শব্দমিছিল
রোমেনা আফরোজ
শরণার্থী জীবন
জীবনের ভেতর আরেকটা জীবন, যেখানে বয়স বাড়ে না। পৌঢ় বলতে ওখানে কোন শব্দ নেই। সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ভীষণ আঁকাবাঁকা রাস্তা। এ পাশ থেকে বোঝা যায় না বাঁকের অন্যপাশে ঠিক কী আছে, কতটা অন্ধকার! তবুও থামার লক্ষণ নেই। চলছি তো চলছি। একা একা। তুমি বলতে এত দিন যাদের বুঝেছি, তারা যেন সোনার হরিণের খোঁজে। এতটা বস্তুবাদী মানুষ কী করে হয়! এই যে তোমাকে ডাকছি, অনুচ্চস্বরে, ডালপালা নড়ে উঠল, আকাশের এক বুক কান্না এসব মতিভ্রম নয়। একজন মানুষ যখন সমাজ থেকে দূরে সরে যায় তখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করে নেয় প্রকৃতি। আজকাল শরীর কথা বলে না। ক্রমশ মন দখল করে নিচ্ছে শেকড়বাকড়। এই দখলদারিত্ব এতটাই ধীরে ধীরে যে তুমি বুঝলে না, শেষ বৃষ্টিপাতেই ক্ষতি হয় অধিক। ঠিক এই জায়গায় এলে মনে হয়, মানুষ নিতান্ত একা। সামাজিক জীব বলে সারাক্ষণ যে ধর্মীয় গ্রামোফোন বাজে আসলে তা বাইরের রূপ। যেমন পানামাসিটির এক পায়ের সাঁকো। তারপর আর কোন রাস্তা নেই। ঢেউ এর পর ভাসমান রাত্রি। আশ্চর্য সব সেলাইয়ের দাগ নিয়ে স্থবির হয়ে আছে জনজীবন। কেউ জানে না, পাশের মানুষটিও ঠিক তার মতন একা। এই একাকীত্বের দায়ভার কি নেবে না পুঁজিবাদ? আলো যতটা কাছে তারচেয়েও অধিক কাছে বসে থাকে ফস্টাস। এই আগুনমুখো শিশুটিই যেন আজকের যিশুখ্রিস্ট। তাকে দু’হাতে তুলে নিলে গ্রাস করে নেয় ফসলের মাঠ। আর ফেলে দিলে আঁকড়ে ধরে দু’পা। কেউ থাকুক কিংবা না থাকুক, স্নায়ুভর্তি বিষ পিঁপড়ে। নিজস্ব বলতে যেটুকু পথ দৌড়ে এসেছি তাতে কোন ছন্দ নেই। পায়ের কাছে এক জোড়া খঞ্জর। হয় তাতে আত্মাহুতি দেবো নয়তো খুনের রক্তে নতুন করে লেখা হবে শরণার্থী জীবন।
আমাদের স্বপ্নগ্রাম
অরণ্যের মত আপন কেউ নেই। এখানে সেখানে পড়ে আছে কয়েকটি স্ত্রীপালক। এতটা জেদ নিয়ে কার কাছে যে যাই? ঐ যে রেললাইন। সেদিন ট্রেনের তলায় মাথা দিয়ে মরেছিল যে মেয়ে তার নামটা জানিস বুবলি? সে কী জেদ! এভাবেই মৃত্যুরা ছায়া হয়ে নেমে আসে উপত্যকায়। মায়ের ছায়া ভর্তি উঠোন। পুকুরপাড়ে ছিঁড়ে যাওয়া ব্লাউজটাকে মনে হয় পতাকা। বড় দাদি নুয়ে নুয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কলতলার দিকে। তার হাতে গত বছরের শাড়ি। তাতে রঙ নেই। রঙের কৌটোটা কোথায় রেখেছিস অরণ্য? যা। চলে যা। নতুন রাস্তা ধরে না হোক, পুরাতন রাস্তার অনর্থক দিনগুলি ফেলে ঊর্ধ্বলোকে। হায় ইকারাস! প্রস্থানের ভঙিমা একইরকম ন্যুব্জ। অভিন্ন গড়নের। এটাই নাকি পেশাদারিত্বের লক্ষণ । তুই কি অফিস শেষে ফিরে আসবি এ পথে? পাতা কুড়াবো। কচি হেমলক পাতা। এই শহরে সবুজ নেই। আর্যরা এখন গ্রামে থাকে। হয়তো গ্রাম ছেড়ে আরও প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন মানুষ ঘুমায়। খিদে পেলে তড়িৎগতিতে হাওয়া বদলায়। বারবার পিছুটান । ঘন্টা বাজে না। বিভেদের গান। এক একদিন খেয়াল হয়, আমার বলে কিছু নেই। স্কুল থেকে এই পর্যন্ত মন দখল করে আছে ময়ূরপঙ্খি ঘুড়ি। ঘুড়ি কি জানে, ক্লাস্টোফোবিয়ার ঘরগুলি কতটা বুদবুদময়! বিষাদের এক পা ধরে আছে খনা। তুই এসব চোরাবালিতে পা ফেলিস না। চলে যা। সামনের সিগনাল ফেললেই নতুন কর্মসূচী। যারা শরীরের ভার উত্তোলন করতে জানে না তারা কেবল পাথর ঠেলে। আমি পাথর নই, নিজেকে ভাঙছি। একটু একটু করে ক্ষয়, অপচয়। রিপভ্যান উইঙ্কেলের মত ঘুমপন্থী রাতে হারিকেন জ্বেলে দেখি, চাঁদ নেই। রাত আছে। বিষয়-সম্পত্তি বলতে, ভাঙা ডুবোনৌকা। জলে ভেসে গেছে বৈঠা। যেমন ভেসে যায় আমাদের স্বপ্নগ্রাম।
মৃত্যুসংবাদ
আনুমানিক এক বছর, তোমাদের বাড়ির ওদিকে যাওয়া হয় না। পথেঘাটে আগের মত আর দেখাও হয় না আমাদের। এভাবেই ভুলে থাকি বাগানবাড়ি। স্নায়ুর ভেতর পানপতঙ্গের গান। প্লেটোর ব্যর্থতা কি আমাকেও কাঁদাবে সমানভাবে? ঘন বরফের নিচে ঘুমিয়ে আছে আটলান্টিস। চল নামি, পাহাড়ি অন্ধকারে। হাতড়ে চিনে নেই আশ্চর্য সব জন্মদাগ। ততক্ষণে রোদপাখিদের মিশিয়ে দাও স্নানের জলে। শরত শেষে বনপথে দ্রুত নেমে আসে বধিরতা। সন্ধ্যা প্রাক্কালে এই যে বিদ্যুৎতার তাতে কাতর হও। খিদে সেও তো এক মহাপ্লাবনের নাম। কেউ ভেসে যায়। কেউ তর্ক করে। বিবাদে লিপ্ত মানুষের মৌলিক চাহিদা বলে কিছু নেই
DHANSHALIK YOUTUBE CHANNEL : https://