রাজকন্যা

 



রাজকন্যা

আবু নেসার শাহীন


একটা লোক বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার পিছু নিয়েছে। সে ও লোকটার উপর নজর রাখছে। মনে মনে ভাবে কিছু হলে চিৎকার করে লোকজন জড়ো করবে। অনেকটা পথ হেঁটে রিক্সায় ওঠে। লোকটা ও রিক্সা নেয়। রিক্সার হুড তুলে দোয়া পড়ে। বুক ধড়ফড় করে। বাসার কাছে এসে দ্রুত রিক্সার ভাড়া দিয়ে বাসায় ঢুকে। তিন তলায় ওঠে বারান্দায় এসে নিচে তাকাতেই দেখে লোকটা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে পায়চারি করছে। সে প্রচন্ড ঘামে। বুয়া এসে  চা দিয়ে যায়।

মনে পড়ে স্কুল কলেজে পড়ার সময় অনেকে তার পিছু নিতো। কেউ কেউ বাসা পর্যন্ত এসে পড়তো। কিন্তু লোকটা কে? তার পরিচিত কেউ? বুয়া এসে বলল, খালা আফনের কখনও বিয়ে হইছিল? নিচে যে লোকটা ঘুরাঘুরি করতাছে সে নাকি আফনের স্বামী?

বুয়ার কথা শুনে সে আৎকে ওঠে। শরীর কাঁপে। কাপ পিরিচ পড়ে ভেঙ্গে যায়। মুখ থেকে একটা অস্ফুট উচ্চারণ বের হয়, মোরশেদ! 

কি অইলো খালা? আফনে এমন করতাছেন ক্যান? চলেন ঘরে চলেন। সে ঘরে যায় না। আকাশ মেঘলা। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ে। মোরশেদ এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত ব্যাপার। এক সময় মোরশেদের জন্য সে ঘর ছেড়ে ছিল। মোরশেদের কোন আয় রোজগার ছিল না। এ জন্য মোরশেদকে কম অপমান করতো না সে। তার অপমান সহ্য করতে না পেরে এক সময় মোরশেদ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ত্রিশ বছর পর মোরশেদ কেন তার কাছে এল?

অনেক ভেবে চিন্তে বুয়াকে দিয়ে মোরশেদকে ডেকে পাঠালো। চুপচাপ মুখোমুখি বসে থাকে দু'জন। সে কাপড়ের আচলে মুখ মুছে বারবার। হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করে মোরশেদ, কেমন আছো শখ?

ভালো। সে চমকে ওঠে।

কি করে আমায় ছাড়া থাকতে পারো?

আমি! তোমায় ছাড়া! আর তুমি? সে ঢকঢক করে পানি খায়।

আমি! আমি আজ ও তোমাকে ভালোবাসি। জানো আজ আমার অনেক টাকা। বাড়ি গাড়ি আর ও কত কি! অথচ--। 

এতো বছর পর এসব বলতে এসেছো? 

না। মোটেই না।

আমি তোমাকে নিতে এসেছি? বাকি জীবন এক সাথে কাটাবো। দেখ আজ তোমার কিছু হলে দেখার কেউ নেই। আমার বেলায় ও সে একই কথা। আর আমাদের তো ডিভোর্স হয়নি। আমরা ও এখনও স্বামী স্ত্রী।

সে ওঠে দাঁড়ায়। ব্যাস্ত সমস্ত হয়ে পায়চারি করে। দুটো সিলিং ফ্যান ঘুরছে। তারপর ও ঘামছে সে। অবসর নেওয়ার পর সঞ্চয় পত্র কিনে বেশ ভালই যাচ্ছিল। এ কথা সত্য যে সে একা। সে বলল, আজ তুমি চলে যাও। আমাকে কিছু দিন ভাবতে দাও। ফের তোমার সাথে সংসার করবো একবার ও ভাবিনি। সে যাই হোক।

আমিতো কোন অপরাধ করিনি। চাকরি-বাকরি ছিল না বলে তুমি আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে। একটা সময় আর নিজেকে কনট্রোল করতে পারছিলাম না। এতো অপমান। শেষ পর্যন্ত তোমাকে কিছু না বলে রাস্তায় নেমে পড়ি। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াই। মানুষের কাছে হাত পেতে খাই। রাত হলে বাস বা ট্রেন স্টেশনে ঘুমিয়ে পড়ি। এক নিদারুণ কষ্টের ভেতর দিয়ে দিন কাঁটে। তারপর ----।

থামলে কেন বল? সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

আজ থাক। আর একদিন বলবো। মোরশেদের মুখ ভর্তি দাড়ি। লম্বা কাঁচা পাকা চুল। সাদা পাঞ্জাবীতে অপূর্ব সুন্দর লাগছে তাকে।

আমি অবশ্য তোমাকে খোঁজ করেছি।

মিথ্যে কথা বলবে না। আমি তোমাকে চিনি। বাসার সমস্ত কাজ আমাকে দিয়ে করাতে। বাজার খরচের টাকা দিতে না। প্রায় দিন বাইরের থেকে খেয়ে আসতে, তাই না? বাইরের থেকে এসেই বলতে মাথাটা খুব ধরেছে। প্রচন্ড শরীর ব্যাথা। আমি সারা রাত তোমার হাত পা টিপে দিতাম। আর তুমি নিশ্চিতে ঘুমুতে। মোরশেদ ওঠে। ড্রইং রুমের দেয়ালে শখের বিভিন্ন ধরনের ছবি টাঙানো।

শখ সোফা ছেড়ে ওঠে চলে যায়। বুয়া আসে, সবাই জানে খালা অবিবাহিত। পাকের ঘর তুন আফনেদের কিছু কিছু কতা আমি হুনছি। আফনে কালই গাটটি বোজকা লইয়া আইয়া পড়েন।

হা হা হা। আচ্ছা এ বাসায় কোন পুরুষ মানুষ আসে?

না। খালা খুব ভালো। কিন্তু নামাজ কলমা পড়ে না। আবার মাঝে মধ্যে সিগারেট ও খায়। কক্সবাজার যাই দুই তিন ঘুইরা আসে। বুয়া চলে যায়। মোরশেদ ওঠে। এ সময় শখ আসে, কী চলে যাচ্ছ? 

হ্যাঁ। দেখে মনে হচ্ছে ভালোই আছো? আমার প্রস্তাব ভেবে দেখো। আমি যা বলছি মন থেকে বলছি। দেয়াল জুড়ে শুধু তোমার ছবি। তোমার আর আমার একটা ছবি থাকলে মন্দ হত না?

আসলে লোকে নানা রকম প্রশ্ন করবে তাই ---। সে ইতস্তত করে। চারদিকের দেয়ালে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।

হুঁ। মোরশেদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।

আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, না? 

বিশ্বাস করার মত কিছু করেছো?

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে মোরশেদ ভালো। কিন্তু মাঝখানে ত্রিশ বছর! মোরশেদ চলে যায়। ভাবতে ভাবতে রাত শেষ হয়। এক মুহূর্তের জন্য ও ঘুম আসেনি। চোখের নিচে গাঢ় কালি পড়েছে। 

সকাল বেলা নাস্তা সেরে বাজার করতে বের হয়। বাস স্ট্যান্ডের সাথে বাজার। বাজারের মুখে মোরশেদ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। কিছুক্ষণ পর পর বাম হাতের কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে। সে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মোরশেদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মোরশেদ মুচকি হেসে বলল, আজ মনে হয় অনেক লেট করে বাজার করতে এসেছো?

না। প্রতিদিন এ সময়ই বাজার করতে আসি। তুমি কি আমাকে প্রায়ই ফলো করো?

না না কি বলছো এসব। মোরশেদ শব্দ করে হাসে।

তুমি দাঁড়াও। আমি বাজার করে আসি। তারপর বাসায় গিয়ে এক সাথে চা খাব।

ঠিক আছে।

বাজার করে বাসায় ফিরে দু'জন। বুয়া এসে চা দিয়ে যায়। চা শেষ করে ওঠে দাঁড়ায় মোরশেদ, এ মুহূর্তের জন্য ও তোমাকে মন থেকে মুছতে পারিনি। মজার ব্যাপার হলো----?

কী? থামলে কেন বলল? সে লক্ষ্য করে বুয়া পাকের ঘর থেকে আড়ি পেতে সব শুনছে। সে ইশারায় মোরশেদকে বারেন্দায় নিয়ে আসে। মোরশেদ বলল, একবার পেপারে তোমার খোঁজ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে ছিলাম 

তারপর!

থাক আর দিন বলবো। চল কোথাও থেকে ঘুরে আসি। ড্রাইভারকে আসতে বলবো?

না মানে। সে ইতস্তত করে।

তুমি ইতস্তত বোধ করছো কেন? আমাকে বিশ্বাস করছো না?

সে চুপচাপ বসে থাকে। তার ও কিছুক্ষণ পর ডুকরে কেঁদে ওঠে। বুয়া দৌঁড়ে এসে বলল, কি অইছে? খালা কানতাছে ক্যান?

কেউ কোন উত্তর দেয় না। বুয়া চলে যায়। সে বলল, আমার কেন মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে।

তুমি কি আমার ফিরে আসাতে বিরক্ত? তাহলে বল আমি আর আসবো না। আগের মতো করে সব চলবে। মোরশেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। কাছেই কোথাও বাস পড়ে।

সে চুপ করে থাকে। একা থাকতে থাকতে তার জীবন বদলে গেছে। কারও সাথে থাকা মানে তার আদেশ উপদেশ শুনা। না না এ রকম জীবন সে চায় না। তার মাথা ধরে। মোরশেদ নিচে নামে। সে দেখে একটা দামি গাড়ি এসে থামে। মোরশেদ গাড়িতে ওঠে।

এভাবে বেশ কিছু দিন কেঁটে যায়। মোরশেদ ও তার সাথে যোগাযোগ করে না। সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।   

একদিন খবর আসে মোরশেদ হাসপাতালে। সে হাসপাতালে ছুটে আসে। মোরশেদ বলল, আমার সব সম্পত্তি তোমার নামে উইল করে দিয়েছি। মারা গেলে সব তুমি পাবে। সে হাউমাউ করে কাঁদে। যেন মোরশেদের জন্য তার কত টান! সে বলল, তুমি কেন মরতে যাবে। তোমার কিছু হয়নি। দেখবে তুমি সুস্থ হয়ে ওঠবে। আবার আমরা সংসার করবো। 

সত্যি বলছো। মোরশেদ মনে শান্তি পায়। বিড়বিড় করে কি যেন বলে। হাতের কব্জি ওঠলে ঘড়ি দেখে। ভালো করে কথা বলতে পারে না। তার দায়িত্বে থাকা নার্স চেঁচিয়ে ওঠে, উনার সাথে এতো কথা বলবেন না।

সে দিন রাত মোরশেদের সেবা করে। মোরশেদ কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে। সে ভয় পায়। মোরশেদ  সুস্থ হয়ে ওঠলে আবার তাকে সংসার করার জন্য ছাপ দিবে। কিন্তু না। দিন কয়েক পর মোরশেদ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এবং গভীর রাতে মারা যায়। মোরশেদের জন্য তার মায়া হয়। কি বুঝে তার সবকিছু তার নামে উইল করে দিয়েছে কে জানে।

এক মাস পর মোরশেদের উইল দেখে চমকে ওঠে সে। এতো সম্পত্তি! আর ব্যাংকে এতো টাকা! মোরশেদের টাকা আর সম্পত্তি পেয়ে ধনী হয়ে ওঠে। ইঞ্জিনিয়ার ডেকে ফ্ল্যাটের চেহারা বদলে পেলে। বাড়িতে শেইফ রাখে। ইচ্ছে হলে চাইনিজ খায়। দামী গাড়ি হাকে। পোশাক ডিজাইনার রাখে। আশেপাশের লোকজন অবাক হয়। যে মহিলা বাজারে গিয়ে জিনিস পত্রের দাম করতে করতে দোকান মালিককে অতিষ্ঠ করে তোলে সে কি না এখন এক দামে সব কিনে ।

আত্মীয় পরিবার পরিজনদের চাপে শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিয়ে করে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। আর প্রতি বছর বেশ বড় করে মৃত্যু দিবস পালন করে মোরশেদের। মনে মনে ভাবে মোরশেদ সত্যি তাকে খুব ভালোবাসতো!






শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট