শীতল সন্তাপ
সাদিক আল আমিন
...তারপর আবার লোকটা বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। কাদাময় নগ্ন মাটির শুকনো বুক ঝিরঝির ফোঁটায় থিতু হয়ে ভিজতে থাকলে মাটির মতো সেও শক্ত কাঠ হয়ে থাকা শরীরটা বৃষ্টির পানিতে ঢিলেঢালা করে নিতে লাগলো। মাটির মতো হতে চাইলেও কাদা আর মাংসের পার্থক্য বুঝতে পারলোনা। নাম তার নিজাম। নিজু বলে ডাকে সহকর্মীরা। বয়স হবে চল্লিশের ওপর। নিজেরও ধারণা নেই এ বিষয়ে। বিয়ে-শাদি সব পানির আর জলজ প্রাণীদের সাথে। মানুষের সাথে হয়নি।
শনিবার বাদে ছয়দিনই কাটে গভীর নদীতে, নদীর সীমানা ছাড়িয়ে কখনো আবার আরেক মা-নদীতে। অথৈ জল¯্রােতে দীর্ঘ নৌকার কোণায় বাধা বৃহৎ জালটাতে যখন টান পড়ে, ভবের দুনিয়ায় ভাসতে ভাসতে তখন দেহটা পেছনে বাঁকিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে জালটা টানতে থাকে। তখন মরা বাপ-মা, চাচা-চাচি কারো কথা মনে পড়েনা। মিলিয়ে যায় প্রয়োজনীয়তাও। শারীরিক কিংবা মানসিক। যেই মাছগুলো উঠে আসে সেগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাপারীর কাছে চালান দিতে হবে। সাথে উঠে আসা কয়েকটি ঢ্যাপড়া কাঁকড়া নিজামের পেশীবহুল হাত আর পায়ের সাথে নিজের পেশীগুলো পেঁচিয়ে শক্তির প্রমাণ দিতে থাকে। আরেক হাতের টানে দ্রুত সেগুলোকে পানিতে ফেলে নিজাম। রোজই হয় এ ঘটনা। কখনো কয়েকজন সহকর্মীর সাথে আসে, কখনো আসে একা। কখনো জরিফের ছোট ছেলেটাকে নিয়ে আসে। বারো-তেরো বছর বয়স। বিয়ে করলে তারও এমন ছেলে হতো। জাল টানতে পারতো। একদিন যেমন হঠাৎ নদীর বুকে অবশ হয়ে তার স্বাস্থ্যবান দেহটা পড়ে গিয়েছিল, সেদিনও পারতো একটু একটু সাঁতার কেটে বাপকে বাঁচাতে। নৌকায় বাঁধা দড়িটা পায়ে আটকে গিয়েছিল বলেই সেদিন রক্ষা হয়েছিল। নাহলে খর¯্রােতা জলে ভেসে যেতো কোটি কোটি শ্যাওলার মতো।
নৌকা বাঁধা তীরে। এখন প্রচন্ড বৃষ্টি। নিজাম পাড়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকে। শুধু বৃষ্টি হলে নৌকা নিয়ে যাওয়া যেতো, তবে যা বাতাসের বেগ, বৃহৎ নৌকাটাকেও উল্টিয়ে দিতে পারে। বাতাসের বাহু ছোঁ মেরে নিজামের লুঙ্গি কেড়ে নেয়। উল্টিয়ে দেয় তার শরীরটাকেও। মেশিনগানের গুলির মতো বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলা বিঁধতে থাকে বুকে-পিঠে, মাথায়-পাছায়। বালুর মাটিতে ঢিপঢিপ করে ছোট ছোট গর্ত করতে থাকে জলবুলেট। গভীর মাটির সাথে মিশে কাদা হতে থাকে। নিজাম বাতাসে কেটে যাওয়া ঘুড়ির মতো উড়ে বেড়ানো লুঙ্গিট পেতে অযথা হাঁতড়িয়ে বেড়ায়। আবহাওয়ার কথা আগেই জানা ছিলো জেলেদের। কেউ তাই আসেনি। নিজামের রক্তে ফুটে ওঠা নেশার পারদ শক্ত দেহটাকে ঠেলে নিয়ে এসেছে। আজ পুরো নদী, তারপর নদী পেরিয়ে পুরো সমুদ্রের তাবৎ মাছ নিজের বজরায় পুরবে, এমন প্রতিজ্ঞায় উঠে এসেছে তার অবিশ্রান্ত দেহ। বহু চেষ্টার পর লুঙ্গিটা হাতের নাগালে পেলে এমন শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেলে যে পেট দুই ইঞ্চি ভেতরে ডেবে যায়। পায়ের তলের মাটি থকথকে কাদা হয়ে তার পা দুটোকে লেপ্টে ধরে রাখে। তখনই যেন সঙ্গহীন জীবনে যুগলতার সুখ অনুভব করে। টাকনু ভরা পানির গোড়ালি ভরা কাদা। পা উঠাতে চাইলে আঠালো কাদা নিমিষে ছাড়তে চায়না। ছাড়িয়ে নেবার উৎসাহটুকুও দেখায় না নিজাম। খুব ধীর, মন্থর তার পায়ের গতি। কাদার মতো নিজেকেও ভাবতে থাকে। অর্ধেক নৌকা পানিতে ভর্তি হয়ে যায়। যাওয়ার কোনো কারণ আর তখন থাকেনা। বৃষ্টির থামারও নাম নেই। কিছুক্ষণেই পুরো বজরা ডুবে যাবে। এ বর্ষণ তার ধারণামতে এক সপ্তাহ চলবে। কিংবা তারও বেশি।
২.
হাকিম ব্যাপারীর মুখ বড় করে পান চিবানোর ভঙ্গি দেখে বলে দেয়া যায় এক ট্রাক মাছের বিনিময়ে কত টাকা পাওয়া যাবে। তবে সে ধারণা ক্ষেত্রবিশেষে আগ-পাছ হয়। ভুড়ির খাঁজে গেঁথে থাকা লুঙ্গির বানে গুটলি করে বেঁধে রাখা টাকার বান্ডিল বের করে গুনতে থাকে ব্যাপারী। সামনে নিজেদের ভাগে একটু বেশিই আসছে কিনা, আসলে খুব ভাল হয় চিন্তা করতে থাকা জেলেদের উৎসুক মুখ দেখে ব্যাপারী কিছুক্ষণ থামে।
‘গুনেন না কেনে’, বলে ওঠে এক জেলে।
পেছন থেকে আরেকজন বলে, ‘মুই কিন্তু কাইলকার থাকি বেশি টাকা নিম। কাইল মোক ঠকাইছেন।’
নিজাম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টির কারণে মাছ তো কি, মাছের ডিমটাও ভালোমতো মারা হয়নি। এক ডেকচি কোনোমতে ভর্তি করে হাকিমের কাছে এনেছে। কত দেয় সেটা তার ব্যাপার। মনে মনে ভাবে নিজাম। ব্যাপারী পান খাওয়া মুখের লাল পিকে আঙুল ভিজিয়ে নিয়ে আবার টাকা গুনতে থাকে।
ভাগ-বাঁটোয়ারা ন্যায্যই হয়েছে। দুইশ টাকা পুটলিতে ঢুকিয়ে বাড়ি ফিরতে প্রস্তুত হয় নিজাম।
বৃষ্টির ধারণা এক সপ্তাহ হলেও এক মাসেও তা আর থামেনা। নদীর সব মাছ সমুদ্রে যায় নাকি সমুদ্রের হাঙর-তিমি নদীতে আসে খেয়াল পায়না নিজাম। বন্যায় পুরো নদীবর্তী গ্রাম ডুবে গেলে নিজের ছোট ঘরের মালপাতি যা ছিলো সব নৌকায় তুলে ফেলে। সেই যে হাকিম ব্যাপারীর কাছে দুইশ টাকার মাছ বেচেছিল, পরে আর বেচা হয়নি। যাওয়াও হয়নি জাল নিয়ে। মাঝখানে এক-দুদিন অবশ্য অন্য জেলেরা গিয়েছিল। নিজামকে এসে ওরা বলেছে কেউ, ‘না ভাউ। কোনো মাছ তো পাইনু নি একমুঠ পুঁটি আর মলা ছাড়া।’
কেউ আবার বলেছে, ‘মাছের কি আর অভাব আছে নাকি? উত্তিকার সব মাছ এতি আইছে। আধ ট্রাক বেচি আইনু বেপারির কাছত।’
নিজাম বুঝে পায়না কে সত্যি বলছে কে মিথ্যা। আগের দিনের মতো মণ-কে-মণ মাছ মেরে সবার চোখে তাক লাগিয়ে দেয়ার উৎসাহ অথবা লোভ আর নিজের মধ্যে অনুভব করেনা সে। একমাসের ক্রমাগত বর্ষণে ক্রমেই সেই উৎসাহে মাটিচাপা পড়েছে। লোভও হয়ে গেছে সামান্য বস্তু।
৩.
নৌকা বাইতে বাইতে অন্য মোহনায় চলে যায় নিজাম। তারপর অন্য নদীতে। বৃষ্টি কেটে যায় ততদিনে। নবজাতকের মতো সন্তর্পণে ডানা মেলতে থাকে মিহি রোদ। সমতলের পানি নেমে যায় নদীতে। নিজের গ্রাম ছাড়ার দশদিন প্রায় হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনহীন সে জায়গায় আর যেতেও ইচ্ছে করেনা। এই নদীটাও বেশ খর¯্রােতা। ছলক করে একটা রুই রুপোলী দেহে লাফ দিয়ে উঠে নিজামের নৌকায়। তারপর আরেকটা মৃগেল। জাটকা ইলিশ। নৌকা সোজা রেখে জালটা দুইহাতে নিয়ে প্রস্তুত হয়। ডান হাত দিয়ে জোরে ফিকতেই মনে হয় যেন হাতটা অবশ হয়ে আসে। শরীরটা যেন এলিয়ে পড়তে চায় নদীতে। ক্ষুধার্ত জলরাশি যেন নিজামের অলস দেহটাকে চুম্বকের মতো টানে।
মাছ মেরে আরো অবসন্ন হয়ে যাবার পর ভাবে চালানের কথা। তার নিজের গ্রামে ব্যাপারী থাকলেও এখানে, এই অজানা মোহনার তীরে পাইকারী বিক্রি করার মতো কেউ নেই। দোকানদারও নয় যে হাটে একটা বস্তার ওপর বিছিয়ে মাছগুলো বিক্রি করবে। এদিক সেদিক খোঁজ নিয়ে জানলো এই গ্রামের ব্যাপারী একজন বেঈমান লোক। মাছ অনুযায়ী নাকি টাকার মূল্যটা অর্ধেকও দেয় না। কোনো সময় আবার বাকির বাহানা করে পরে আবার বেমালুম মনে হারিয়ে ফেলে। এ গ্রামের জেলেরাও অন্য গ্রামের ব্যাপারীর কাছে মাছ বেচে আসে, এমনটাই শুনলো নিজাম। উপায় না পেয়ে বজরাভর্তি মাছ নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ে নিজাম। নদীর শরীরের প্রতিটি স্তরে তার বিচরণ হয়। দেহের মতো নদী বদলায়, মোহনা বদলায়। পানি কখনো বাড়ে, কখনো কমে। কোনো এক গঞ্জের উদ্দেশ্যে যেতে যেতে আবার মাছ মেরে ড্রাম ভর্তি করে। দশটা ড্রাম মাছে টইটম্বুর হয়ে যায়। আরও মাছ মারে নিজাম। ছোট কই, ট্যাংরা, শিংগি, গচি, বাইন বজরার ফাঁক-ফোঁকরে নিজেদের পিচ্ছিল দেহ গলিয়ে দেয়। কিছু মাছ লাফ দিয়ে ড্রাম থেকে নৌকায় পড়ে। কিছু পড়ে নদীতে। নিজামের পায়ের কাছে অনবরত কিলবিল করতে থাকে মাছেদের শীতল শরীর। লোভের চোটে আরো মাছ মারতে জাল ফেলবে এমন সময় ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যায় দূরে চোখ মেলে দেখে তীব্র আলোর ঝলমলানি। গমগম করতে থাকা সন্ধ্যাকালীন হাট। এখান থেকে আর মাত্র একশো হাত দূরে। মাছ, গোশত, কাঁচাসবজির গ্রাম্য এক পরিচিত বাজার। নৌকাটা ধীরে ধীরে পাড়ে ভেড়ায় নিজাম। এই হাটে নিশ্চয়ই মাছগুলোর চালান দিতে পারবে! এবং হাটের এক কোণেই একটা ছোট মাঁচার ঘর উঠিয়ে এখানেই বসত বানিয়ে থাকবে, এমন কিঞ্চিৎ আশা নিয়ে নিজাম সামনে এগোয়। নৌকা বেঁধে রাখে শক্ত খুঁটি গেঁড়ে। ড্রামগুলোতে শতশত জীবন্ত মীন উথালপাতাল লাফাতে থাকে।
৪.
‘হামার কাছত একখান পান খান তো বাহে। তারপর টাকা গুনেন।’
গঞ্জের মাছহাটিতে এক লোককে একথা বলতে শুনে নিজাম। যাকে উদ্দেশ্য করে বললো তার দিকে তাকালে দেখা যায় মাঝবয়সী এক পরিচ্ছন্ন ভদ্রলোক। গায়ে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী, মুখে সুন্নতি দাঁড়ি। নিজাম ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তার দিকে। জেলেরা তাকে ঘিরে ধরে মাছের ওজন বলে আর টাকা গুনে নেয়। নিজাম ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তা মাছের মন কত করি দেছেন ভাইসাহেব?'
আগন্তুক কেউ একজন হঠাৎ করে এসে এমন প্রশ্ন করলে যেমন প্রতিক্রিয়া হয়, সেই ব্যাপারী এবং জেলেদের চোখেও সেরকম প্রশ্নসূচক এক জিজ্ঞাসু ভঙ্গিমা দেখলে নিজাম বিনীত হয়ে বলে, ‘মানে হামার নাম হছে নিজাম। হামার বাড়ি ইসমতপুর।’
ব্যাপারী বলে, ‘ইসমতপুর তো ওই দক্ষিণ পাড়াত। দুইদিন নাগে ওঠেনা যাইতে। তো তোমহা এত্তি কি মনে করি?’
‘কথা হছে যে বন্যাত হামার এলাকা সব ডুবি গেছে। আর...’
‘হু হু। সেই খবর তো জানো হামরা। আল্লা কখন বেজার হই যায় কে কহিবা পারে কহেন!’
‘হামার বাড়িঘর সব ডুবি গেছে পানিত। হামা বিয়া-সাদিও করোনাই। আত্মীয় কইতেও কেউ নাই। এত্তি মাছ মাইতে মাইতে আইছি। সেই মাছলা এলা তোমহার কাছত বেচিবা চাহেছি’
‘ও, তো এই হছে কথা। তো তোমরা কতলা মাছ মারিছেন তে?'
‘এই ধরেন কেতে দশ-পনেরো ড্রামের মতন। পঞ্চাশ মণের মতন মাছ হবি।’
নিজামের কথা শুনে সবাই তাজ্জব খেয়ে যায়। বিশেষ করে জেলেরা। তারা ইহজন্মে এতো মাছ তো মারেইনি, মারার স্বপ্নও দেখেনি। এক জেলে প্রশ্ন করে বিস্ময়ে,
‘বাপ রে! এতোলা মাছ কেম্নে মারিলেন বাহে! তাও ফির একাই! হামার বাপ-দাদারও তো সাধ্য আছিল না এতোলা মাছ মারার।’
নিজাম মাথা চুলকে বলে, ‘ওই আরকি মাইরছি কোনোমতে।’
ব্যাপারী বলে, ‘তা তোমহার মাছলা কোনঠে?'
‘ওই যে নৌকাত আছে। ড্রামভর্তি। তোমহাক একটু সাহায্য করিবা হবি ড্রামলা এঠেনা আনিবা।’, জেলেদের উদ্দেশ্য করে নিজাম বলে। তারাও বেশ উৎসাহী নিজামের প্রায় পঞ্চাশ মণের মতো মাছ দেখতে। তারা বলে,
‘চলেন তাইলে লে আসি ড্রামগুলা।’
পাঁচ-ছয়জন জেলে কয়েক ধাপে ড্রামগুলো নৌকা থেকে ব্যাপারীর কাছে নিয়ে আসে। বলে, ‘তোমহার ড্রাম এতো ভারি বাহে! লাখ টাকার মাছ মাইরছেন মনে হয়।’
নিজাম তৃপ্তিতে মুখে একটা চিকন হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে। ব্যাপারী বলে, ‘কই বাহে, খুলেন না কেনে ড্রামগুলা। দেখি কত মাছ মাইরছেন।’
জেলেদের আর তর সয়না। তারা হামলা দিয়ে ড্রামের মুখগুলো খুলে। তারপর হঠাৎই সবাই বিদ্যুতাঘাতের মতো ছিঁটকে ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে। নিজাম আর ব্যাপারী বিষয়টা বুঝতে না পেরে ড্রামগুলোর দিকে যায়। একজন চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘খবরদার, যান না ব্যাপারী সাহেব। ড্রামভর্তি সাপ!’
সাপ! বিশ্বাসই করতে চায়না নিজাম। দৌঁড়ে গিয়ে হুমড়ি দিয়ে পড়ে ড্রামের মুখে। দেখে, ড্রামভর্তি শতশত কালো সাপ কিলবিল করছে।
আরেকজন বলে ওঠে হুৎকার দিয়ে, ‘এই বাহিনচোদ সাপ ড্রামত করি নিয়া আইছে হামাক মারিবার তাহানে।’
নিজামের কষ্ট করে মারা মাছগুলো যে আদতে সাপ তা একদমই বিশ্বাস হয়না তার। দুয়েকবার হাতে চিমটি কাটে। চোখদুটো দুই হাতে কচলিয়ে বাকি ড্রামগুলো খুলে। দেখে, দশ-পনেরোটা ড্রাম সব সাপে ভর্তি। মাছের ছিঁটেফোঁটাও নেই। কতোগুলো সাপ দেহ বাঁকিয়ে ড্রাম থেকে মাটিতে পড়ে। পুরো হাট ‘সাপ! সাপ! ভাগেন সবাই’ আর্তনাদ করতে করতে মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যায়। নিজামের দেহটি জড় হয়ে খোলা ড্রামগুলোর পাশে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। বিস্ময়, হতাশা, অপূর্ণতা গ্রাস করতে থাকে তাকে ক্রমে ক্রমে। কুচকুচে কালো দেহের শতশত সাপ নিজামের পায়ের কাছে জড় হয়, শরীর বেয়ে মাথায় ওঠে তারপর ক্রমাগত দংশন করে। নিজামের মাথা, কপাল, গলা, বুক, পেট, নাভি, শিশ্ন, উরু, নিতম্ব, পায়ে গ্যালন গ্যালন বিষ প্রবেশ করতে থাকে। সারা শরীরে সে শীতল স্পর্শ অনুভব করে। সারাজীবন যেই নিজামকে জড়িয়ে ধরার মতো কেউ ছিলোনা, সেই নিজামের সমস্ত শরীরের প্রতিটি অঙ্গ শীতল আলিঙ্গনে ছেয়ে যায়। ঠান্ডা শরীরটা ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ে মাটিতে। সাপগুলো বিচ্ছিন্নভাবে যত্রতত্র ছুটে পালায়। কিছু সাপ নিজামের হাতে-পায়ে নিজেদের শরীর পেঁচিয়ে রাখে।
তখন হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। ঝলমলে রঙিন হাট বৃষ্টির চকচকে ফোঁটায় আরো উজ্জ্বল হতে থাকে। দ্রুতবেগে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে বিঁধতে থাকে। বিঁধতে থাকে নিজামের সারা শরীরে। বৃষ্টি পড়তে থাকে অনবরত। হাট ডুবে যেতে থাকে ক্রমে। নদী হয়ে ওঠে গর্ভবতী। দূরে বেঁধে রাখা নিজামের বড় নৌকাটা পানিতে ভরে ওঠে ক্রমাগত। এই বর্ষণও হয়তো একমাসের মতো স্থায়ী হবে, কিংবা তারও বেশি; শেষ পলক ফেলার আগে নিজাম একথা ভেবে একেবারে নিথর হয়ে যায়।