পদাবলি : ০১







যৌবনের গান
তমসুর হোসেন

যৌবনের দুরন্ত আবেগে ব্যথাদীর্ণ হৃদয় আর ঘুমহীন যাতনায়
একটা গান লিখেছিলাম
যে গানের কথাগুলো তরঙ্গিত নদীর মত ছিল ছন্দময়
সবার কাছে তা বড় ভাল লেগেছিল।
এক মরমী সুরকার গভীর ব্যঞ্জনায় সেই সুক্তিশুভ্র বাণীগুচ্ছে মেখে দিয়েছিল
যাদুকরী সুরের আল্পনা।

সেই ক্ষণজন্মা গান এতটা প্রচার পেয়েছিল যে রাতারাতি হয়ে পড়েছি
প্রখ্যাত গীতিকার
আর সেই নবীন সুরকার সবার অন্তরে করে নিয়েছে আপন ঠিকানা
মুখে মুখে সেই গানের প্রচার এতটা ব্যাপক হয়েছিল যে
সাগর-দ্বীপের শৈবাল স্তুপে এনেছিল নিশব্দ মসৃণ দ্রুতি
অসংখ্য সাদা চিল ঝাঁক বেঁধে ওড়েছিল সুদীর্ঘ সৈকতে।

বহুদিন পর, জীবনের রুক্ষ খরতাপে হারিয়ে ফেলেছি সে সুমধুর গান
সেই প্রবালশূভ্র বাণীমঞ্জুষার সন্ধান পেতে হাঙ্গরক্ষীপ্র তরঙ্গ আর ঝড়ো বাতাসকে
অনেক অনুনয় করেছি বারবার,
বিগলিত অশ্রু মিশিয়ে অসংখ্য পত্র লিখেছি নিরালা নক্ষত্রকে
আমার মিনতিমাখা দৃষ্টির সম্মুখে থেকেছে তারা নিথর নিরুত্তর।

শুধু এক নাম না জানা পাখি হতাশার মরুঝড়ে সুখের স্বপ্ন হয়ে
আমার বুকে ঢেলেছে বিপুল সান্তনা।



নিখোঁজ হৃদয়ের প্রতি সমালোচনা
নিঃশব্দ আহামদ


একটা হৃদয় থাকে, কখনো সে ভিজে আমি অনুভব করি স্রোতের মতো তাজা রক্তে,
ক্ষরণে এবং দাগে-কখনো উষ্ণ হয়,
কাম-তাপ রসায়নে আর সে হৃদয়খানি জুড়ে থাকে সম্মোহন; ঠিক বলি যাকে প্রেম

কখনোবা ভাঙে, বিচূর্ণ কিনা ঠিক কাঁচ চূর্ণরূপ
অথবা ধপাস শব্দে পতিত যে পাত্রটিরও অবশিষ্টাংশ কাজে লাগানো ভার,
এমনো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া হৃদয় এক আমার, ধড়ফড় রোজ মরে যায়

না পাখা নেই, তবু উড়াউড়ি বিরান -
হারায় উদ্দেশ, নিরূদ্দেশ কোনো হৃদয়
ঠিক আরও কোনো হৃদয়ের ছোঁয়া পেতে হলে মরিয়া
উড়তে থাকে ব্যথায়, যখন কোনো মানুষ থাকে অধরায়

মানুষের একটা হৃদয় থাকে শুনি, বন্ধু এবং প্রেমিকারও
সময় ফুরোয়, আরও আরও আগামি দখলে ব্যস্ততায়
নাহ বন্ধু নেই, না কোনো প্রেমিকা-শুধু একা
শুধু সময়টুকু নাড়ায় হৃদয় অতঃপর, অথচ সবখানে দ্যাখে গেলাম কেবল অভিনয়

হৃদে হৃদে লাগুক জোড়া, হায়! ভাঙন না এতোটা আর
মৃত্যুসম শোক বাজে হৃদে, কে শুনিবে কান পেতে বুকে আমার





সম্পর্কের কুয়াশায়
শম্পা মনিমা

আলিঙ্গনের শীত দীর্ঘ হয়, উত্তাপ কমে,
বাতাস গড়ায় বিষন্ন নির্যাস, এটা কোন মাস?

দূরের রাস্তায় হেঁটে একটা বাড়ি
কাছাকাছি থেকেও এখানে পৌঁছায়নি, বিস্মৃতি?

স্বপ্নচাষী একা একা যাত্রী
এখন একলা ঘরে নেই কেউ, তবে কি সর্বনাশী?

উদম আকাশ, মরে গেছে কাশফুল, কাঁটার গোলাপ
কিসুখে ছিল দেহ, ছিল মমতার বাস, শুধু মাত্র অনুতাপ?

কুয়াশার চরে ঘোরে গমনের নেশা
কানে কানে কে যেন বলে, অতীত তিথি, চলে খেয়া




কাজী রুপাই 
স্মৃতি হাঁস

ডানার ভিতরে এক নিশিন্দা ডাহুক সন্তর্পণে
ঘাসের স্তাবক ভেঙে উড়ে যায় গাঙুড়ের জলে
আমার পান্ডুর বোধে ঝিঝির আকন্ঠ জলাশয়ে
জীবনের বনোগন্ধে স্নেহসিক্ত। নৈসর্গের মোহে

ধানের বিনম্ভ্র স্নেহে কাদামাখা আমার সমগ্র
রূপকথার আঘ্রাণ। পালতোলা নৌকোর শিথানে
মস্যগন্ধা আষাড়ের বাউলিয়া বাতাসের শিষ
মৃত্তিকার রক্তবীজে নক্ষত্রের নিভৃত সাঁতার-

আধাঁরের গলিপথে জোনাকীর গার্হস্ত্য স্লোগান
জোছনার নগ্নস্নানে রাতজাগা আজন্ম কামনা
জেগে উঠে পৃথিবীতে। ওহে শব্দভেদী শব্দহাঁস-
আমার মৃত্যুর শেষে বাউন্ডেলে শালিখের রূপে;

পৃথিবীর ঝাউবনে উড়ে যাক আমার বিশ্বাস
যেখানে একটি শিশু বুনিয়াছে বোধের বিস্ময়
আর বিস্ময়ের স্থির স্রোতে-প্রজাপতি আহবানে
প্রকৃতির গদ্যেপদ্যে ভাসুক অজস্র স্মৃতিহাঁস।




দু’টি কবিতা
অনিন্দিতা মিত্র


হাত বাড়ালেই সাঁকো  

বেলা চলে যায় নিজের নিয়মে, ভেসে যায় বেদনাহত স্মৃতির ঝড়। মধুবনী নকশায় সেজে ওঠে রাত জোনাকির মালায়। সাঁঝ নামে বারুদের গন্ধ মেখে, দূর ধানের খেত থেকে উঠে আসে গোঙানি, প্রিয়তমকে ছেড়ে তুলসীমঞ্চে জল দেয় কৃষাণী। সবার ঘরে ফেরা হয় না, ফেরে লাশ। হিম জমে কান্না হয়, শোকে পাথর হয় প্রিয়তমা। সুখ উড়ে যায় পরিযায়ী পাখি হয়ে। মেঘশূন্য আকাশের খেলা করে রকমারি রঙের কোলাজ। মিছিল নামে রাজপথে, চাপ চাপ রক্তের দাগ নিয়ে চলে লেনদেন। শান্ত কবরে এসে দাঁড়ি টানে জীবন, দূর থেকে আরো দূরে চলে যায় সমাজ সংসার প্রিয়জন। অন্ধকারের পরতে পরতে শুধু বিক্ষোভ।  হাও বাড়ালেই সাঁকো, দেখছি শুধু ছুঁতে পারছি না।



বিষাদের কাব্যকথা  

প্রতিটি ভোরের জন্মদিনে উচ্চারিত হয় প্রেমের সংলাপ, ছবিগুলো ছায়াহীন, হারিয়ে যাচ্ছে শোকের মাঝে। আহত শিশিরের কণা খোঁজে বৃষ্টিমুখর বসন্তের দিন । বরফ জমে মাঠে ঘাটে, খালবিলে, পাথরের মত শক্ত হয়ে যায় বুকের তল। ঝরে পড়া লাল-হলদেটে ম্যাপেল পাতা উড়ে যায় দুরন্ত ঝড়ে। থেমে যায় সব কোলাহল এক মূহুর্তে, সমুদ্রের নীল নাভি থেকে খসে যায় সব দৈনিক চঞ্চলতার, বিষাদের ঝিনুক পায় প্রসব যন্ত্রণা, সমস্ত আর্তনাদ চাপা পড়ে যায় অলস রোদ্দুরের ভাঁজে ভাঁজে ।                   






শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট