নিঃসঙ্গতার দিনগুলি...
সুমন ইসলাম
সময়টা বিশ মার্চ, দুই হাজার বিশ। সন্ধ্যাবেলা কাঁধে ব্যাগ চেপে লাইব্রেরীর দিকে ছুটছি। রাস্তায় মানুষজনের আনাগোনা নেই। যানবাহনও হাতে গোনা। হেঁটে হেঁটেই এগুচ্ছি। গাড়িতে চড়া ছাড়লাম কিছুদিন হলো। লাইব্রেরীর দরজার সামনে গিয়ে একটা শক খেলাম। দরজায় স্পষ্টাক্ষরে একটা নোটিশ ঝুলানো। লেখাটার মূলকথা এই, করোনা মহামারী দুর্যোগের কারনে- পরবর্তী ঘোষণা আসা পর্যন্ত লাইব্রেরীর পাঠকক্ষ বন্ধ থাকবে। খুবই খারাপ লাগলো। সারাটা দিন অপেক্ষা করি, এই সময়টায় একটু নিরিবিলি লাইব্রেরীতে বসে পড়াশুনা করবো, এই খেয়ালে। সতেরই মার্চ থেকে যদিও করোনার ভয়াবহতার কথা মাথায় রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। তবুও ভয়টা ওভাবে বাসা বাঁধেনি। এইবার কিছুটা ভাবতে হচ্ছে। ভাবতে হচ্ছে, বাসার বাইরে আর কোন কাজ থাকলো না। পেশাগত কাজের জায়গাটা বন্ধ। বিকেলে স্টুডেন্টের বাসায় যাওয়ার ঝামেলাটাও চুকে গেল। মাঠে মারা গেল, লাইব্রেরীতে গিয়ে বসার প্রবল আগ্রহটাও।
একুশ তারিখ সকাল। বিছানা ছেড়ে ভাবছি, দিনটা কীভাবে কাটাবো। আপাতত, রান্না ঘরে নুডুলসে মনোযোগ দিলাম। তারপর, নেট ঘেঁটে ঘেঁটে দ্বিপ্রহরের দিকে এগুচ্ছি। গোসল, রান্নাবান্না, খাওয়া এসবে আটকে থেকে অনেকটা সময় পার করলাম। বিছানায় গড়াগড়ি করে দখল করে নিলাম বিকালেরও কিছুটা। ঘুম থেকে উঠে মনে হলো, আমার আর কিছুই করার নেই। স্বাভাবিক জীবনে, বৈকালিক ব্যস্ততা ছেড়ে যাদের সাথে আড্ডাবাজি করতাম- তারা আজ গৃহান্তরীণ। ছাদে গেলাম, হাঁটতে। পাঁচ মিনিট হাঁটার পর মনে হলো, অনেকক্ষণ হাঁটছি। আবার বাসায় ফিরে এলাম। চুপচাপ বসে আছি, ভাবছি কতকিছু। হন্নে হয়ে খুঁজছি কি করা যায়, কি করা যায়? একবার ভাবলাম, যাই বাইরে থেকে ঘুরে আসি। কিন্তু সাহসে কুলালো না। শুনেছি, পাড়ার রাস্তাগুলোতেও পুলিশরা টহল দিচ্ছে। চারপাশে আমার ভদ্রবেশী একটা আস্তরণ ছড়িয়ে আছে। পুলিশের সামনে পড়ে এটার ব্যবচ্ছেদ করার সাহস হলো না। নিজেও দেখেছি সোস্যাল মিডিয়ার ভিডিওতে, রাস্তায় সাক্ষাৎ পাওয়া লোকজনকে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা কীভাবে আদর করছে। তাদের একটাই স্লোগান, ঘরে থাকুন নিরাপদে থাকুন। এক্ষেত্রে আর দ্বিমত করারও সুযোগ নেই। এখন একটাই চাওয়া, বেঁচে থাকুক সমগ্র পৃথিবী।
বাসায় একাই থাকি। কিন্তু কখনো একা মনে হয় নি। সময়গুলো ব্যস্ততায় ভরা ছিলো। ঘুম থেকে আটটার আশেপাশে উঠতাম। অতপর গোসল, প্রাতঃরাশ, একটু পড়াশুনা। দশটা থেকে চারটা পর্যন্ত কাজের জায়গায় কামলা খাটা। তারপর, বাসায় এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে স্টুডেন্টের বাসার দিকে দৌঁড়। সন্ধ্যা হয়ে হয়ে করছে, এই সময় লাইব্রেরীর দিকে যেতাম। থাকতাম, রাত এগারোটার কাছাকাছি। বাসায় এসে ইচ্ছে হলে, একটু খাওয়া-দাওয়া। অতপর, রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে ঘুম। এরপর আরেকটি সকাল, আরেকটি নতুন সূর্য।
বাসায় চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা নিয়ে এলাম। আর মন টিকলো না। বাসার পাশে অনতিদূরে ন্যাশনাল রেইল রোড। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আবেগের উৎসাহে চুপিচুপি রেললাইনে গিয়ে উঠলাম। উঠেইতো চক্ষু ছানাবড়া। অসংখ্য মানুষ রেললাইনের বিভিন্ন অংশ দখল করে বসে আছে। মনে হলো, হাঁসপাঁস করতে থাকা দেহে তারাও একটু প্রাণের সঞ্চার করতে এলো। যাক, স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলে রেললাইনে হাঁটায় মন দিলাম। কিন্তু, একটা নতুন ব্যাপার চোখে পড়লো। সিএনজি অথবা হোন্ডার হুইশেল শুনলেই তারা দৌঁড়ানোর প্রস্তুতি নেয়। পিকআপ বা মাইক্রো বাস আসা দেখলে দৌঁড় দিয়ে রেললাইনের সাথের সংযোগ গলিতে ঢুকে যায়। আমিও এরকম করলাম কয়েকবার। পরে বিরক্ত হয়ে বাসায় ফিরে এলাম। বাসায় এসেও আর করবোটা কি? কিছুক্ষণ কিচেনে, কিছুক্ষণ সামনের রুমে আবার একটু পর বেডরুমে। এভাবে করতে করতে সংক্ষেপে রাতের খাবার সেরে বিছানায় গেলাম। ঘুমানোর আয়োজনে আন্তরিকতার কোন ঘাটতি রাখি নাই। শুয়ে কিছুক্ষণ পর টের পেলাম, ঘুম আসছে না। অস্বস্তি আরো বেড়ে গেলো। এতবড় রাত পার করবো কীভাবে? আবার টেনশন হচ্ছে, পার করেও কী লাভ? সেইতো আবার বিরক্তিকর দিনের শুরু।
এভাবেই কাটিয়ে দিলাম মাস দুয়েক। জানি না, আর কতগুলো দিন পার করা লাগবে। মৃত্যুর মিছিল আর লাশের সারি বাড়ছে হু হু করে। প্রতিদিন খবর আসে পরিচিত কেউ না কেউ নাই হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং, রাতের আঁধারে ঘুম না আসা চোখ আর অলস মনে এটুকুই ভাবি- পৃথিবী আবার শান্ত হোক। স্বাভাবিক হোক চারপাশ। দিনগুলো আগের মতই শুরু হোক। একটা সতেজ আর ফ্ল্যাক্সিবল পরিবেশ উন্মুক্ত হোক সবার জন্য।
পুনশ্চ:
আজ চব্বিশ মার্চ দুই হাজার চব্বিশ। পৃথিবী শান্ত হয়েছে। আজ সবকিছু আগের মতই আছে। এখন আর কোথাও করোনার হুঙ্কার নেই। সময় বদলে যায় কতদ্রুত। এই সময় সেই সময়। আমাদের অপেক্ষা করাটা শিখে নিতে হবে। ধৈর্য ধরাটা রপ্ত করে নিতে হবে।
নির্বাহী সম্পাদক, ত্রৈমাসিক ত্রিমাত্রা।