আনন্দ আগুনে







আনন্দ আগুনে
জুয়েল আশরাফ

ডাঃ সোনিয়া খানম ব্যস্ত ভঙিতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। একজন নার্স কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে বললেন, শায়লা দরজাটা খোলো।
     শায়লা দরজা খুলে সরে দাঁড়াল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি অবস্থা?
     -অবস্থা ভাল হয় নি ম্যাডাম। একই রকম।
     ভেতরে আবছা অন্ধকার। তিনি ভেতরে ঢুকতেই তীব্র একটা সুগন্ধ পেলেন। গন্ধটা নাকে এসে ধ্বক করে লাগল। এই কেবিনে কোথাও আতরের একটা কৌটা আছে। শায়লাকে বলতে হবে গন্ধময় কৌটা খুঁজে বের করে এনে ফেলে দিতে। তীব্র সুগন্ধ ছড়ায়- এমন কিছুই মেয়েরা সহ্য করতে পারে না। তিনিও পারেন না। অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিশ্বাসের সঙ্গে আতরের গন্ধে পেট ভরে উঠল। এই ঘরটাকে দিনের বেলাতেও আবছা অন্ধকার করে রাখা হয়েছে। আলোতে রোগির ঘুমের অসুবিধা। তিনি জানালা একটু ফাঁক করে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় শুয়ে থাকা অসুস্থ কিন্তু অসম্ভব রূপবতী মেয়েটা ক্ষীণ গলায় বলে উঠল, কে?
     গলার স্বর পরিস্কার। শরীরে এত বড় যন্ত্রণা নিয়ে মেয়েটা শুয়ে আছে বোঝার উপায় নেই। তিনি ছোট্ট আওয়াজে বললেন, আমি।
     -ওহ্ ডাক্তার ম্যাডাম! আমি ভাবলাম কে না কে!
     ডাঃ সোনিয়া বিছানার কাছে এগিয়ে এলেন। মেয়েটার বুকের ওপর থেকে চাদর সরাতে যাবেন ঠিক তখনই তীব্র গন্ধটা নাকে এসে লাগল। আতর না, মেয়েটার শরীর থেকেই একটা সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।
     -কেমন লাগছে এখন?
     -ভাল না।
     তিনি রূপবতী মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেন। অসুস্থ চেহারার রূপবতী মেয়েটা হাসছে। দেখে ভারী মায়া হচ্ছে।
     মেয়েটা ঘোলাটে চোখে সোনিয়া খানমের দিকে তাকাল। বলল, এখনও আসে নি কেউ তাই না?
     -চিন্তা করো না। এসে যাবে সবাই।
     -আমি জানি কেউই আসবে না।
     -আমি তোমার বাসায় ফোন করেছিলাম, কেউ ধরছে না ফোন। দুজন লোক দিয়ে খবর পাঠালাম আজ সকালে। কেউ তো একজন এসে যাবে খুব শীঘ্রই।
     মেয়েটা কিছু বলল না। ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে রইল শুধু। সোনিয়া খানম মায়া গলায় বললেন, এসে যাবে মা। চিন্তা করো না।
     মেয়েটা এবারেও কিছু বলল না। চোখ বুজে ফেলল।
     -বুকে ব্যথা হচ্ছে?
     - ব্যথা তো নেই।



     সোনিয়া খানম অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ব্যথা নেই?
     মেয়েটা বলল, নেই। এই কদিন মনে হয়েছিল বুকের ভেতরে পেট্রোল ঢেলে কেউ আগুন জ্বালিয়েছে। এখন ভেতরটা শীতল লাগে। আরাম পাই খুব।
     সোনিয়া খানম মেয়েটার বুকের উপর হাত রাখলেন। মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। জিজ্ঞেস করল, আমি বাঁচব না তাই না ডাক্তার ম্যাডাম?
     সোনিয়া খানম বললেন, একথা বলছো কেন? ইনশাআল্লাহ তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে।
     -আমার ভাগ্যে যদি লেখা থাকে আমি সাতদিনের ভেতর মরে যাব আপনার ‘ইনশাআল্লাহ’ বলা দিয়েও আমার মৃত্যুকে আটকাতে পারবে না ডাক্তার ম্যাডাম।
     -সব ঠিক হয়ে যাবে।
     -আমার ঠিক হবে না। আমি মারা যাব।
     -মারা যাবে?
     -হ্যাঁ মারা যাব।

     সোনিয়া খানম চুপ হয়ে গেলেন। মেয়েটি আবার চোখ বুজল। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ছোট্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কত অপূর্ব মেয়ে! কী সুন্দর মুখ। অথচ তার সমস্ত শরীর আগুনে ঝলসে গেছে। কী করে পারল পাষ- স্বামী পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে প্রেমিকার প্ররোচনায় স্ত্রীর শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে!
     মেয়েটি তাকাল। সোনিয়া খানম বললেন, তোমার কি কিছু লাগবে?
     -না।
     -কিছু না?
     -আমাকে কোরআন থেকে একটা আয়াত শোনান। আমার খুব খারাপ লাগছে।
     -কোন আয়াত শোনাব?
     -অসুখের সময় যেই আয়াত শুনলে ভাল লাগবে।
     সোনিয়া খানম ইতস্তত করে বললেন, এরকম কোন আয়াত আমার জানা নেই। আমার অন্য একটা আয়াত মুখস্থ আছে। সেটি শোনাই?
     -শোনান।
     -আয়াত শোনার পর তুমি বিশ্রাম করবে। তোমার বাড়ির লোকজন আসলেই তোমাকে খবর দেব।
     -আচ্ছা।
     -আল্লাহ তায়ালার এরশাদ,-আচ্ছা বলত দেখি, তোমরা (নারীর গর্ভে) যেই শুক্রবিন্দু পৌঁছিয়ে থাকো তা থেকে তোমরাই মানুষ বানাও নাকি আমিই সৃষ্টিকারী? আল্লাহ তায়ালার এরশাদ,-আচ্ছা তবে বলত দেখি, জমিনে যে বীজ তোমরা বপন করে থাকো, তা কি তোমরাই অঙ্কুরিত কর নাকি আমি তার অঙ্কুরণকারী?
     সোনিয়া খানম আস্তে আস্তে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। দরজার কাছে শায়লা দাঁড়িয়ে ছিল। সে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা কি বাঁচবে না ম্যাডাম?
     -জানি না।
     -বাঁচাবার কি কোনো ব্যবস্থা নেই?
     ডাঃ সোনিয়া খানম একথার জবাব দিলেন না। তাঁর কাছে শুধু মনে হলো-মেয়েটা যদি বেঁচেও যায় একদিন না-একদিন আবার তো তাকে মরতেই হবে। তারপর তিনি ছোট্র একটা ভারী শ্বাস ছেড়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে মনে বললেন- ইন্না ইলায়না ইয়া বাহুম (নিশ্চয়ই আমার নিকট তারা সবাই ফিরে আসবে)।




রূপা চুপচাপ শুয়ে আছে। সাদা একটা চাদর তার গলা পর্যন্ত ঢেকে দেয়া আছে। বুকটার ভেতর কেমন অসাঢ় লাগছে। প্রথম কয়দিন অসহ্য যন্ত্রণা ছিল, তারপর হঠাৎ করে যন্ত্রণা কমে এসেছে বুকে। যেখানে একসময় প্রচন্ড যন্ত্রণা ছিল সেখানে এখন এক ধরনের ভোঁতা অনুভূতি। মাঝে মাঝে বুক আছে কী নেই বোঝা যায় না। মনে হয় বুকটা মরে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ শ্বাস নিতে কষ্ট হলে তখন মনে হয় বেঁচে থাকার আর বুঝি কোন আশা নেই।
     রূপা চোখ মেলে তাকাল। ঘরের ভেতর কেউ নেই। দিনেরবেলা আবছা একটা আলো থাকে এই ঘরে। জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে সরু হয়ে আলো পড়ে বিছানার উপর। সেই আলোতে সাদা চাদর ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। শুয়ে শুয়ে মানুষজনের পায়ে হাঁটার শব্দ শুনতে পায় সে। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে কেউ ফিস ফিস করে কথা বলছে। মনে হয় তার আপনজন কেউ এসেছে তাকে দেখতে। পরক্ষণেই আবার সব চুপচাপ। রাত্রিবেলা ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে। চোখ বুজে রাখলেও বোঝা যায় না চোখ বন্ধ আছে কী নেই। মনে হয় সবকিছু সে চোখ বুজেই দেখতে পাচ্ছে। চারদিক অতিরিক্ত নীরব হয়ে আসে। শুধু তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
     এরই ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে আজ বেশ কটা দিন। মাঝে মাঝে সে অজ্ঞানের মত পড়ে থাকে। কখনো জেগে থাকে, কখনো অচেতন থাকে, কখনো ঘুমিয়ে-না ঘুমিয়ে। দিনরাত, সুখ দুঃখ আলাদা করে অনুভব করার ক্ষমতা হারাতে যাচ্ছে সে। সবকিছু কেমন একাকার।
     রূপা আবার চোখ খুলে তাকাল। হঠাৎ পানির পিপাসা হচ্ছে খুব। গলা শুকাতে শুকাতে শুকনো কাঁঠ হয়ে যাচ্ছে। মাথার কাছে পানির জগ। কিন্তু হাত বাড়িয়ে পানি নিতে ইচ্ছে করছে না। সে পানির জগটার দিকে মুগ্ধ হবার মতো দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকল-যেন এই মাত্রই তাকে কেউ পানি পান করিয়েছে।


     যখন কোন মানুষের উপর আল্লাহপাক খুশী হয়ে মৃত্যুর ফেরেশতাকে আদেশ করেন অমুকের রূহ নিয়ে আসো, তখন মৃত্যুর ফেরেশতা নিজের সাথে পাঁচশত ফেরেশতার একটা জামাত নিয়ে সেই মানুষটির কাছে হাজির হয়। প্রত্যেক ফেরেশতা সেই মানুষকে নতুন নতুন সুসংবাদ শোনাতে থাকে। প্রত্যেক ফেরেশতার সুসংবাদগুলি হয় আলাদা আলাদা, যা অন্য ফেরেশতা দেয় নি। তাদের কাছে রায়হান ফুলের ডাল ও জাফরানের শিকড় থাকে। ফেরেশতারা দুই কাতারে লাইন করে দাঁড়িয়ে যায়।
     ফেরেশতাদের নিকট জান্নাতের কাফন থাকে আর প্রত্যেকের হাতে রায়হানের ফুলদানি হয় এবং প্রত্যেক ফুলদানিতে বিশ প্রকার রঙ হয়। আবার প্রত্যেক রঙয়ে নতুন নতুন খুশবু হয় এবং একটা সাদা রুমালের মধ্যে মেশকের তীব্র সুগন্ধি ছড়াতে থাকে। আজরাঈল (আঃ) তার মাথার দিকে বসে ও ফেরেশতাগণ চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে ও মেশকওয়ালা সেই রুমাল তার থুতনির নিচে রাখে এবং জান্নাতের দরজা তার চোখের সামনে খুলে দেয়া হয়। তার মনকে জান্নাতের নতুন নতুন জিনিস দিয়ে প্রলোভন দেয়া হয় যেমন কান্নার সময় বাচ্চার মনকে প্রলোভন দেয়া হয়। কখনও জান্নাতের বাগানসমূহকে দেখানো হয়। আবার কখনও সেখানের ফল ফুল এবং পোষাক পরিচ্ছদকে দেখানো হয়। জান্নাতের বালকগণ তার সামনে আনন্দে নাঁচতে থাকে। এই সব দৃশ্য দেখে তার রূহ শরীর থেকে বের হবার জন্য এমনভাবে ছটফট করতে থাকে যেমন খাঁচার মধ্যে পাখি ছটফট করে থাকে। এবং হযরত আজরাঈল (আঃ) তাকে বলে- হে মোবারক রূহ! কন্টকবিহীন ফুল এবং থোকা থোকা ফল ও লম্বা লম্বা ছায়া এবং প্রবাহিত পানিওয়ালা জান্নাতের দিকে চলো।
     মৃত্যুর ফেরেশতা আল্লাহর কাছে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যে সেই রূহের সাথে খুব নরম ব্যবহার করেন যেমন ব্যবহার মা বাচ্চার সাথে করে থাকে। তারপর সেই রূহ শরীর থেকে এত সহজে বের হয়ে পড়ে যেমন আটা থেকে পশম বের করে ফেলা হয়।

ডাঃ সোনিয়া খানম আলো জ্বেলে রূপার তাকানোর ভঙি দেখেই চমকে উঠলেন। হাত বাড়িয়ে রূপার কপাল স্পর্শ করে দেখলেন তার শরীর শীতল। সাথে সাথে হাত সরিয়ে বিড় বিড় করে বললেন, ইন্না লিল্লাহি...।
     শায়লা মৃদু গলায় বলল, মরে গেছে?
     -হ্যাঁ।
     -তাকিয়ে আছে কেমন করে!
     -চোখদুটি বুজে দাও শায়লা। মৃত মানুষের চোখ বন্ধ করে দিতে হয়।
     শায়লা চোখ দুটি ঢেকে দিতে গিয়ে থেমে গেল। মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো আনন্দিত চোখে সে কিছু একটা দেখছে।
 নবাবগঞ্জ, ঢাকা।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট