সত্য না গল্প
মিসির হাছনাইন
মেয়েটা প্রচুর বই পড়ে। তিনবেলা ভাত গিলে ফেলা’র মতো বই গিলতে থাকে একের পর এক। বই পড়া তাঁর নেশা বলা যায়। মাত্র কয়দিনেই ইহা বড় বড় মোটাতাজা আটাশখানা বই পড়েছে সে। এমন রাতদিন বই পড়া মানুষদের আমার ভালো লাগে। তাঁরা কত কিছু জানে, আরো কত কি জানার জন্যে শুধু খেয়ে না খেয়ে বই পড়ে। মেয়েটাকে আমি বাস্তবে দেখি নি, দেখবো কি করে, দেখা হওয়ার কথা ছিল না তো!
কত সুন্দর! মনে হয়, মেয়েটা সেজেগুজে শাড়ি পড়া ছবির মতন তাকিয়ে আছে আকাশী রঙের দেয়ালে পরিপাটি পড়ার টেবিল, ঐ পাশে ঝুলছে একুশ সালের ক্যালেন্ডার, খাটের পাশে ড্রেসিং টেবিল আয়নার মধ্যে দেখা যাচ্ছে জানালার ঐ পাশের ধূলিবালির ব্যস্ত শহর, কখনও এই আয়নাতে একটা পাখি উড়ে যেতে দেখে নি সে, নকশি চাদরের কত সুন্দর জীবন্ত ফুলগুলো সিলিং ফ্যানের বাতাসে উড়ছে- মেয়েটার কত পৃষ্ঠা পড়া বইয়ের পাতা, এলোমেলো চুল
তাঁর ঘুম আসছে না। কেন ঘুম আসছে না, জানি না, জিজ্ঞেস করা হয়নি তো..! ডাইনিং টেবিলে বাতি জ্বলছে। এতো গভীর রাতের নিরবতায় মেয়েটা কি ভাবছে মনে মনে??
জানি না, জানার কথাও না।
একা ভয় পায় সে, রাতের বেলায়। তখন ফোনে গান বাজে, আচ্ছা, কেমন গান বাজে? কেমন গান তাঁর বেশি পছন্দ, জানি না, শুধু জানি- বই পড়ে আবার বই পড়ে.. এমনও হয়, একা একা শাড়ি পড়ে সাজে, ফোনে ছবি ওঠায়, ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখে সোডিয়াম আলোয় মানুষের পাখির মতন ছুটে চলবার তাড়া। এতো এতো মানুষ তবুও, ভয়...
বই পড়তে পড়তে অন্য এক জগৎ তৈরি হয়, সেখানে ভয় নাই, আহা! গল্পের মানুষগুলো কেন যে বাস্তবে আসতে পারে না, খুব করে তাঁর মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয়, গল্পের সব চরিত্র হাজির করে- বাস্তব ঝুলে থাকা আকাশের নিচে, আকাশটার কত দুঃখ তবুও জ্বলছে, মানুষের দুঃখ, মানুষের জীবন... না, না, এতো কিছু সে ভাবতে পারতেছে না! মনে হচ্ছে কে যেন তাঁর সামনে দাঁড়ালো, ধুর, এতো রাতে কে আসবে, মনের ভয়, একি গল্পের ঐ নায়কটা না.. তাই ত, গোলাপি শার্টের নষ্ট চোখের মানুষটা।
আচ্ছা, মানুষটার দাঁড়ানোর কি কথা ছিল? মেয়েটা জানে না, তাঁর ঘুম আসছে না, তবে ভয় লাগছে না। মানুষ টা চলে গেলে কি ভয় লাগবে?
এই মূহুর্তে মেয়েটা গল্প শুনতে চাচ্ছে। যেমন ঘুম পাড়ানো গল্প বলতো মা, এতো আগ্রহ নিয়ে সেসব গল্প শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে যেতাম নিজেও জানি না, কিন্তু, শেষ হয় না সেসব গল্পের কাহিনি।
মানুষটা কি আমাকে এখন গল্প শুনাবে, চুপিচুপি কথা বলবে আর ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে চাইলেও মন্দ লাগত না, গল্পের নায়িকার মতন আমি মানুষটাকে নিষেধ করতাম না।
মেয়েটা গল্প শোনে, যে কিনা এতো এতো গল্প, উপন্যাস গিলে রেখেছে- তাকে কেমন গল্প বলা যায়...!!!
২.
ধর, নাম না জানা এক গাঁয়ের একটা লোক, শহরে তাঁর নতুন কোম্পানিতে জব হয়েছে। বহুদিনের পরিচিত গাঁও ছেড়ে সে শহরে আসলো। যদিও সে কখনও ভাবেনি সে শহরে আসবে, এবং থাকবে। রাজধানী শহরে এর আগেও দুই কি তিন বার এসেছে লোকটা, কিন্তু, থাকে নি কোনদিন।
এখন থেকে তাঁর এই শহরে থাকতে হবে, ভাবতেই তাঁর বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে, চোখ ভরে জল চলে আসে।
শহর তাঁর বিষের মতন লাগে শহরের; কোলাহল তাঁর ভালোই লাগত না, নানান চিন্তায় যখন সবাই ঘুমিয়ে গেছে গভীর রাতে লোকটা প্রচুর কান্না করত।
তাঁর এই অবস্থার কথা সে কাউকে বলতে পারত না। তবুও অনেক কষ্টে এক সপ্তাহ (তাঁর মনে হয়েছে সাত বছর) থাকার পর লোকটা পালিয়ে যায়।
ও হ্যাঁ, তাঁর বুক ভরা দুঃখের খরব শুধু একজন জানত, সে গাঁয়ে থাকে, কত দূরে....
গাঁয়ে থাকা তাঁর প্রিয় মানুষটা মনে হয় তখনও ঘুমায় নি, জানতই না, সে আজ ঘরে আসবে।
বিষন্ন মনে ঘরের এক কোণে শান্ত চকিতে বসে বসে কি সব হাবিজাবি ভাবছে সে-
ইশ! মানুষের ডানা থাকলে খুব ভালো হতো, ইচ্ছে করলে খুলে রাখা যেত.. আবার, ইচ্ছে করলে উড়াল দেওয়া যেত। আকাশের ঐ তারাগুলো কুড়িয়ে নিতে গেলে আমি উল্টে যাই কেন? আরে ধুর, কি সব হাবিজাবি ভাবছি!
মানুষটা তবে আসুক, কখন আসবে? আমি কি তখন ঘুমিয়ে যাবো? না, আমি ঘুমিয়ে গেলে সে স্বপ্নে আসে অন্য রূপে, আমার তাকে অন্য রূপে দেখতে ভালো লাগে না। না, আমি ঘুমাবো না, কিন্তু কখন আসবে সে...?
এতো কিছু ভাবতে ভাবতে কে যেন ডাকল চুপ করে, এই যে শুনছো.. ঘুমিয়েছো?? আমি এসেছি, তোমার জন্য কি এনেছি দেখো..?
দরজা খুলতেই ইরাবতী দেখলো অন্য রূপে দাঁড়িয়ে আছে মোবারক। না, আমি স্বপ্ন দেখছি, হ্যাঁ, স্বপ্নই তো...!
বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি আমার মোবারক, ওহ আল্লাহ। ঘুম ঘুম চোখে ইরাবতী চকিতে বসে।
-তোমার মাথাডা গেছে, দেখি দেখি তুমি এতো শুকিয়ে গেছো কেন?? এ কয়দিন ভাত খাও নাই?? তোমারে ছাইড়া আমি এক সেকেন্ডের জন্যও থাকতে পারতেছি না, ইরা। তাই পলাইয়ে চলে আসছি।
-উহু, পলাইয়ে আসছে.. ইরাবতী চোখ বড় বড় করে.. দেখো, দেখো বলে কি! তাহলে, না খেয়ে থাকবে নাকি?
-বলেন ত আপনি কে? আপনি মোবারক সাব না, যান ত আমার ঘর থেইক্কা, আমি স্বপ্ন দেখতেছি, শুধু, শুধু ঘুমের মধ্যে আমাকে ডিস্টার্ব করেন, যান ভাই, যান।
-আরে.. আরে.. ঘর থেকে বের করে দিচ্ছো যে, যাচ্ছি যাচ্ছি..হাতমুখ ধুয়ে আসতে হবে, বুঝছি ত, মোবারক ঘরের বাইরে যায়।
-জ্বি না, ইরাবতী কেমন সুরে বলে উঠলো ঘরের ভিতর।
তোমাকে বলবো, আজ দুপুরে পুকুর পাড়ে কি দেখেছি জানো..?
মোবারক অন্ধকারে বলে ওঠে, আরে বাবা, না বললে জানবো কি করে..?
-এই তো আমি এখন বুঝছি আমি আসলেই স্বপ্ন দেখতেছি, ইরাবতী বলে।
-স্বপন... ওওও খোয়াব, আমিও দেখি, জানো, শহরটা আমার ভাল্লাগে না, কত রকমের মানুষ থাহে, কেউ কাউরে চিনে না, কেউ জিগায় না, খাইয়া আছি না বাঁইচা আছি..মোবারক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তাঁর মন কত খুশি খুশি..
-শহরে থাকো কেন তুমি, গাঁয়ে থাকতে পারো না আমার ঘরে, আমার পাশে?? জানোই ত, আমি ভয় পাই রাত দুপুরে.. ইরাবতী বলে- উহ!
আমি একটু টয়লেটে যাবো তুমি পানির কল পাড়ে থাকো, আমি আসতেছি,
ঘরের পাশেই পানির কল ঘর, এতক্ষণ ওখান থেকেই কথা বলছিল মোবারক।
-জানো, রাত হলে আমি কান্না করতাম, আমার কিচ্ছু ভালো লাগত না, শুধু গাঁয়ের কথা মনে পড়ত..
-তাহলে আমার বাড়িত আইছেন কেন? আমি কি স্বপ্ন দেখতেছি!! হায় আল্লাহ!! যান, যান আপনি আপনার গাঁয়ে চলে যান। টয়লেটে থেকে নাকি কথা বলতে হয় না, তাও বলতে হচ্ছে.. ইরাবতী মিটি মিটি হাসলো।
মোবারক চুপ, দাঁড়িয়ে আছে গাব গাছের পাশে মরা বরই গাছের নিচে। কয়েকটা ঝিঁঝি পোকা একটানা ডাকছে তো ডাকছেই।
-জানো, কি হইছে...? কতগুলো টাকা এই ব্যাগের মধ্যে.. আশেপাশে তাকিয়ে হঠাৎ বলতে গিয়ে চুপ হয়ে যায় মোবারক।
ইরাবতী কিছু না বুঝোই মিটিমিটি হাসে.. আমি কিন্তু স্বপ্ন দেখতেছি, আপনি একটু পর চলে যাবেন, ঐদিনের মতন।
মোবারক চুপ দাঁড়িয়ে আছে। বউের কথা মোবারক শুনে আর ভাবে এতো স্বপ্ন স্বপ্ন করছে কেন, ইরা??
কি হইলো কোন অসুখ নাকি?? নাকি জ্বীন ভূত, না, না এসব ভাবতে ভাবতেই..আমের ডালে ডেকে উঠলো একটা পাখি, মোবারক একটু ভয় পেল। কেউ দেখে নি, তারপরও হঠাৎ ভয় পাওয়া মানুষের মতন আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিল মোবারক।
চুপ দাঁড়িয়ে আবার ভাবলো আমার আর শহরে যাওয়া হবে না, না, আমি আর যাবো না, কখনও না, জীবনেও যাবো না, কি এক আজীব শহর রে বাবা, হঠাৎ তাঁর চোখে ভাসলে- এর মধ্যেই দরজা খুলে ইরাবতী বেরুতেই মোবারক কিছুটা নড়ে উঠলো।
-একি! এখানে এখনও দাঁড়িয়ে আছো?? আমি ভাবছি, চলে গেছো। তাহলে ত আমি স্বপ্নই দেখতেছি বাস্তব হলে ত ঘরে গিয়ে এতক্ষণে ঘুম দিতেন। যাও, যাও আমি ঘুমাবো, উহ! তুমি ঘুমের ভিতরে ডিস্টার্ব করো.. মোবারক সোনাপাখি আমার তুমি বাস্তবে আসলে.. কি এমন হয়!! আমার যে ঘুম আসে না তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছে করে
মোবারক এতক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলে উঠলো, চোখ খুলে দেখো আমি তোমার দরজার সামনে
- ইশ! এসব কি বলছো তুমি.. মিথ্যা কথা বলবা না, জানো না, আমি এসব পছন্দ করি না!
-তাহলে কি..!
-তাহলে কিছু না, ওখানে দাঁড়িয়ে থাকো।
-আর তুমি.??? মোবারক বললো।
-আমি কি! আমি এখন ঘুমাবো।
ততক্ষণে ইরাবতী ঘরে ঢুকে গেছে। মোবারক দাঁড়িয়ে
বললো, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা লাগবে??
-আমি জানি না, সকল পর্যন্ত থাকলে বুঝতাম তুমি আমার সত্যি কারের মোবারক।
-আইচ্ছা দেইখো তুমি।
ইরাবতী ঢুলতে ঢুলতে শুয়ে পড়লো। ওদের জামাকাপড় রাখার দড়ি ওদিক টার উপরে একটা পেরেকে কয়েকটা ব্যাগ ঝুলছে। শুয়ে শুয়ে ভাবছে.. আমি আসলেই কি স্বপ্ন দেখতেছি??? বাস্তবের মোবারক কবে আসবে? কবে আসবে??
টিনের চালে বসন্তের দমকা হাওয়ায় গাছের পাতা পড়ছে, শিশির টুপটাপ আর কান ঝালাপালা করা ঝিঁ ঝিঁ, উহ! তুমি কবে আসবে? আমি আর থাকতে পারছিনা, ঘুম আসছে না কেন? ইরাবতী ভাবছে- মোবারক যদি আর না আসে, ধুর, সে আসবে না কেন!! শহরে তাঁর কিছু হয় নি ত! উহ! কি সব অলক্ষুণে কথা ভাবছি, আল্লাহ মাফ করো। আল্লাহ তাকে সুস্থ রাখো।
আমি মোবারক কে কত ভালোবাসি, ছেলেটা কত ভালো, আমারে কত ভালোবাসে.... আচ্ছা, আমি যত টুকু ভালোবাসি তারচেয়েও বেশি, না না না... ইরাবতী হাসে..
পাগল ছেলে একটা, কত কি কিনে আনে আমার জন্যে!
কেন রে, তোর জন্যে কিছু আনলি না, সব আমার জন্যে আনা লাগবে। আমার জন্যেই ত ঢাকায় গেছে চাকরি করতে, আহারে! মানুষটা যেতে চায় নি, আমারে ছাড়া থাকতে পারে না, কিচ্ছু, বুঝে না। কেমন আছেন উনি? কত না কষ্ট করছেন ইশ! আমি তারে কবে যে দেখবো? আইচ্ছা, আকাশের চাঁদ কি সে আজকে দেখেছিল?? ঐ যে এক লগে দেখতাম- তিনটা তারা।
আল্লাহ!! দেখা হওনের আগে আমি বিশ্বাসই করি নাই মোবারক এতো ভালো, মানুষ.. এতো ভালোও হয়..! হঠাৎ ইরাবতী দেখে - একটা নৌকায় সে সেজেগুজে বসে আছে, কত সুন্দর পদ্ম ফোটা বিল, নাও এগিয়ে চলে, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে, কেমন কেমন মন নিয়ে সে হাসে। আহা! কত সুন্দর তার জীবন.. এইছাড়া এক জীবনে সে কি আর চেয়েছিল..??
এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে ইরাবতী। টুপ টাপ শিশিরের শব্দে মোবারক দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মোবারক হঠাৎ চোখ বন্ধ করে ইশ! কখন ভোর হবে, ভোর কতদূর..??
রাত এতো বড় নয়, তবুও আজকের রাত শেষ হয় না কেন??
কখন পুবের আকাশে সুন্দরী লাল টকটকে সূর্য উঠবে- আমি দেখবো আমার ইরাবতীর মুখ??
অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মোবারক ভাবছে এই বুঝি ঘুমের ঘোরে ঘুমিয়ে গেলো ইরাবতীর বুকের উপর।
লক্করঝক্কর বাসের সিটে হঠাৎ চমকে ওঠে সে। ভোর হয়েছে, লাল শান্ত স্নিগ্ন মাখা লাল সূর্যের কিরণে প্রকৃতি হেসেছে কত সুন্দর রূপে, মনে মনে কত খুশি মোবারক । একটু পরই সে ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ডাকবে ইরা ওও ইরা...ইরাবতী..কতদিন দেখি না বউটার মায়া মায়া বুক এসব ভেবেই ঘুমচোখে মনে মনে মিটিমিটি হাসে মোবারক।
৩.
একটা সড়ক দুর্ঘটনায় পুরো বাসের সবাই মারা গেল। মোবারকও পৌছেছে বাড়ি, তবে একটু দেরিতে, তখন সূর্য বরাবর মাথার উপর..
ঘুমায় গেছো??
গল্প লিখতে লিখতে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছিল। জানি, ঘুম থেকে ওঠেই মেয়েটা বই পড়ে। কিন্তু, আজ হয়তো ভুল করেই ভোরের ঘুম ভাঙতেই যদি মেয়েটা ফোনের ম্যাসেঞ্জারে এই গল্পটা পড়ে হয়তো এক গাল হাসবে,, মেয়েটার সেই অদৃশ্য রোমাঞ্চকর হাসিতে- গল্পটা তবেই স্বার্থক হয়ে উঠবে।
নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়