করোনা, স্বদেশ ও রমজান



এক করোনা ভাইরাসে কুপোকাত পুরো বিশ্ব। থমকে গেছে জনজীবন। মানুষ মরছে আর মরছে। যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, চীনসহ বিশ্বের বহু শক্তিধর রাষ্ট্র আজ মৃত্যুপুরী। মৃত্যুর সময় আর শেষ বিদায়ে পাশে থাকছে না স্বজনরাও। বিদায়ী যাত্রায় যথাযথ সম্মানটাও পাচ্ছেন না বেশিরভাগ মানুষ। মানুষ মিশতে পারছে না মানুষের সাথে। মেলাতে পারছে না হাতের সাথে হাত। পুরো পৃথিবী যেন আজ অমানবিক হয়ে ওঠেছে। এই ভয়াল করোনা ভাইরাস আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশেও প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। সেই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছেও জ্যামিতিক হারে। লাশের মিছিলও শুরু হয়েছে। এই মিছিল কত দীর্ঘ হয় তা কারো জানা নেই। যদিওবা বিভিন্ন মহল অত্যন্ত ভয়াবহ পূর্বাভাস দিচ্ছে। এই পূর্বাভাস যেন মিথ্যা হয়। আমাদের দেশ তথা সরকার শুরুর দিকে করোনা ভাইরাসকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো খুব একটা পাত্তা দেয়নি। অথচ সেই আমেরিকায়ই এই ভাইরাস এখন সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করছে। আমাদের দেশেও শুরু হয়েছে। জানি না, এমন সামান্য কিছু ভুলের মাশুল আমাদের দেশকে কত বড় করে দিতে হয়। বৈশ্বিক পরিস্থিতির আলোকে পর্যালোচনা করলে মনে হয়, আমাদের দেশের করোনা পরিস্থিতি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। মৃত্যুপুরী ইতালি, চীনের শুরুটাও এমন ছিল। তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। তবুও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। এতো উন্নত রাষ্ট্র যেখানে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সেখানে আমাদের ক্ষেত্রে তা কতটুকু সম্ভব তা দেখার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

কিছুদিন আগেও আমরা সরকারের দোষ প্রচার করতে করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিষিয়ে তুলছিলাম। কেন লকডাউন করছে না, সাধারণ ছুটি ঘোষণা করছে না? সহ নানা প্রশ্ন তুলছিলাম। আসলে এই প্রশ্নগুলো সঠিক ও যৌক্তিক হলেও দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ইতালির মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ নয় যে, দেশ লকডাউন করে দিলে ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে যাবে, ঘরভাড়া মওকূপ হয়ে যাবে। যদিওবা আমাদের দেশের মন্ত্রীদের কথার ফুলঝুরিতে মনে হবে আমরা ইতালির চেয়েও শক্তিধর কোন রাষ্ট্রের নাগরিক! কিন্তু বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। যা পিপিই, কীট, আইসিইউসহ নানা চিকিৎসা সামগ্রী সংকটের মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। দেশে  মাত্র ছোবল দিয়েছে করোনা। এই শুরুতেই আমাদের খাদ্য বিপর্যয় নেমে এসেছে। ব্রাকের এক জরিপ বলছে- 'দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের ঘরে কোন খাবার নেই। প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের ঘরে ১/৩ দিনের খাবার মজুদ আছে।' এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন বাংলাদেশ। বিশ্বের শীর্ষ ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি ভারত। সেই ভারতেও খাদ্য সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মেখালা কৃষ্ণমারথী। এই কঠিন সময়ে বিত্তশালী ব্যক্তিরা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, দাঁড়াচ্ছেন। মানুষ খাবার নিয়ে ছুটছেন অসহায়দের বাড়ি বাড়ি। মনে হচ্ছে অসুস্থ একটি দেশে কোন সুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। পাশাপাশি এই কঠিন সময়ে মানুষকে চরিত্রের সার্টিফিকেট দেয়া দেশের কতিপয় জনপ্রতিনিধি মেতে ওঠেছেন জনগণের চাল লুটপাটে। আবার কোন কোন কোম্পানী বাড়িয়ে দিয়েছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। আসলে সবকিছুর আগে মানুষ হওয়াটা জরুরী। 

সরকার কয়েক দফা বাড়িয়ে ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বাড়িয়েছে। দেশব্যাপী সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। বলতে গেলে দেরীতে হলেও করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকার সাধ্যমতো ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে মানুষের অসচেতনতা। বাড়ি থেকে অপ্রয়োজনে বের হতে নিষেধ করা হলেও মানুষ তা মানছে না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। গ্রামের মানুষের মধ্যে সচেতনতা নেই। তারা অবাধে ঘুরছে, ফিরছে। আগের মতো চালু রেখেছে চা দোকানের আড্ডাও। এমনকি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণরাও ছাড়তে পারেনি খেলার মাঠের মায়া। মসজিদ, মন্দিরে মানুষের উপস্থিতির সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না। অথচ এই সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে দেশ ও মানুষের স্বার্থেই। আর গ্রামাঞ্চলের প্রশাসনও খুব একটা কঠোর নয়। মানুষের প্রতি, দায়িত্বের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা আছে বলে তারা হয়তো মনে করে না। নয়তো প্রশাসনের নাকের ডগায় সরকারি নির্দেশনা অমান্য হয় কেমনে! করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদ, মহল্লা কমিটির মতো ছোট ছোট ক্ষেত্রগুলোকেও গুরু দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। নয়তো এই অসচেতন, দায়িত্বজ্ঞানহীন জাতিকে বাঁচানো কঠিন হবে। জাতির মৃত্যু হলে বিলীন হয়ে যেতে পারে দেশের অস্থিত্বও। কাজেই এই যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে।

এদিকে আমাদের মাঝে সমাগত হয়েছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমযান। আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। আগের বছরগুলোতে রমযানপূর্ব এই সময়টাতে মানুষ ব্যস্থ থাকতো প্রস্তুতির কাজে। জমে ওঠতো হাটবাজারগুলো। বিত্তবান কেউ কেউ চলে যেতেন ওমরাহ পালন করতে। সবকিছু মিলিয়ে বলতে গেলে রমযানের একটা আমেজ বিরাজ করতো সর্বত্র। কিন্তু এবারের অবস্থা ভিন্ন। রমযানের ভালো খাবার তো দূরের কথা; মানুষ ঠিক মতো দুইবেলা খাবার জোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছে। কলকারখানা, গার্মেন্টস থেকে শুরু করে সবকিছু বন্ধ। মানুষ গৃহবন্দি অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। এদিকে পরিস্থিতিও দ্রুত অবনতির দিকে হাঁটছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মানুষকে ভাত খেয়ে রোজা পালন ও ভঙ্গ করতে হবে। অনেকের ক্ষেত্রে সেই সুযোগও হবে কিনা সন্দেহ। এই কঠিন সময়ে মানবতার খাতিরে বিত্তশালীরা অসহায়দের পাশে দাঁড়ালে কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হতে পারে। বিশেষ করে দান, সদকা যেন সুষমভাবে বন্টন হয়। ইতালি, যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে সৃষ্টি হলে এখানে ভাইরাসের আক্রমণের পাশাপাশি অগণিত মানুষ মরবে খাদ্যের অভাবে। ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর মনোবিদ ইয়োয়েল আনবান বলছেন- 'করোনায় আত্মহত্যা ও মানসিক বিকারগ্রস্ততা বাড়বে।' আমাদের দেশে আত্মহত্যা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। পরিবারের কর্তা যদি অধীনস্থদের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারে ব্যর্থতার দায় নিয়ে আত্মহনন করা ছাড়া উপায় কি! আর এখন তো পালাবার কোন পথও খোলা নেই। খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে হয়তো বেঁচে যাবে এদেশের অনেক মানুষ।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট