ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ১০


(গত সংখ্যার পর)
‘আমাকেও তো ও কিছু বলেনি।’ রুবী বলে।
‘এই মেয়ে, না বললে কিন্তু বিরিয়ানি পেটে থেকে টেনে বের করব।’ নাজনীন আপা বলে।
‘দিদি, সত্যি আমি তাকে কিছুই বলিনি। বাড়ি থেকে নগরের জন্য ট্রেন ধরব বলে বাবাকে প্রণাম করতে গেছি তখন তাকে কথা দিয়েছি নিজকে রক্ষা করার যোগ্যতা যেন ঈশ্বর আমায় দেন।’
‘ঈশ্বর বেছে বেছে তোমাকে দিয়েছেন। আমাদের দেবেন না।’ মিতালী হতাশ কণ্ঠে বলে।
‘নিশ্চয় দেবেন।’
‘তুমি সঠিক কথা বললে না উর্মিলা।’
মিতালী দিদি উষ্মা প্রকাশ করে।
‘দিদি আমি গ্রামের মেয়ে। শিক্ষা কম। তবে এটুকু কথা দিতে পারি, জাকির সাহেব কেন, কোনও নষ্ট মানুষ এ অফিসের কারো চুল স্পর্শ করতে পারবে না। তাদের গোখ্রা দিয়ে কামড়ে দেব।’ বলতেই উর্মিলা কেঁদে ফেলে। মিতালী দিদি, নাজনীন আপা চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে উর্মিলাকে জড়িয়ে ধরে।
‘ব্রাভো।’
নাজনীন আপা  বলে, ‘পূর্ব জন্মে আমরা এক মায়ের পেটের বোন ছিলাম।’
উর্মিলা অল্পক্ষণ ঢুকরে ডুকরে কাঁদল। মাথা হাতিয়ে বুকে টেনে নিল মিতালী দিদি।
‘যা এখন টেবিলে যা। ভালো না লাগলে বাসায় চলে যেতে পারিস।’
চোখ মুছতে মুছতে মিতালী দিদির রুম থেকে বেরিয়ে আসে উর্মিলা।


১১.

দীপু ভাই এয়ারপোর্ট থেকে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। মা-বোনের সঙ্গে দেখা করার জন্য। ফিরবে তিন দিন পর। বেবী আপা এক ঘণ্টার জন্য অফিসে এলেও উর্মিলার সঙ্গে কথা হয়নি। শিমু দিদি যেন ঝড়, ভীষণ বেগে কথার ফুল ফোটাচ্ছে। সবই ফিলিপাইনের  সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। আর রাস্তাঘাট মানুষ জীবনযাপনের যে বর্ণনা দিচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ফিলিপাইনের অর্থনীতি নিয়ে পিএইচডি করবে। দীপু ভাইয়ের প্রতি অভিযোগের অন্ত নেই। একেবারে মাকুন্দা পুরুষ। সারাক্ষণ সম্মেলনকেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। একটি বাঁকা চোখ দিয়ে নতুন জায়গার কোনো কিছুই দেখার সময় হয়নি। আর বেবী আপাই কেমন! সারাক্ষণ বেচারাকে কাজ দিয়ে রেখেছে। প্রতিনিয়ত ঘ্যানর ঘ্যানর করেও একদিন শপিংয়ে নিতে পারিনি। বলতে বলতে একটি করে রঙ  ম্যাচিং করা লিপিস্টিক ধরিয়ে দেয় অফিসের মেয়ে সদস্যদের। ছেলেদের জন্য একটি করে টাই আর জাকির সাহেবের জন্য পারকার কলম।
‘জানিস, জাকির স্যারকে বললাম আত্মজীবনী লিখতে।  নইলে ভদ্রলোকের এমন অনুকরণীয় চরিত্র সম্পর্কে মানুষ জানবে কী করে?’
‘জাকির স্যারের এখন কোনো কিছু জানার দরকার নেই। দেবী মনসা কখন সুতানলি সাপ পাঠিয়ে ছোবলে নীলাক্ত করে, তা চিন্তা করতে করতে সময় চলে যাবেÑবলে মিতালী সিকদার হাসতে থাকে। শিমু দিদি কিছুই বুঝতে পারে না।
‘উর্মিলা সংবাদ আছে।’ শিমু দিদি বলে।
তাল দেয় মিতালী সিকদার ‘কোনসে সে খবর?’
‘প্লেনে বেবী আপা জিজ্ঞেস করে উর্মিলা কেমন।’
আমি বলি, ‘ওকে থাপ্পড় মারা উচিত।’
বেবী আপা অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কেন?’
‘ওর বেশি মমতা।’
বেবী আপা বলে, ‘মমতা না থাকলে ও মানুষকে নিয়ে ভাববে কখন?’
আমি মনে মনে বললাম, আর হইছে!
‘ঠিক বলিনি উর্মিলা।’ শিমু দিদি উর্মিলার মুখের দিকে স্থির তাকায়।
‘জি ঠিক বলছেন।’ উর্মিলা মাথা  নাড়ে।
‘জি না ঠিক বলিনি। মাতৃকুল বেবী অনেক বিষয়ে তোমাকে যোগ্য মনে করে। আফসোস।’
‘কেন। দিদি।’
‘এই মেয়ে তুমি বুঝবে না।’
শিমু আপা ইত্যাকার বিষয় নিয়ে কলকল করতে থাকে। অফিসের সবাই জানে শিমু বেবী আপার বিশ্বস্ত হাত।
আজ উর্মিলা প্রথম কলেজে যাবে। আজ থেকে ওর ক্লাস শুরু। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই বুক মোচড় দেয়। আজ দীপু ভাই নেই এই শহরে। যে ওর লোকাল গার্জিয়ান। হাহাকার করে ওঠে। এরকম কী ভেবেছে ও।
বেবী আপাকে বলতে হবে। নিজের   ভেতরে অন্যরকম একটা হাওয়া বইতে থাকে। কী মাস! এপ্রিলের ঊনত্রিশ। মধ্য বৈশাখ। গাছে গাছে পাতা ঝরার গান। রবি ঠাকুর বলেছেন, ‘ঝরা পাতা গো আমি তোমাদের দলে।’
হালকা আকাশি রঙের টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি পরে উর্মিলা অফিসে যায়। চুড়ো করে চুল বাঁধা। কপালে লাল খয়েরি টিপ।
ঢুকতেই রুবী বলে, ‘আগুনমুখী?’
উর্মিলা না শোনার ভান করে। উর্মিলা ও রকম।
মিতালী দিদি বলে, ‘হ্যালো নাইস গার্ল? সুইট।’
নাজনীন আপা বলে, ‘কার যে কপাল পুড়বে, কে জানে?’
শিমু দিদি বলে, ‘যাও জাকির সাহেবকে বলে আসো। আমি উর্মিলা। শুভপুর থেকে এসেছি। দেখুন তো আপনার পছন্দ হয়েছে কিনা? শালা বদ।’
‘দিদি আমি কাঁদব কিন্তু।’
‘তুই কাঁদ!
অফিস সুনসান নীরবতা। বেবী আপা এখনও আসেনি।
হঠাৎ উর্মিলার মনে হয় আজ দীপু ভাই কী বলতো!
‘দেবী হেলেন, হঠাৎ করে বঙ্গ ললনা হয়ে গেছেন?  গ্রিক নওজোয়ানদের কী হবে?’
অজান্তেই হাসি পায় ওর।
দীপু ভাইয়ের নায়ক-নায়িকা পুরাণ থেকে উঠে আসে। ওরা সবাই অপ্সরা। প্রিয়দর্শিনী।
সাড়ে বারোটার দিকে বেবী আপা আসে। তার একটু পর পিয়ন দিয়ে ডেকে পাঠায় উর্মিলাকে।
বুকের ভেতর আগের মতো দুরু-দুরু ভাব নেই। যেন বিক্ষিপ্ত বাতাসের পর শান্ত-সমাহিত প্রকৃতি।
উৎফুল্ল চিত্তে বেবী আপার রুমে ঢুকতেই বেবী আপা খুব অবাক নয়নে তাকিয়ে বলে, ‘তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে উর্মিলা।
উর্মিলা লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে বলে, ‘আপা ভালো ছিলেন তো?’
‘ভালো! তবে বয়স বাড়ছে টুকটাক ঝামেলা তো লেগেই আছে।’
‘আপা, আজ আমার কলেজের প্রথম ক্লাস। আপনাকে প্রণাম করতে এসেছি।’
‘প্রিন্সিপাল ডলি আমাকে টেলিফোন করেছিল! কলেজে শুধু পড়াশোনা করবে? কোনো পলিটিক্স না। তোমার পড়াশোনাটাই প্রয়োজন!’
‘জি আপা।’
‘একদিন তো আমাকে মুক্তি নিতে হবে?’
‘কেন?’
‘ও তুমি বুঝবে না। বাবাকে চিঠি লিখে দাও।’
উর্মিলা বেবী আপার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘যোগ্য হয়ে ওঠো। জগত এমনি সুন্দর হয়ে উঠবে।’
উর্মিলা আবেগে কেঁদে ফেলে। বুকে টেনে নিয়ে বেবী আপা বলে, ‘ফ্রাইডেতে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। সময় মতো আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আর এটা নাও। তোমার জন্য। এটা রুবীর।’ দুটো প্যাকেট হাতে নিয়ে বেবী আপার রুম থেকে বের হয়ে দীপু ভাইয়ের রুম ক্রস করতেই ডাক এল, ‘দেবী এদিকে একটু আসতে হয় যে! কত দিন দেখিনি! চোখ খাক হয়ে আছে। ওমা, এ  যে দেবী নীল মেনকা!’
প্যাকেট দুটো টেবিলে রেখে দীপু ভাইয়ের মুখোমুখি বসে উর্মিলা।
‘আহা। আপাই দিয়েছে! আমি বেঁচে গেছি। কিছুই কিনতেও পারিনি। শুধু মা-র জন্য শাড়ি ও আসমার জন্য থ্রিপিস। সময় কোথায়?’
‘আপনার না আগামীকাল আসার কথা।’
‘ছিল। ভাবলাম দেবীর আজ প্রথম ক্লাস।’
‘এত দয়া দেখাবেন না।’
‘দয়া দেখাব কী! ভয়ে আছি।’
‘কেন?’
‘কখন আবার গোখরা দিয়ে কামড়ে দেন।’
উর্মিলা অবাক হয়। এ কথা দীপু ভাইয়ের কাছে পৌঁছে গেছে।
‘ভোটাভুটি হলে তো নির্ঘাত পাস। একমাত্র জাকির স্যারের ভোট পাবেন না।’
‘আপনার ভোট পাব?’
‘আমি ভুজঙ্গদের ভোট দেই না। মমতাময়ীদের দেই।’
‘ও।’ উর্মিলা আদ্রকণ্ঠে বলে ওঠে।
‘আপনি যে সুন্দরীÑতা শাড়ি না পরলে বুঝতে পারতাম না। তা সুচিত্রা দেবী, বাঙালি উত্তম কুমারকে তো মনে রাখেন নাই।’
‘আমি ঢোল নিয়ে বলব, মনে রেখেছি মনে রেখেছি। তাছাড়া মনে রাখার দরকার কী?’
‘ওভাবে বলবেন না। বুদ্ধের মতো গৃহত্যাগী হব।’ দীপু ভাই মৃদু হাসে।
‘সে সুযোগ নেই। মা-আসমা আপনাকে ছাড়বে কেন?’
দীপু ভাই উদাস হয়ে যায়! পিনপতন নীরবতা। উর্মিলা বুঝতে পারে দীপু ভাইয়ের ক্ষতস্থান আঁচড়ে দিয়েছে কেউ।
‘আমি বুঝতে পারিনি। ক্ষমা করবেন।’
উর্মিলা হাত জোড় করে।
‘না না আপনি ঠিক বলেছেন। ওরা আমাকে ছাড়বে কেন?’ দীপু ভাইয়ের কণ্ঠ আর্তনাদের মতো শোনায়। উর্মিলার নিজেকে তিরস্কৃত করতে ইচ্ছে করে। নিজেকে পাপিষ্ঠ মনে হয়। একটি প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে দীপু ভাই বলে, ‘কিছুই কিনিনি। সময় ছিল না। মা-র আসমার জন্য ঢাকায় এসে কিনেছি। আপনার এবং রুবীর জন্যও তাই।’
‘দরকার ছিল না।’
‘ছিল।’
‘আপনি কলেজ পর্যন্ত আমার সঙ্গে যাবেন?’
‘না।’
‘কেন?’
‘বেবী আপা বারণ করেছে।’
‘ও।’
‘অন্য কিছু ভাববেন না। বলেছে, উর্মিলাকে একা একা হাঁটতে দাও।’
‘ও।’ বলেই উঠে পড়ে উর্মিলা।
গিফটের প্যাকেট বগলদাবা করে রুম থেকে বের হয়।
মিতালী দিদি উচ্চস্বরে বলে, ‘আমি কেন উর্মিলা হইলাম না।’

তিনটের মধ্যে বাসায় ফেরে। পাঁচটার মধ্যে কলেজে ঢুকতে হবে। রুবীর গিফট প্যাকেট ওর বিছানায় রেখে নিজের প্যাকেট খুলে ভয়ানক অবাক হয় উর্মিলা। বেবী আপা দিয়েছেন, পাইলট ভি কলম আর একটি লেদার মোড়ানো ডায়েরি। সাথে ছোট একটি চিরকুট। তাতে লেখা রয়েছে, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো তারিখ দিয়ে  লিখে রাখবে।’
দীপু ভাই দিয়েছেন, কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’, কবি আবুল হাসানের ‘রাজা যায় রাজা আসে’, কাব্যগ্রন্থ। কবিতার সাত-পাঁচ না বুঝে আবুল হাসানের কবিতা পড়তে থাকে, সে এক পাথর আছে  কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র, মায়াবী করুণ... (চলবে)

DHANSHALIK YOUTUBE CHANNEL : https://www.youtube.com/channel/UCvalpdS1Kp_2lW5-Qibzzpw

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট