প্রিয় কবি নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী চেতনা , দেশ মায়ের প্রতি প্রবল টান , শৃঙ্খলা মুক্তি করবার উন্মাদনা তৎকালীন অনেক কবির মধ্যে রহস্যজনক ভাবে অনুপস্থিত । এ বিষয়ে আমরা অবগত আছি ।তবে , পাঠ্য বইয়ের বাইরে আমাদের বিচরন আশঙ্কাজনক ভাবে কম । তাই নজরুল ইসলামের ব্যক্তি জীবনের নানা অধ্যায় অজানা রয়ে গেছে । কবি জীবনে নারী প্রেম ! প্রেমিক নজরুলের প্রেম গভীরতা সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছুই জানি না । নজরুলের জীবনে মূলত তিনজন নারী প্রেয়সী রুপে ধরা দিয়েছিলেন । কবি পত্নী আশালতা (প্রমীলা কাজী )দেবী , বেগম ফজিলতুন্নেসা জোহা (একতরফা প্রেম , কবি তাঁর হৃদয়ের প্রেম অর্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন । কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা কবির প্রেমের চিঠিগুলো বাংলাসাহিত্যের জীবন্ত সম্পদ ) , অন্যজন কবির প্রথম প্রেম নার্গিস । নার্গিসের প্রতি কবির প্রেম ছিল অকৃত্তিম , অপার্থিব যেন । দুটো হৃদয় কাছাকাছি এসেছে , আবার বিচ্ছেদও ঘটেছে । তবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উভয়ের মাঝে জীবন্ত ছিল একবুকভরা ভালোবাসা । যা পাঠককেও ব্যাকুল করে তোলে।
প্রেমিক নজরুলের হৃদয়ের পরিণয় প্রথম সম্পূর্ন হয়েছিল সৈয়াদা খাতুনের অন্তরাত্মার সঙ্গে । নজরুল তাঁর নামকরণ করেন কবি হাফিজের প্রিয় ফুল নার্গিস নামে । নার্গিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ , প্রেম , বিচ্ছেদ নজরুলের জীবনকে করে তুলেছিল নাটকীয় । আঘাত চিরন্তন ক্ষতে পরিনত হয়েছিল । নার্গিসের সঙ্গে কবির প্রণয়ের লিংক ম্যান হিসাবে দেখা যায় আলি আকবর খানকে । সম্পর্কে তিনি নার্গিসের মামা । আলি আকবর খান (১৮৯৫ -১৯৭৭)অল্প বিস্তর লেখালিখি করতেন । নিজের পুস্তক নিজেই ফেরি করতেন । কবির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় কলকাতা ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে । নজরুল আলি আকবরের হাস্যকর কবিতা দেখে লিচুচোর নামক কবিতাটি লিখে দেন । নজরুলের প্রতিভা দেখে চমৎকৃত হয়ে কবিকে নিজ আবাসে আসবার আমন্ত্রন জানান । ভবঘুরে নজরুল কাউকে কিছু না জানিয়ে ২২ চৈএ ১৩২৭ বঙ্গাব্দে (১৯২১ সালের মার্চ মাসে )আলি আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লার উদ্দ্যেশে কলকাতা ত্যাগ করেন । যাবার পূর্বে নিরুদ্দেশ যাত্রা নামক কবিতাখানি রচনা করেন ।
কুমিল্লার দৌলতপুর নিজ বাস ভবনে পৌঁছাতে গভীর রাত হওয়ার আশঙ্কায় আলি আকবর খান কান্দিরপাড়ে বাল্যবন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে ওঠেন কবিসহ। বীরেন্দ্রর মা বিরজা সুন্দরী দেবীকে কবি মা বলে ডাকতে শুরু করেন । ১৩২৯ সালের পৌষ , প্রথম বর্ষ , একাদশ সংখ্যায় ' অলকা ' পত্রিকায় নজরুল ' হারা ছেলের চিঠি ' নামে একটা গল্প লেখেন । ' মা ' সম্বোধন দিয়ে শুরু হয় গল্পের গতিপথ । এই মা , নিঃসন্দেহে বিরজা সুন্দরী দেবী । যায়হোক , খান বাড়িতে নজরুলের আগমন উপলক্ষে বেশ বড়সড় আনন্দউৎসবের আয়োজন করা হয় ।দেওয়া হয় সংবর্ধনা । বাংলা ১৩২৭ সালের ২৩ শে চৈএ থেকে ১৩২৮ সালের ৪ আষাঢ় পর্যন্ত আলি আকবর সাহেবের দৌলতপুর খান বাড়িতে অবস্থান করেন কবি । এই সময়কালের মধ্যে তরুন নজরুল সৈয়দা খাতুনের প্রতি আকৃষ্ট হন ।সৈয়দার মা আসমাতুন্নেসা , পিতা মুন্সী আব্দুল খালেক । যিনি অল্পবয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন । কবি তাঁর বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে দৌলতপুর থেকে লিখেছিলেন - ' এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি , যা কোন নারীর কাছে কখনই হয় নি ' ।নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের প্রথম সাক্ষাৎ সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে আলি আকবর খান লিখেছেন , ' ১৩২৮ এর ২২ শে বৈশাখ আমার আমার বড় ভাই নেজবত আলী খানের একমাত্র সন্তান আম্বিয়ার বিয়ে হয়েছিল আমাদের ভাগ্নে আব্দুল জব্বারের সঙ্গে । সেই বিবাহ অনুস্ঠানেই আমাদের ভাগ্নি সৈয়দাও এসেছিল । নজরুল প্রথম দর্শনেই ওকে ভালোবেসে ফেলে , সৈয়দাও । ঐ বিয়ে অনুস্ঠানে সৈয়দা গান গেয়েছিলেন । ' নার্গিস তাঁকে বরণ করেছিলেন আরাধ্য পুরুষ হিসাবে । সঁপে দিয়েছিলেন হৃদঅঞ্জলি । কবিও প্রবল অনুরক্ত ছিলেন গ্রাম্য বালিকা নার্গিসের প্রতি । অন্তত কবির লেখনীতে বার বার ধরা দিয়েছে তাঁর প্রেমকথন । ছায়ানট , পূবের হাওয়া , চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় নার্গিস কেন্দ্রিক । ছায়ানট কাব্যের ৫০টি কবিতার মধ্যে , অবেলায়, হার মানা হার , অনাদৃতা , হারামনি , মানসবধূ , বিদায় বেলা , পাপড়ি খেলা , বিধূর পথিক নয়টি কবিতায় নার্গিসের প্রতি প্রেম অর্ঘ্য নিবেদন করেন কবি । ' দোলন চাঁপা ' কাব্যের ' সমর্পন ' কবিতায় কবি প্রিয়তমার নিকট নিজেকে সমর্পন করেছেন এই ভাষ্যে - ' প্রিয় ! এবার আমায় সঁপে দিলাম তোমার চরণ-তলে । তুমি শুধু মুখ তুলে চাও , বলুক যে যা বলে । ' কবির প্রেম যে একেবারেই অকৃত্তিম , তা নার্গিসের একটা সাক্ষাৎকার থেকে উপলদ্ধ হয় । কবির মৃত্যুর পর দৈনিক সংগ্রামকে নার্গিস জানান ' , প্রথম দেখার পর থেকে কখন যে কিভাবে দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম । নজরুল তো আমাকে নিয়ে দৌলতপুরেই অনেকগুলো গান ও কবিতা লিখেছিল । আমাকে এক নজর না দেখলেও মনমরা হয়ে যেত ' (দৈনিক সংগ্রাম , ৩০ মে , ১৯৮২)।
নজরুল - নার্গিসের এই প্রেম আখ্যান গভীর থেকে গভীরতর হয় অল্প সময়ের মধ্যেই । বিষয়টা নজর এড়ায়নি নার্গিসের আত্মীয় স্বজনের । ভবঘুরে বাউন্ডুলে নজরুলকে জামাই হিসাবে পছন্দ ছিল না নার্গিসের মা সহ অনেকের । আলী আকবর খানের মধ্যস্থতা এবং নার্গিসের প্রতি নজরুলের প্রেমের আবেশ সকলকে বিষয়টা মেনে নিতে বাধ্য করে । বিয়ের দিন ঠিক হয় ১৩২৮ সালের ৩ আষাঢ় শুক্রবার , ইংরেজি ১৭ জুন ১৯২১ ।বিয়ের আয়োজন করা হয় খুবই ধুমধাম করে । খান পরিবার যথেষ্ট বিত্তশালী । দেনমোহর ধার্য হয় ২৫ হাজার টাকা । বিয়ে পড়ান নার্গিসের বড়ভাই মুন্সী আব্দুল জব্বার । বিয়ের উকিল হয়েছিলেন নার্গিসের বড় মামা আলতাফ আলী খান । কবির পক্ষে সাক্ষী ছিলেন সাদত আলী মাস্টার , নার্গিসের পক্ষে সৈয়দ আলী মাস্টার । নজরুলের অনুরোধে আকবর আলী খান সেন পরিবারকে আমন্ত্রন জানান । কমরেড মুজাফফর আহমেদ লিখেছেন , সেন পরিবারের দশজন কবির বিবাহ উপলক্ষে দৌলতপুরে আসেন । ১ । ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ২ ।বিরজা সুন্দরী দেবী ৩ ।গিরিবালা দেবী ৪ । বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত ৫ । কুমারী আশালতা সেনগুপ্তা (প্রমীলা , পরবর্তীতে কবিপত্নী ) ৬ । কুমারী অঞ্জলি সেনগুপ্তা ৭ ।কুমারী কমলা সেনগুপ্তা ৮ ।কমলিনী সেনগুপ্তা ৯ । প্রবীর কুমার সেনগুপ্ত ১০ । সন্তোষ কুমার সেন । বিবাহ চলাকালিন মনক্ষুন্ন হন কবি । নার্গিসের মামা আলী আকবর খান জোর পূর্বক কাবিল নামায় লিখিয়ে নেন নজরুল নার্গিসকে নিয়ে কুমিল্লার বাইরে যেতে পারবেন না । অর্থাৎ তাঁকে ঘরজামাই হয়ে থাকতে হবে । ' দেখবো এবার জগৎটাকে ' যাঁর মানসপটে চিরন্তনভাবে উচ্চারিত হয় এ বানী ' , যিনি স্বেচ্ছায় হন পথিক । তিনি কি পারেন এ বন্ধন মেনে নিতে ! অভিমানী নজরুল সে রাতেই দশ এগারো মাইল হেঁটে কুমিল্লায় বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের বাড়িতে এসে ওঠেন ।
কবি সে রাতেই বিয়ে বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন কিনা ! নার্গিসের সঙ্গে তাঁর বাসর হয়েছিল কিনা এ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে । বাংলাপিডিয়া সহ , একাধিক নজরুল জীবনী গ্রন্থে উল্লেখ আছে , স্বপ্নভঙ্গ নজরুল সে রাতেই বেরিয়ে পড়েছিলেন নার্গিসকে ফেলে । তবে , এ বিষয়ে কবির প্রণয়িনী নার্গিসের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য - ' গিরিবালা দেবী ও বিরজাসুন্দরী দেবী ওকে (নজরুলকে )বোঝাতে লাগলো যে মামার উদ্দেশ্য খারাপ । বিয়ে করলেই আটকে পড়বে । বিয়ে হলো । বাসর হলো । ও আমাকে বাসররাতে তার সঙ্গী হয়ে দৌলতপুর ত্যাগ করতে বললো । কত মিনতি করলাম । তবু ভুল বুঝলো । ছুটে গেল বিরজা সুন্দরী দেবীদের পরামর্শের জন্য । অনেকটা স্বাভাবিক হয়েই সকালে নাস্তা - টাস্টা করে বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে কুমিল্লা রওনা হলো । বললো দেশের বাড়িতে যাবো , আত্মীয় - স্বজন এসে আমাকে শ্রাবন মাসে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাবে । (বুলবুল ইসলাম , অন্তরঙ্গ আলোকে কবি প্রিয় , সংগ্রাম ৩০ শে মে , ১৯৮৮ ) আর ফেরেননি কবি তাঁর প্রিয়ার কাছে । দীর্ঘ ১৭ বছর নার্গিস থাকলেন স্বামীর আগমনের পথ চেয়ে ।হয়তো একদিন তিনি ফিরবেন এই আশায় । আলী আকবর খানের দুরভিসন্ধি ছিল , চিরদিনের জন্য নজরুলকে কাগজি বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিলেন । যা কবিকে ব্যথিত করে তুলেছিল । ১৯২১ সালের জুলাই মাসে কবি আলী আকবর খানকে একটি চিঠিতে লেখেন ' বাবা শশুর (বানান অপরিবর্তিত ) ,আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মত ব্যবহার করে এসে যা কিছু কসুর করেছে , তা ক্ষমা করো সকলে , অবশ্য যদি ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে । ....আমি সাধ করে পথের ভিখারী সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মত ' ক্ষুদ্র আত্মা ' অমানুষ হয়ে যায়নি । আপনজনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এই হীন ঘৃণা , অবহেলা আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছে বাবা । আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি । দোয়া করবেন এ ভুল যেন দুদিনেই ভেঙে যায় , এ অভিমান যেন চোখের জলে ভেসে যায় ।
আরজ - ইতি
চির সত্য স্নেহ সিক্ত
নূরু ' । কবির হৃদয়ের ক্ষত এ থেকেই প্রতিভাত হয় । স্বামী ও মামাদের সঙ্গে মতান্তরের সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল পিতৃহারা নার্গিসকে । তিনি চিরতরে হারিয়ে ফেলেন স্বামীর অপত্য প্রেম । নার্গিসের কথা থেকেই জানা যায় কবি বাসর রাতেই তাঁর সঙ্গী হয়ে দৌলতপুর ত্যাগ করতে বলেছিলেন । মামার বাড়ি মানুষ নার্গিস তা পারেননি । তাঁর উপর মামাদের প্রভাব অনেক বেশি । কবি হয়তো সেকারনে মানসলোকের ধ্রুবতারা প্রিয়মানুষটির প্রতি অভিমান করতে পারেন । তবে এ সম্পর্কছেদের জন্য তিনি কখনই নার্গিসকে দায়ী করেননি । ১৯৩৭ সালের ১ লা জুলাই কলকাতার চিৎপুর থেকে লেখা কবির এ চিঠিখানি তার প্রমান ' তোমার উপর আমি কোন জিঘাংসা পোষন করিনা এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি । তোমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত , কি অসীম বেদনা ! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি - তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি । তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না । আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না । ....যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালোবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম , সে রুপ আজও স্বর্গের পারিজাত মন্দিরের মত চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে । ' মাত্র দুইমাসের প্রেম ও একদিনের পরিণয় স্মৃতি কবির জীবনে কি পরিমান প্রভাব বিস্তার করেছিল তা এ থেকে পরিস্কার হয় ।
এ প্রেমের স্মৃতি নিয়েই নার্গিস কাটিয়েছিলেন ১৭ বছরের দুঃসহ অপেক্ষার রাত । ভাবতেই অবাক লাগে । সময়টা তো কম নয় ! ১৯২৪ সালের ২৫ শে এপ্রিল হুগলির মিসেস এম রহমানের উদ্দ্যোগে কলকাতার ৬ নং হাজী লেনে নজরুল ও আশালতার বিবাহ সম্পূর্ন হয় এবং নজরুল হুগলিতে সংসার পাতেন । এ খবর নার্গিসের কাছে পৌঁছালে প্রথম তিনি বিশ্বাসই করেননি । সত্যতা জানার পর নজরুলকে তিনি লেখেন ' তুমি তো বলেছিলে চিরদিন সাথী হয়ে থাকবে /কুড়িয়ে পাওয়া এই বণফুল মালা করে রাখবে / হে পথিক তুমি ভালোবেসে /এই তো সেদিন জড়ালে এসে / আজ তুমি হায় ছিঁড়িলে বাঁধন/ আর কি কাছে এসে নাম ধরে ডাকবে । ' নার্গিসের এ প্রেম ব্যাকুলতা পাঠকেও দুঃখী করে তোলে । নজরুলের বিয়ের তের বছর পর ১৯৩৭ সালে নার্গিস কবিকে একটা চিঠি লেখেন । চিঠি প্রাপ্তির সময় কবিবন্ধু প্রখ্যাত লেখক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন । চিঠিতে কি লেখা ছিল জানা যায় না । শৈলজানন্দ উত্তর লিখতে বললে নজরুল একটা গান লিখে দেন ' যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই / কেন মনে রাখ তারে / ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে ' ' । কবির দেওয়া উত্তর থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না , তখনও নার্গিস কবির পথ চেয়ে বসে আছেন । হয়তো শেষবারের মত চেস্টা করেছিলেন । দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কবির সঙ্গে নার্গিসের একবার দেখা হয়েছিল । বিবাহ বিচ্ছেদের দিন । ১৯৩৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে শিয়ালদহে কমরেড মুজাফফর আহমেদের বাসভবনে সরকারি ভাবে নজরুল নার্গিসের বিচ্ছেদ সম্পূর্ন হয় । দুটি হৃদয়ের অপ্রাপ্তির ট্রাজিক পরিসমাপ্তি ।
দান্তের জীবনে জীবনে যেমন বিয়াত্রিচ , শেলীর জীবনে এমিলিয়া , হিটলারের জীবনে ইভা ব্রাউন , তেমনি নজরুলের জীবনে ছিলেন নার্গিস । সামান্য কিছু মতান্তরের জন্য সম্ভব হয়নি দুটি হৃদয়ের মিলন । এই সম্পর্কছেদের জন্য নার্গিসের পরিবার বরাবর গিরিবালা দেবীদের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন । অনেকে আবার কমরেড মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে নার্গিসের মামা আকবর আলী খানের আদর্শগত মতদ্বৈততাকে কারন হিসাবে উল্লেখ করেছেন । কবিকে তিনি ভুল বুঝিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন নার্গিসের জীবন থেকে , এরুপ অভিযোগ রয়েছে । তবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উভয়ের সম্পর্কের গ্রাফ ঘৃণার পর্যায়ে পৌঁছায় নি । দীর্ঘ ১৭ বছর পর ১৯৩৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহ সম্পূর্ন হয় নার্গিসের । বিয়ের সংবাদ শুনে প্রেমিক কবি তাঁর বিখ্যাত গান ' পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরানপ্রিয় ' গানটি লিখে পাঠান হারানো প্রেমিকাকে ।
' ' পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয়, পরাণ-প্রিয়।
চাহিতে যেমন আগের দিনে তেমনি মদির চোখে চাহিও।।
যদি গো সেদিন চোখে আসে জল,
লুকাতে সে জল করিও না ছল,
যে-প্রিয় নামে ডাকিতে মোরে
সে-নাম ধরে বারেক ডাকিও।।
তোমার বঁধু পাশে (হায়) যদি রয়,
মোরও প্রিয় সে, করিও না ভয়,
কহিব তা’রে, ‘আমার প্রিয়ারে
আমারো অধিক ভালোবাসিও......' '
সঙ্গে একটি চিরকুট , তাতে লেখা ছিল ' জীবনে তোমাকে পেয়ে হারালাম , তাই মরণে পাব এই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বাঁচবো । এ প্রেম যেন অপার্থিব । গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে । নজরুলের জীবনের এ অধ্যায় নিয়ে তাই বার বার আলোচনা হয়েছে । যা এখনও চলছে নিরন্তর গতিতে ।
সূত্র : প্রমীলা নজরুল, মুহাম্মাদ আসাদ, বইমেলা, ২০১০, নজরুল প্রমীলা পরিষদ মানিকগঞ্জে নজরুল, মুহাম্মাদ আসাদ ফেব্রুয়ারি ২০১১ নজরুল প্রমীলা পরিষদ নজরুল ট্রাজিডি, ড. মু. কামাল উদ্দিন, ২০০৭, প্রত্যয় প্রকাশ, চট্টগাম নজরুল জীবনে কুমিল্লা অধ্যায়, তিতাশ চৌধুরী, ভারত বিচিত্রা, মে ২০১০ নজরুল জন্মশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ, নজরুল ইনস্টিটিউট, ২৫মে, ২০০০।
লেখক পরিচিতি
এম .এ( বাংলা )প্রথম শ্রেনী , বি .এড
রায়পুর , চাকলা , দেগঙ্গা , উত্তর ২৪ পরগনা
আলাপন : ৯৭৩৪৩১৮৯৬৪