চিঠি ও কবিতা



প্রিয় সামীর,

তুই ভালো নেই জানি। তাই জিজ্ঞেস করলাম না কেমন আছিস!
আজ ৬/৭ বছর হয় তোর কথা মনে হয় না। বলতে পারিস ভুলেই গেছি । তবে তুই চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন নীরবে কেঁদেছি। মাথায় শুধু একটি কথাই ঘুরপাক খেতো মানুষ কীভাবে পারে এতটা বেইমান হতে? এত দ্রুত?  কীভাবে সম্ভব এমন?  তোকে ভেবে প্রায়শই  তোর কাছে  পত্র লেখতে বসতাম ।  কিন্তু দুয়েক লাইন লেখার পর আমি লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলতাম, হাতের আঙ্গুল গুলো কেমন যেনো উদ্ভূত ভাবে  কেঁপে উঠতো খুব।  তাই অনেক গুলো চিঠি অর্ধেক লেখাই রয়েগেছে পুরনো ডাইরিতে।  কী জানি! হয়তো আমিই অপরাধী ছিলাম তাই আঙ্গুল গুলো এমনভাবে কেঁপে উঠতো অথবা তোর এমন নীরব চলে যাওয়ায় আমার ক্ষোভে মন অনশন করে বসতো।

কথা দিয়েছিলাম এক সাথেই আমরা সর্বত্র ঘুরে বেড়াবো।  অথচ পারলি না কথা রাখতে। সেদিন বড্ড তাড়া দেখিয়ে খুব সুকৌশলে ওয়াদা ভঙ্গ করলি। চলে গেলি!  সেদিন এত তাড়া ছিলো তোর যে আমি সব কিছু গুছিয়ে উঠার আগে তুই  ট্রেন চড়ে বসলি। পারলাম না, আমি সেদিন তোর সাথে যেতে পারলাম না। সেদিন ট্রেনের আচরণটাও ছিলো বেশ  অদ্ভূত ছিলো অপেক্ষা  করলই না। সেদিন খুব অপরাধী মনে হলো নিজেকে।বারংবার নিজেকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম "আমি এতো অলস কেনো?  তুই তো জানিস আমি একটু স্বাভাবতই অলস।  অলস জেনেও সেদিন তুই  আমায়  সময় দিলি না। সে জন্য অবশ্য তোর উপর খুব রাগ হয়েছিলো। এখন যে নেই তা নয়। হয়তো সে কারনেই ভুলে গিয়েছি তোকে এবং এখনও আছি। 

এক সাথে সম্পূর্ণ পাড়া ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা।  পাড়ার এমন কোন ফল ছিলো না যে আমরা চুরি করিনি।এর জন্য কত সালিশ ই না বসেছিলো। সব সময় দোষটা তুই নিজের কাঁধেই নিয়েছিস।  তুই একটু বেশী রগচটা ছিলি কেও কিছু বললেই রেগে যেতি আচ্ছা এখনো কি সেখানে রাগ দেখাস। এখন অবশ্য রাগটা কমে যাওয়ার কথা তোর। সেখানের মানুষ কি আর তোর এমন রগচটা স্বভাবকে তোয়াক্কা করবে। কীরে  আগের মত  তোর প্রিয় গানটা গলা ছেড়ে গাওয়া হয়?   হয় না হয়তো! 

ও তোকে তো বলাই হয়নি তোর একটি ইচ্ছা ছিলো না? ভাবছিস কি ইচ্ছে।  আরেহ!  ঐ যে ঐ ইচ্ছেটা  যে খুব ভালো একটি মেয়ে আমার জীবন সঙ্গী হোক।  হ্যাঁ রে পেয়েছি খুব ভালো একটি মেয়ে পেয়েছি।  এইইইই হাসবি না কিন্তু?  আমি মানছি আমি মদন ছিলাম কিন্তু এখন আর নেই। খুব বেশী আধুনিক না হলেও চলার মত হয়েছি।  তুই এক সময় আমার সব সৎ সাহসের মাধ্যম ছিলি।  আমি মানছি তোর অভয়ে ই চলাফেরা করতাম কিন্তু বিশ্বাস কর একটা জীবন সঙ্গী পেয়েছি যে ঠিক তোর মতই ভালোবাসে।  কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কি জানিস তাকে হয়তো পাবো না।আমার তো এখনো চাকরি' ই  হয়নি পাবো কি করে বল। কোন পিতা কি তার মেয়েকে কোন বেকার ছেলের হাতে তুলে দিবে বল। তাই তো হণ্যে হয়ে পড়েছি  নিজেকে যোগ্য প্রামাণের জন্য একটি চাকরির খোঁজে।  তবে মেয়েটা না খুব ভালো রে । এমন মেয়ে  ভাগ্যবান মানুষের কপালেই জুটে।  ঠিক তোর মতো।  

ওহ ভালো কথা জীবনসঙ্গীর  কথা বলতেই মনে পড়ে গেলো।  আচ্ছা তোর কি মনে পরে তানিয়ার কথা? তুই বড় বেইমান রে তাকেও ভুলে গেলি তোর সাথে নিতে। কত ভালই না বাসতো মেয়েটি তোকে। তুইও ভালোবাসতি এটা মিথ্যা নয়। ভালো না বাসলে কি  আর কেও রাত জেগে জেগে প্রিয় মানুষের কথা ভাবে।  ভালো না বাসলে কি আর ছোটখাটো ঝগড়ায় সারা রাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।   অল্প দিনের প্রেম তোদের তারপর বিয়ে ঠিক হয়ে যায় ।  কত স্বপ্ন দেখেছিলো মেয়েটা তোর বউ হবে কিন্তু সে সময় টুকু ও দিলি না তুই। কি এমন অভিমান ছিলো তোর যা আমি জানি না?

বিশ্বাস কর তোর ক্ষতবিক্ষত দেহটা দেখে আমার থেকেও বেশী ভেঙ্গে পড়েছিলো মেয়েটা।   চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছিলো সে।  তার কান্না যেনো এখনো কানে ভাসে।  ঐ ছোট ছোট চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটা এখনো যেনো চোখে ভাসে আমার।  বিয়ের আগেই স্বামীর এমন দেহ কোন মেয়েই দেখতে চায় বল। 

কি নির্মম বল পৃথিবীটা। ট্রাকে চাপা খাওয়ার  দুদিন পর ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে ফিরে আসলি বাড়িতে।  কি দুর্গন্ধই না  ছিলো তোর শরীরে। মিনিটেই বাতাসকে বিষাক্ত হয়েগিয়েছিলো।  জানিস তোর দেহটা রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছিলো কেও যায়নি  তোর কাছে। সেদিন শুয়েছিলি তুই।  এত মানুষ তোর আশেপাশে থাকতো সর্বদা।  কত মানুষকেই না চালিয়েছিলি নিজ অর্থে। কিন্তু সেদিন কেও আসেনি একাকী পড়েছিলো তোর নিথর দেহ।শুধু আমি ,  তানিয়া  আর তোর মা ছিলো তোর কাছে। হাড়গুলো  এত গুড়ো হয়েছিলো যে কেনটা হাত আর কোনটা পা তা চিহ্নিত করাই ছিলো সবথেকে কঠিন কাজ। একমাত্র তোর মুখটাই ছোঁয়ার মতো ছিলো বলতে পারিস। যা দেখে তুই তোকে শনাক্ত করতে পেরেছি।  

আমার  মনে আছে তুই একদিন বলেছিলি যে তোকে আমি কোনদিন  কাঁধে নিতে পারবো না।  তুই ঠিক ই বলেছিলি।  সেদিন তোর কথার মর্ম বুঝেছিলাম।যখন তোকে শেষ বারের মত কাঁধে নিয়েছিলাম  গোরস্থানে নেওয়ার জন্য খুব কষ্ট হয়েছে আমার।  মনে হচ্ছিলো কেও আমার কাঁধে সম্পূর্ণ পৃথিবীটা তুলে দিয়েছে। আমি নুয়ে পড়ছিলাম। মনে হচ্ছিলো এ পথ বুঝি ফুরাবার নয়। এতটাই  কষ্ট হচ্ছিলো যে চোখের পানি গুলো টলমল টলমল করছিলো। খরা চোখে বৃষ্টি এলো বলে। 

জানিস আজও তোর কথা মনে পরতো না।  আমার বান্ধবী আছে একজন তার জীবনসঙ্গীর নামে তোর নামে।  হাঠাৎ তার মুখে এই নাম শুনে ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।  তাই তোকে আজ মনে করা।  আবার হয়তো ভুলে যাবো বছর ছয়েক এর জন্য। 

আজ রাখি রে। আজ আর লেখতে পারছিনা। আঙ্গুল গুলো আবার কাঁপা শুরু করেছে। আর কিছু লেখার শক্তি ফুরিয়ে গেছে। যদি সৃষ্টির প্রভু সহায় হয় তাহলে তোর ভাবিকে নিয়ে চিঠি লেখবো। সেদিন হয়তো বেশি লেখার শক্তি পাবো কারন ঐ যে বলেছিলাম সে ঠিক তোর মতোই সাহস যোগাতে পারে। তাই তখন ভেঙ্গে পরার ভয় নেই। সে পর্যন্ত এই চিঠি টা যত্নে রাখিস।


ইতি
পত্রের ভাষায় বুঝে নিস।



কালো গোলাপ
মোঃ নুরুজ্জামান 

আমি কথা রেখেছি সুরঞ্জনা
আমি কথা রেখেছি। 
এই দেখ তোমার জন্য বেগুনী রঙ্গের শাড়ি আর  চুড়ি  এনেছি।

বছর দুয়েক আগে এই শাড়ি আর চুড়ি গুলো দিতে পারিনি শুধু  অযোগ্য ছিলাম বলে। 
এই দেখ আজ ঠিক কিনে এনেছি।
 
আমি কথা রেখেছি সুরঞ্জনা
আমি কথা রেখেছি। 

দ্বিতীয় বার মা হবার পর খুব অভিমান নিয়ে আমার কাছে সময় চেয়েছিলে। 
 
 আজ আমি ঘন্টার পর ঘন্টা তোমার পাশে দাড়িয়ে থাকি সুরঞ্জনা। শুধু তুমি নিশ্চুপ। 


তোমার মনে আছে বঙ্কিম সমগ্র এনে দেওয়ায়  আমার পছন্দের সবগুলো পিঠে বানিয়েছিলে। 
সেই বঙ্কিমেও আজ ধূলো জমেছে। 

আমি কথা রেখেছি সুরঞ্জনা
আমি কথা রেখেছি। 

 সমুদ্র পাড়ে একটি পূর্ণিমারাত  চোখে চোখ রেখে  কাটানোর কথা ছিলো।  
  কত পূর্ণিমারাত আসলে গেলো শুধু আমাদের  জোৎস্না দেখা হলোনা। 

পছন্দের কালো গোলাপে তোমার বারান্দা সাজিয়ে দিবো বলেছিলাম।  এমন ভাবে তোমার কবরে সাজাবো ভাবিনি।  তবুও আমি কথা রেখেছি। শুধু তুমিই কথা রাখনি।

আমি কথা রেখেছি সুরঞ্জনা
আমি কথা রেখেছি। 


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট