোলেননি। যা হোক, আপনাকে যা বলার স্পষ্ট করেই বলি-আপনাকে আমার ভীষণ ভাল লেগেছে। না না, প্রেম-টেম করার কথা বলবো না। প্রেম করার মতো সময়ও আমার হাতে নেই। যখন ফেসবুকে আপনার সঙ্গে চ্যাট করেছি তখন আমি লন্ডনে ছিলাম। আমার পরিবারের সবাই লন্ডন থাকে। আমি দুই মাসের ছুটিতে দেশে এসেছি। বিয়ে করে বউ নিয়ে ফিরে যাব। সেখানে আমি হসপিটাল ম্যানেজমেন্টে গ্র্যাজুয়েট করেছি। ভাল একটা চাকরিও করছি। পাশাপাশি করছি মাস্টার্স। মাস্টার্স শেষ হলেই এখন যেখানে আছি সেখানে সিনিয়র ডাইরেক্টর হিসাবে প্রমোশন পাব। হ্যাঁ, তাদের সাথে এরকম কথাই ফাইনাল হয়ে আছে। ও হ্যাঁ, যা বলার ডাইরেক্টলিই বলবো-আপনি যদি রাজি থাকেন তো........। আমি আপনার প্রফাইলে দেখেছি যে, আপনার উচ্চতা পাঁচ ফিট চার। আমি এরকম টল ফিগারের একটি মেয়েই খুঁজছিলাম। আর আমার ছয় ফিট এক। আর আপনার এত ছবি দেখেছি যে.......। আপনার ছবিগুলো আমি আমার বাবা-মাকেও দেখিয়েছি। আপনি যদি হ্যাঁ বলেন তো আমি আমার বাবা-মাকে খবর দেব। খবর পেলেই তারা চলে আসবেন। এবার আপনি বলুন.......প্লিজ আমাকে.......।
তার পেটের ভেতর আবার সেই নড়াচড়া। নিচ থেকে উপরে, উপর থেকে নিচে। বাম থেকে ডানে, ডান থেকে বামে। আবার সেই বমি বমি ভাব। আবার সেই মাথা ঘোরা।
সে ফোনটাকে ছুড়ে ফেলে দিল খাটের উপর। তাকাল জানালায়। সেই অন্ধকার। গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। আবার বেজে উঠল ফোন। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালো ফোনটার দিকে। সেই অপরিচিত নাম্বারটা। তাকে ভালোবাসে। প্রেম করবে না। বিয়ে করে লন্ডন নিয়ে যাবে। মনে হল, ওটা একটা বিষাক্ত গোখড়া সাপ। তার দিকে ফণা তুলে আছে। সে হাত বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দিয়েছিল। আবার বেজে উঠল। রিংটোনটাকে মনে হল, বিষাক্ত গোখড়ার ফোঁস ফোঁস আওয়াজ। গোখড়াটা যেন সুযোগের অপেক্ষায় আছে তাকে ছোবল মারার। অথবা ইতিমধ্যেই ছোবল হেনেছে। বিষ ঢুকে গেছে তার শরীরে। বিষে তার শরীর নীল হয়ে যাচ্ছে। সে ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। সেই মৃত্যুটাকেই তার কাছে এমন গাঢ় অন্ধকার মনে হচ্ছে।
আচ্ছা, মানুষ মরে গেলে কোথায় যায়? কোনো অন্ধকারে হারিয়ে যায় নিশ্চয়।
[চলবে...]