দ্বীপ সরকারের কাব্য
‘ডারউইনের মুরিদ হবো’
কবির মুকুল প্রদীপ
‘এই একঘেয়েমি বিরুদ্ধাচার কেন? সহনশীল হলে ক্ষতি কি হে দাপুটে আকাশ?
একটু নিরপেক্ষ হতে শেখো ,
আকাশকে মাটিতে নামিয়ে, সম্মুখে দাঁড় করিয়ে কবিরাই বোধহয় এভাবে প্রশ্ন করতে পারেন। উপদেশও দিতে পারেন, কেননা তিনি কবি, কোনও সাধারণ মানুষ নয়। এটা অবশ্যই মিথ্যে নয়। তবুও এভাবে কবিদের এলিয়েন বানিয়ে ফেলার প্রয়াস কিংবা মহৎ ভাবাটা রাজনৈতিক; পীড়াদায়কও বটে। তবে প্রকৃত কবি অবশ্যই একটি ভিন্ন সত্তা লালন করেন, সাধারণের মাঝে থেকেও অসাধারণ হয়ে ওঠার প্রয়াস পায় তাঁর জীবন ও কাব্যে। কবি দ্বীপ সরকারের কাব্য, ‘ডারউইনের মুরিদ হবে’' পাঠের পর আমারও তেমনটাই মনে হয়েছে। কারণ জীবনের ভেতর থেকে জীবনকেই বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে খুঁজে ফিরেছেন কবি, যার ভেতরে স্পষ্ট হয়েছে কবির বোধ, নির্মাণ দক্ষতা এবং আত্মপ্রতিকৃতি।
গুহাযুগ থেকে কৃষিনির্ভর ও আধুনিক জীবনে আসতে মানুষকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। যাপনপদ্ধতির সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে চিন্তার জগত, ফলত কবিতার ভেতরেও এইসব বিবর্তন লক্ষ করা যায়। তাই বিজ্ঞজন ও বিদগ্ধ পাঠক মনে করেন ইতিহাসের বিশুদ্ধ নির্যাস কবিতার ভেতরেই দৃশ্যমান হয়। সময়ের কবিতায় পাঠক এমন বিশ্ববীক্ষা পছন্দ করেন। কিন্ত‘ ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় অন্য আর এক অভিজ্ঞতার সম্মুখে, প্রমাণ করে দেন মানুষ আসলে স্মৃতিকাতরতা নামক এক রোগে আক্রান্ত। কারণ মানুষ প্রকৃতি সাংঘর্ষিক, বহন করেন দীর্ঘ যাপনাভিজ্ঞতার প্রতœ, ফলশ্রুত সভ্যতার আড়ালে মানুষকে ভোগ করতে হয় বহু শারীরীক প্রতিবন্ধকতা। কবিরাও এর ব্যতিক্রম নন, কবিরাও যাপন অভিজ্ঞতা, দর্শন, স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হন, ফলে তাঁদের কবিতাকর্মটিও হয়ে পড়ে একরৈখিক। ‘ডারউইনের মুরিদ হবো’ কাব্যে কবি দ্বীপ সরকার এমন অভিজ্ঞতাকে সচেতনভাবে অতিক্রম করার প্রয়াস পেয়েছেন, আবার আক্রান্তও হয়েছেন।
এই কাব্যের ভূমিকায় কবি-প্রাবন্ধিক বীরেন মুখার্জী যথার্থই বলেছেন, বিষয় আশয়ের বাসনা থেকে বেরিয়ে যদি ধ্যানি হতে পারেন তবেই কবি দ্বীপ সরকারের মোক্ষ লাভের আশা আছে। তিনি এই কাব্যে ছন্দহীনতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ব্যক্তিগতভাবে এই কাব্য নিয়ে কিছু লিখতে বসে আমার যখন কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ’ 'ভিন্নভাষার গোলাপজলে'র দ্বারস্ত হতে হয়েছে, তখনই মনে হয়েছে প্রথম গ্রন্থ’ থেকে বেরিয়ে দ্বিতীয় গ্রন্থে’ কবি পাঠকদের অন্য অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করতে চেয়েছেন। ফলে কবিতা হয়ে উঠেছে নিরীক্ষাপ্রবন, যার চাপ এসে পড়েছে কবিতার শরীরে। ভাষা, ছন্দ এবং কাঠামোর ওপর। আমি কবিতায় নিরীক্ষার পক্ষে তবে শিল্পের শাশ্বত স্বতঃস্ফূর্ততাকে অক্ষুণ্ন রেখে। কবিদের এই একটাই তো অস্ত্র, ‘শব্দবাণ’। কবি দ্বীপ সরকারকে এই ‘শব্দবাণ’ আরও শাণিত করতে হবে, কেননা তাঁর কবিতায় শব্দজট হয়ত নেই কিন্ত‘ মেদবহুল; বিনির্মাণগত ত্রুটি আছে। নিম্নে আমি এই ধরনের কিছু স্তবক তুলে দিচ্ছি পাঠকের জ্ঞাতার্থে-
এক কুয়াশা সকালে ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসলো ‘চোখ মোড়ানো’ বেজি
বিষাক্ত গোখরা লেজের ওপর দাঁড়ালো এবং
বেজির ‘চোখ মুখে’ প্রাজ্ঞের বিষ ছুড়ে দিলো-
[বেজি ও গোখরা]
এই বুদবুদের ‘নিকটে’ একদিন প্রশ্ন করেছিলাম
[বুদবুদ]
তবে ‘উনুনে বসা’ তহমিনা খাতুন উত্তর দিয়েছিলেন
[বুদবুদ]
উজানে বাড়ি তার- সাঁতার শিখেছি যেতে
অক্টোপাস এসে ঘিরে ফেললো- রক্ত চুষে খেতে
যুদ্ধের ডানা উঁচিয়ে- একাত্তরের গল্প শুনোই
পাতাল থেকে মুক্তো কুড়ানোর অভিজ্ঞতা বুনোই
হেঁচকা দেই, খুলে যায় পাতাসমূহের বল্টু ও নাট
অক্টোপাস মরে গেলো- সাঁতরিয়ে পেরলাম ঘাট
[ডুমুর ডুমুর চোখ তার]
একদিন শিশিরের সাথে বাজখাই আকাশের বিরোধ আঁটে-
চাকচিক্য রৌদ্রের ফেনা ছিটাতে থাকলো
ভোরে শিশিরের মৌন মিছিল আগুনের ফায়ারিং চালালো
‘শিশিরের জিবের ভেতর গুজিয়ে দিলো টেরাকাঁটা মাছ’
অন্য ভাষার ছেদ চিহ্ন-
[শিশির আর ঘাসখেকো গাভী]
চোখ মোড়ানো বেজি ‘শব্দবন্ধ’ আমার সম্মুখে কোনও স্পষ্ট চিত্র কিংবা চিত্রকল্প নয়, কারণ এমন শব্দবন্ধ আমার অপরিচিত এবং দুর্বোধ্য কিংবা ‘চোখ মুখে’ না হয়ে হতে পারতো ‘চোখেমুখে’। হয়ত এ আমার নিজেরই অক্ষমতা! তবে ‘এই বুদবুদের নিকটে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম’ কিংবা ‘উনুনে বসা তহমিনা খাতুন’ এর মতো পঙ্ক্তি অবশ্যই ভুল। কারণ ‘তহমিনা খাতুন’ উনুনে বসতে পারে না, পারে উনুনের পাশে বসতে। আর সামাসোক্তি অলংকারের মাধ্যমে বুদবুদের ওপর প্রাণসত্তা আরোপ করে প্রশ্ন করা যায় কিন্ত‘ বুদবুদের ‘নিকটে’(!) প্রশ্ন করা যায় না। তাছাড়া ‘ডুমুর ডুমুর চোখ তার’ কবিতা বা আরও কিছু কবিতার ছন্দ প্রয়াস কবির ছন্দ দুর্বলতার প্রমাণস্বরূপ, আর 'শিশিরের জিবের ভেতর গুজিয়ে দিলো টেরাকাঁটা মাছ’ পঙ্ক্তিটি নির্দিষ্ট কোনও চিত্রকল্পের ইঙ্গিত বহন করে না।
এরকম সাধারণ কিছু চ্যুতি-বিচ্যুতি বাদ দিলে দ্বীপ সরকার একজন সম্ভাবনাময় কবি। তাঁর কবিতায় আছে এক নস্টালজিক ঘোর,
‘ছায়াউরুর মাঝখানে মেঘের ছই আগলে ধরলে
আমি মুখ গুজিয়ে ওম চেখে নিচ্ছিলাম; মনে পড়ে
মূলত দ্বীপ সরকার কোনও উ”চকণ্ঠ কবি নন, তার স্বর মৃদু গম্ভীর ও রোমান্টিক এবং অর্থময়। আছে উপদেশ আর ক্ষীণভাবে হলেও অধিবিদ্যা। ‘মুখ থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে পদ্য এবং পাখির কিচির মিচির’ এই তো কবিতা! এমন পঙ্ক্তি যিনি রচনা করতে পারেন তিনিই তো কবি। তবে কবিতায় উপদেশ পামর স্বরূপ, ব্যক্তিগতভাবে আমার পাঠে বিঘœ ঘটায়। যদিও রুচিভেদে সেটা খ-িত নয়, সুতরাং আসুন আরও কিছু সম্ভাবনাময় স্তবক পড়ি-
নদীতে পরিচিত হাওয়ারা টোকা দিচ্ছে
আর অদ্ভুত মাছগুলো অপহরণ করে চলেছে নদীর গল্প,
গোসল করতে নামা শিশুটির মাদুলিতে ঝুলছে বেড়ে ওঠা কৌশল
বালিকাদের মনে উপচে পড়ছে খ-িত দৃশ্যের পুরাণ,
মূলত এগুলো আমার কবিতা নাও হতে পারে-
[খসরা এবং প্রস্তুতি বিষয়ক পাঠ]
স্মৃতিরোদে পুড়তে ভালোবাসে বলেই স্মৃতির কাছে ফিরে যায় মানুষ
আদিকাল থেকেই এই পোড়া বিষয়ক খুঁটিনাটি জানা;
বিষণ্নের ব্যাখ্যা থেকে একটু দূরে যেতে চাই
একটু ভিন্ন দিকে- তমাল জারুল চেরা মেঠোপথে
অথচ অবসন্ন আঁকড়ে ধরে আমাকে
পুনশ্চ ফিরে আসি-যেখানে স্মৃতির নোঙর ভিড়ানো,
[শুচিবাই]
ঐতিহ্যের বড়শিতে ঝুলে থাকা শতাব্দীর মাছ,
কার্নিশে নতজানু হয়ে বসে থাকা কুসুম করোটি
আমার প্রতিক্ষায় আছে- ওরা এভাবেই থাকে
[ঘর পলায়ন ইচ্ছেসমূহ]
আমার দাদি সন্ধ্যার আকাশ পানে তাকিয়ে বলতেন-
দেখ্ ঐ চাঁদের কুঁজো বুড়িটা নিরত শুঁটকির মতো ভেঁজে ওঠে
এলোকেশি চুল নাড়িয়ে দেয় চাঁদের মাচানে
[চন্দ্রপুরাণ]
সর্বোপরি কবি বীরেন মুখার্জীর মতো আমিও কবি দ্বীপ সরকারকে কবিতার কারিগর হিসেবে পেতে চাই, তবে তার জন্য পাঠককে আরও কিছুটা ধৈর্য রাখতে হবে। ‘ডারউনের মুরিদ হবো’ কব্যে যার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। আছে সমাজ-জীবন ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং দেশপ্রেম। তিনি অর্থময়, ইন্দ্রিয়জ অথবা অতিইন্দ্রিয়জ চিত্রকল্প নির্মাণে ঝোক থাকলেও তা এখনও সুনির্দিষ্ট নয়। তথাপি আমি নিশ্চিত---এই কাব্যপাঠ সকল শ্রেণির পাঠককেই তৃপ্তি দিতে সক্ষম হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই কাব্যের বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করি।{বইটি পাওয়া যাবে কাাঁটাবন, অনুপ্রাণন প্রকাশনীর বিক্রয় কেন্দ্র ,ঢাকা ও বইমেলা ২০২০ এর ২৩১ ও ২৩২ নম্বও অনুপ্রাণন এর স্টলে}
জয় হোক কবিতার।
নালিতাবাড়ি, শেরপুর।