কাশেম সাহেব বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন। চীনের উহানে করোনা ভাইরাসের জন্ম হলেও সেটা ইতিমধ্যে চীন থেকে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের দায়িত্বহীন ভূমিকার কারণে ইতালির কয়েকটি শহরে মাত্রাতিরিক্ত হারে সংক্রমিত হয়ে গেছে করোনা ভাইরাস। প্রতিদিন ইতালিতে হাজারে হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। এদিকে এসব সংবাদ শুনে বাসায় ঘ্যানর ঘ্যানর কান্না জুড়ে দিয়েছেন কাশেম সাহেবের স্ত্রী রোকেয়া বেগম। তাদের ছোট ছেলে জুয়েল, সে প্রায় পাঁচ বছর যাবত ইতালির মিলানে আছে। সেখানে যাওয়ার পর আর দেশে ফেরেনি। তবে এবার সে দেশে ফিরে আসতে চাইছে। ইতালির আকাশে-বাতাসে যেন মৃত্যুর যমদূত ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘরে বসে প্রতিদিন টিভির পর্দায় দেখতে পাচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। সে আতঙ্কিত হয়ে গেছে, কখন যে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যায়। এই দুশ্চিন্তার কারণে রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারছে না। এক রাতে জুয়েল দুঃস্বপ্নে দেখে, সে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেছে। শরীরে প্রচন্ড রকম জ্বর, হাঁচি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যেন মারা যাবে। এমন একটা দুঃস্বপ্ন দেখার পর আর এক মূহুর্তের জন্যেও ইতালির মাটিতে থাকতে চাইছে না। যদি মরতেই হয়, তবে নিজের দেশের মাটিতেই মরবে। তাই পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জুয়েল তার বাবার কাছে ফোন করে।
- হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম আব্বা।
- ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছিস বাপ?
- আছি মোটামুটি। আপনারা সবাই কেমন আছেন?
- আলহামদুলিল্লাহ্, আমরা ভালোই আছি। তবে তোর জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। তোর আম্মা তো শুধু কান্নাকাটি করে।
- আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি সুস্থ আছি। কোন অসুবিধা নাই।
- সাবধানে থাকিস। খুব জরুরি দরকার ছাড়া ভুলেও ঘর থেকে বের হবি না বললাম।
- না আব্বা, সারাদিন রুমের মধ্যেই আছি। আমাদের এখানে 'লকডাউন' দিয়ে দিসে। অন্যান্য জায়গায় কারফিজ চলতেছে।
এমন সময় রোকেয়া বেগম পাশের রুম থেকে দৌড়ে এসে ছেলের সাথে কথা বলতে অস্থির হয়ে উঠেন। তখন কাশেম সাহেব মোবাইল ফোন রোকেয়া বেগমের হাতে ধরিয়ে দেন। তিনি ফোন হাতে নিয়ে ছেলের কন্ঠস্বর শুনেই জোরে জোরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। মিনিট খানেক কোন কথাই বলতে পারছিলেন না। মায়ের কান্না শুনে জুয়েল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। সে নিজেও মায়ের সাথে কান্না জুড়ে দেয়। কান্নাকাটির এক পর্যায়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে রোকেয়া বেগম ছেলেকে দেশে আসতে বলেন। তখন জুয়েল জানায়, সে নিজেও দেশে আসতে চাইছে কিন্তু এই অবস্থায় দেশে ফিরে আসা ঠিক হবে কিনা সেটাই ভাবছে। তখন রোকেয়া বেগম জোর গলায় বলে উঠে, যা হবার হবে, তবুও যেন দেশে ফিরে আসে। কাজকর্ম নেই, ঘরে বেকার বন্দি হয়ে বসে আছে। এভাবে অহেতুক কেন মরার দেশে থাকবে? এরচেয়ে ভালো এই মূহুর্তেই দেশে ফিরে আসা। মায়ের কথা শুনে জুয়েল দেশে ফিরে আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। তারপর বাসা থেকে বের হয়ে বিমানের টিকিট কাটে। কোন রকমে লাগেজ গুছিয়ে দুদিন পর জুয়েল ফিরে আসে তার জন্মভূমি বাংলাদেশে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় একটু ঝামেলায় পড়তে হয়। তবে নিরাপত্তা কর্মীদের সামান্য কিছু টাকা দিয়ে সেই ঝামেলা মিটিয়ে জুয়েল গাড়ি করে সোজা চলে যায় তার বাসায়।
জুয়েলের ফিরে আসায় রোকেয়া বেগম খুশিতে আত্মহারা। পাঁচ বছর পর ছেলেকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে থাকেন। জুয়েলও মায়ের বুকে মাথা রেখে পরম শান্তি অনুভব করছে। তবে মন থেকে খুশি হতে পারেননি কাশেম সাহেব। তিনি আসলে চাননি, জুয়েল এই সময়ে দেশে ফিরে আসুক। কিন্তু স্ত্রী রোকেয়া বেগমের অবস্থা দেখে তিনি আর নিষেধ করতেও পারেননি। যেহেতু দেশে এসেই গেছে, তাই এখন এসব নিয়ে চিন্তা করে কোন লাভ নেই। তিনি স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে বলে দিয়েছেন, জুয়েলের ফিরে আসার খবর এখন যেন কাউকে না বলেন। যদিও রোকেয়া বেগম ইতিমধ্যে তার তিন মেয়ের কাছে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন। জুয়েলের বড় ভাই বিয়ের বছরখানেক পর বউ নিয়ে আলাদা থাকেন। আর তার তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা আছে তাদের স্বামীর সংসারে। বাসায় তার বাবা-মা ও একজন গৃহপরিচালিকা ছাড়া আর কেউ থাকে না। তবুও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছেন না কাশেম সাহেব। বেশ টেনশনে আছেন কিন্তু মুখ খুলে কিছু বলতেও পারছেন না। পরদিন সকালে তিনি জুয়েলকে আলাদা ভাবে ডেকে পরামর্শ দিলেন, সে যেন আগামী চোদ্দটা দিন বাসার মধ্যে 'হোম কোয়ারেন্টাইন' অবস্থায় থাকে। তখন জুয়েল জানায়, সে তাই করবে বলে মনস্থির করে রেখেছে।
ছেলেকে ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে বলার কারণে রোকেয়া বেগম অভিমান করে কাশেম সাহেবের সাথে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে রেখেছেন কিছু দিন যাবত। জুয়েলের জন্য কি কি রান্না করে খাওয়াবেন এসব নিয়ে তিনি ব্যস্ত আছেন। নিজেই বাজারে চলে যাচ্ছেন। জুয়েলের পছন্দমত খাবার কিনে নিয়ে আসেন। নিষেধ করা সত্ত্বেও বারবার জুয়েলের রুমে আসা যাওয়া করছেন। এমনকি স্বামীর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জুয়েলের ভাইবোনদের বাসায় এসে জুয়েলকে দেখে যেতে বলছেন। তারাও অনেকটাই নিরুপায় হয়ে একদিন সবাই মিলে বাসায় এসে জুয়েলকে দেখে যায়। তবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই তারা দেখা করে চলে যায়। এতে মানসিক ভাবে খুব কষ্ট পান রোকেয়া বেগম। তিনি নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছেন, সামান্য একটু সর্দি-কাশি ছাড়া জুয়েল সুস্থ শরীরে বেশ ভালো আছে। তবুও আপন ভাইবোন হয়েও কেউ জুয়েলের কাছে গেল না। দূর থেকেই দেখা করে চলে গেল। এটা তিনি মন থেকে আশা করেননি। তবে সবাই এমনটা করলেও তিনি সেটা করতে পারবেন না। যদিও জুয়েল কাছে আসতে নিষেধ করে কিন্তু কে শোনে কার কথা। এদিকে বিধি-নিষেধ অমান্য করে স্ত্রীর চলাফেরা দেখে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন কাশেম সাহেব। তিনি নিজেই যেখানে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না, সেখানে তার স্ত্রী ইচ্ছে মতো এখানে ওখানে যাচ্ছেন। এটা নিয়ে সেদিন দুজনের মধ্যে এক দফা ঝগড়া পর্যন্ত হয়ে গেল।
কদিন পর কাশেম সাহেব ও রোকেয়া বেগমের শরীরে জ্বর আসে। সেই সাথে গলা চুলকানি ও খুশখুশে কাশি। তখন সত্যি সত্যিই রোকেয়া বেগম বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তবে ততোটা চিন্তিত নন কাশেম সাহেব। তাই দেখে রোকেয়া বেগম বেশ আশ্চর্য হয়ে কাশেম সাহেবকে প্রশ্ন করেন,
- আপনি তো ভীতুর ডিম। কিন্তু এখন চুপচাপ বসে আছেন কিভাবে?
- যা হওয়ার কথা ছিল, তাই হল। এখন আর চিন্তা করে কী লাভ? আগেই চিন্তা ভাবনা করা উচিত ছিল।
- মানে কি? আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?
- এখন আর এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তুমি আল্লাহ্.. আল্লাহ্.. করতে থাকো।
- আমার তো সাংঘাতিক রকম টেনশন হইতেছে। আমাদের দুজনের এই মূহুর্তে ডাক্তারের কাছে যাওয়া ভীষণ দরকার।
- বুঝতে পারছি না এই অবস্থায় ডাক্তারের কাছে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। আরো কটা দিন অপেক্ষা করে দেখি।
- আপনি যা ভালো মনে করেন। তবে আমার মোটেও ভালো ঠেকছে না।
- আল্লাহ্ ভরসা। এতো টেনশন করো না। দুই একদিনের মধ্যে শরীরের অবস্থার উন্নতি না হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে।
দুইদিন পার হয়ে গেল। কাশেম সাহেব ও রোকেয়া বেগম বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দুজনের বেশ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। জুয়েল তার বাবা-মায়ের অবস্থা দেখে নিজের রুমে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মনে মনে ভীষণ অনুশোচনায় ভুগছে। সে বুঝতে পারছে, ইতালি থেকে ফিরে আসা একদম ঠিক হয়নি। যদিও জুয়েল বর্তমানে পুরোপুরি ভাবে সুস্থ কিন্তু তার অসুস্থতার কারণ সে নিজেই। তার শরীরে করোনা ভাইরাস লড়াই করে পেরে উঠতে না পারলেও তার বাবা-মায়ের শরীরে প্রবেশ করে ঠিকই পেরে উঠেছে। এখন সে কী করবে, সেটাই বুঝতে পারছে না।
চোখের সামনে বাবা-মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে জুয়েল তার ভাইবোনদের ফোন করে সবকিছু জানায়। তখন তারা ইচ্ছে মতো জুয়েলকে দোষারোপ করতে থাকে। তবে তাদের কেউ সাহস করে আর বাসায় আসেনি। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে জুয়েল নিজেই কাশেম সাহেব ও রোকেয়া বেগমকে নিয়ে ডাক্তারের নিয়ে যেতে চায়। তবে উনারা ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হননি। কাশেম সাহেব বলেন, যদি সাধারণ সর্দি-কাশি হয়ে থাকে, তাহলে এমনিতেই সুস্থ হবেন। আর যদি অন্য কিছু হয়, তাহলে ডাক্তারের কাছে গিয়েও কোন লাভ হবে না। এদিকে টিভিতে খবর আসছে, তাদের এলাকার আশেপাশের অনেকেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। তারা কিভাবে আক্রান্ত হয়েছে, সেটা কেউ বলতে পারছে না। চরম উত্কণ্ঠার মধ্যে সময় কাটছে জুয়েলের। তার বাবা-মায়ের শ্বাসকষ্ট অনেক বেশি বেড়ে গেছে। সে জোর তার বাবা-মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। উনাদের আইসোলেশনে ভর্তি করানো হয়। জুয়েলসহ তার ভাইবোনদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। এরই মধ্যে কাশেম সাহেব ও রোকেয়া বেগমের মৃত্যুর খবর আসে। শুধুমাত্র একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে করোনার মরণ ছোবলে আরো অনেকেই এখন মৃত্যুর পথযাত্রী।
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা