এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ : নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু






এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু

বটু কৃষ্ণ হালদার

“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ” সেলুকাসের বিচিত্র দেশে সত্যিই এক মৃত্যুহীন প্রাণের নাম নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। সবার প্রথমে বলবো এই বঙ্গবীর কে নিয়ে নোংরা রাজনীতি বন্ধ করা হোক। তিনি কোন মানব চরিত্র ছিলেন না। তিনি আসলে একটি একক অস্তিত্ব। তিনি এমন এক মহামানব চরিত্র ছিলেন, যে দেশ ও বাংলার স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে এমন কোনো ইস্যুতে আপোষ করেননি কখনো। স্বদেশী আন্দোলনের মন্ত্র হিসাবে “বন্দেমাতরম” গানটি প্রথম জনপ্রিয় হয় ১৯০৫ সালে। অরবিন্দ ঘোষ নিজের রাজনৈতিক পত্রিকার নাম দিয়েছিলেন এই গানটির নামে। তার পত্রিকার নাম রেখেছিলেন “বন্দেমাতরম”। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সুর দিলেন সেটি প্রথমবার গাওয়া হয় ১৯০৫ সালে বেনারস কংগ্রেস অধিবেশনে। গানটি গাইলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নি সরলা দেবী চৌধুরানী। ঠিক সেই বছর তামিল কবি সুব্রমনিয়াম ভারতী গানটি কে তামিলে অনুবাদ করলেন, সুরও দিলেন অন্যরকমভাবে। পৃথকভাবে গান টি গাওয়া হলো তেলুগু, কন্নড়, গুজরাতি আর হিন্দিতে। কিন্তু সমস্যা হল ১৯৩৭ সালে রাজ্যে কংগ্রেস সরকার গঠিত হওয়ার পর। কোন কোন সময়ে “বন্দেমাতরম” গাওয়া শুরু হলো সরকারি অনুষ্ঠানে। এতে ভীষণ রকম আপত্তি করলো মুসলিম লীগ। বিধানসভার এক মুসলিম লীগ সদস্য সরাসরি বললেন  এই গানটি “ধহঃর-সঁংষরস”। কিছুদিন পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজে ঘোষণা করলেন, বন্দেমাতরম মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা থেকে রচিত হয়েছে। শুরু হয় দেশজুরে বিতর্ক। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের উপর প্রবল চাপ, তাহলে কি আর গানটা গাওয়া হবে না? দ্বিধায় পড়ে গেলেন সকলেই, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, নেহেরু কে ডেকে বৈঠক করলেন গান্ধীজি, কিন্তু সমাধানসূত্র সামনে আসছে না। কারণ সে সময়ে পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছেনা। ঠিক তখন একটি চিঠি এলো গান্ধীজীর কাছে , তাতে সুভাষচন্দ্র বসু লিখেছেন, “আমাদের রাজ্যে বিশেষভাবে (হিন্দু সম্প্রদায়) বন্দেমাতরম  নিয়ে এই বিতর্কে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কংগ্রেসের অধিবেশনে বন্দে মাতরম কে  কোনভাবে বন্ধ করার চেষ্টা যেন  করা না হয়, তাহলে এ রাজ্যের যে সমস্ত হিন্দু মনেপ্রাণে প্রস্তুত প্রতিবাদে সামিল হতে পারে। তাই বন্দেমাতরম কে নিষিদ্ধ করার সামান্যতম পদক্ষেপ গ্রহণের আগে অন্তত একশ বার চিন্তা করতে হবে“। সুভাষচন্দ্র একাই নন, সমাজসেবী সতীশ দাশগুপ্ত গান্ধীজিকে বলেন সুভাষচন্দ্র ঠিক বলেছেন। এর সঙ্গে কোন হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক নেই। জন্মভূমির প্রতি সন্তানরা  মাতৃ ভূমিকে বন্দনা করেছে এই গানে, তাই নেতাজির চাপে বন্দেমাতরম কে প্রদেশ সরকারগুলি বাধ্য হয়েছিল স্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে।




“তোমরা আমার রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব, এই ছিল তোমার উক্তি/ভারত বর্ষ স্বাধীন হলেও মিলেছিল কি তোমার যুক্তি? না নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমীর যুক্তি মেলেনি। যে অখন্ড ভারত গড়ার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সে স্বপ্ন আজও অধরা। ১৮৯৭ সালের ২৩ শে জানুয়ারি বঙ্গবীর নেতাজি সুভাষ  আলো করে এসেছিল প্রভাবতি দেবীর কোলে। উড়িশ্যার কটক শহরে জন্ম  গ্রহণ করেন অভিজাত বোস পরিবারে। পিতা কটক প্রবাসী বিশিষ্ট আইনজীবি জানকি নাথ বোস ও মাতা মাতা প্রভাবতীদেবীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম। পৈতৃক নিবাস দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষ গ্রামের কোদালিয়া নামক স্থানে। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সুভাষ কটকের ইংরেজি স্কুলে পড়াশুনা করেন, যার বর্তমান নাম “ঝঃঁধৎঃ ংপযড়ড়ষ”।এর পর তাকে ভর্তি করানো হয় কটকের রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯১১ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কলকাতা থেকে প্রথম স্থান দখল করেন।১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শন এ  সন্মানিক সহ বি. এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি গর্বের পাত্র ছিলেন তার পরিবারের কাছে তথা ভারতবর্ষের কাছে। এর পর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিউজ উইলিয়াম হলে উচ্চ শিক্ষার জন্যে ভর্তি হোন। সেখানে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পত্র পান ব্রিটিশ দের অধীনে। ১৯২১ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আই সি এস ত্যাগ করেন। তিনি সেই চাকরী করেন নি। মনে প্রাণে ব্রিটিশ দের ঘৃণা করতেন। পরাধীনতার আগুন বুকে নিয়ে ফিরে আসেন দেশে। দেশে ফিরে চুপ করে বসে থাকেন নি। দেশ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। একটাই মন্ত্র বুকের মাঝে নিয়ে ঘুরতে থাকে প্রান্তে প্রান্তে। দেশ মাতৃকা কে মুক্তি দিতে হবে ব্রিটিশদের বন্ধন থেকে। মায়ের চোখের জল মুছে দিতে যে কোনও মূল্য দিতে প্রস্তুতি হন। তিনি আর্ত, পীড়িত, অসহায় মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে পাড়ি দেন দূর দূরষন্তরে। পৈতৃক অর্থ সম্পদ, বিলাস, বহুল, আড়ম্বরের জীবন তাকে বেঁধে রাখতে পারে নি। ব্রিটিশদের অত্যাচার, অনাচারে অসহায়, নিপীড়ন মানুষের ডাকে তিনি নেমে পড়েন স্বাধীনতা আন্দোলনে।এই সময় তিনি ঘোষণা করেন “কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া” দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষিত হোন। দেশকে স্বাধীনতা দেবার লক্ষতে অবিচল হয়ে পড়েন। যে কোন মূল্যের বিনিময়ে ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে দেশ কে মুক্ত করাই তার জীবনের অন্যতম স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়।



সেই সময় অমৃতসর হত্যা কান্ড ও১৯১৯ সালে দমন মূলক রাওলাট আইন ভারতীয় জাতীয়বাদিদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। নেতাজি ভারতে ফিরে “স্বরাজ” নামক সংবাদ পত্রে লেখা লেখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচার দায়িত্বে নিযুক্ত হোন। শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবন। তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদ এর প্রবক্তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯২৪ সালে দেশ বন্ধু যখন কলকাতা পৌর সংস্থার মেয়র নির্বাচিত হোন তখন তিনি তার অধীন কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ বিরোধী চক্রান্ত মূলক কার্য কলাপএর জন্যে তাকে বন্দি করা হয় এবং মষন্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়ে ছিল, এখানে তিনি যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
সুভাষ বোস ছিলেন একজন ধর্ম প্রাণ হিন্দু। তিনি ধ্যানে অনেক সময় অতি বাহিত করতেন। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। সুভাষের যখন পনের বছর বয়েস হঠাত তখন তার হাতে এলো বিবেকানন্দের রচনাবলী, এটা “বিবেকের পুষ্টি ও আত্মতুষ্ট” বলা টা শ্রেয় হবে। বিবেকানন্দ ইতি মধ্যে শিকাগোয় মহাধর্ম সম্মেল নে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বৈদিক হিন্দু সভ্যতার নব মূল্যায়ন করেছেন সর্ব সম্মুখে, সভায় উপস্থিত সমস্ত গুণী জন তথা সভার সদস্য গণ গুণ মুগ্ধতা প্রকাশ করেন, এবং ফলস্বরূপ  বিবেকানন্দর নাম  সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের দর বারে। কিন্তু  হঠাত তার অকাল প্রয়াণে সমস্ত উজ্জ্বল ভাব মূর্তি ম্লান হতে থাকে। তার বাণী হাজার হাজার, লাখ লাখ তরুণ তরুণী কে প্রভাবিত করেছিল, সুভাষ বোসের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম ঘটলো না, তিনি অত্যন্ত বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার সহিত বিবেক রচনাবলী অধ্যয়ন করলেন। তিনি তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, বুঝতে পারলেন কিভাবে জীবনকে গড়ে তোলা উচিত। আত্মা দিয়ে উপলব্ধি করলেন “সেবা” ই হল আসল ধর্ম জীবন মুক্তির আসল উপায়। সেবা করতে শুরু করেন উৎপীড়ন, নিপীড়ন, শোষিত মানুষ গুলোর। সুভাষ বোস বিভিন্ন গ্রন্থষগারে গিয়ে বিবেক রচনাবলী ও অন্যান্য খন্ড গুলি সংগ্রহ করতে থাকেন। তিনি উপলব্ধি করেন রাজনীতিকে আধ্যাত্মিক চেতনার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। তা না হলে রাজনৈতিক দর্শন তত্ব পরম শুদ্ধ ও বৌদ্ধক জ্ঞান সম্পন্ন হতে পারবে না। সুভাষ এর বয়স যখন সতেরো তখন তিনি ছাত্রবস্থায় দেশ প্রেমিক সত্তষর জন্যে পরিচিত হয়েছিলেন। তার ২০ বছর রাজনৈতিক জীবনে তিনি প্রায় ১১ বার গ্রেফতার হয়েছিলেনাকে ভারত ও রেঙ্গুন এর বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল।১৯৩০ সালে তাকে ইউরোপে নির্বাসিত করা হয়। তার পিতার মৃত্যুর পর ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের উদ্দেশে কিছু ক্ষণ এর জন্যে কলকাতায় আসার অনুমতি পায়।



সুভাষ বোস দুই বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রথম ১৯৩৮ সালে হরিপুরা অধিবেশনে। তবে সেখানে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তার মত বিরোধ হয়। গাঁধী অহিংসা ও ভিক্ষা নীতির মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা লাভের পক্ষে ছিলেন। নেতাজি এর বিপক্ষে ছিলেন। তাই দ্বিতীয় বার জাতীয় কংগ্রেস নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৮ সালে ত্রিপুরা অধিবেশনে। এই নির্বাচনে গাঁধী পট্টভি সীতা রামায়াকে সমর্থন করেন। তিনি নেতাজি সুভাষ বোস এর কাছে হেরে যান। মহাত্মা গাঁধী বিচলিত হয়ে পড়েন এবং বলেন এই হার আমার ব্যাক্তিগত। সভাপতি হয়ে সুভাষ কিন্তু সুষ্ঠু ভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারছিলেন না। গাঁধীজির অণুগামীরা তার কার্য তে বাধার সৃষ্টি করছিলেন। গোবিন্দ বল্লভ পন্থ এই সময় একটি প্রস্তাব পেশ করেন যে, “কার্য নির্বাহক পরিষদকে পূর্নগঠন করা হোক”। এই নির্বাচন এ জয়লাভ করা সত্যে ও গাঁধীর বিরোধিতার ফল স্বরূপ তাকে পদত্যাগ এ বাধ্য করানো হয়। তিনি পদত্যাগ করেন  এবং১৯৩৯ সালে ই ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন করেন।
উল্লেখ্য, কংগ্রেস কমিটি যেখানে অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাস এর পক্ষে মত প্রদান করেন, সেখানে সুভাষ চন্দ্র প্রথম ভারতে পূর্ন স্বাধীনতার পক্ষে মত প্রদান করেন।এক্ষেত্রে জওহরলাল নেহেরু সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দরা তাকে পূর্ন সমর্থন করেন। শেষ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ন স্বরাজ মতদান গ্রহণে বাধ্য হন। এমত অবস্থায় কংগ্রেস নেতৃবর্গদের ব্যর্থতায় ভগত সিং এর ফাঁসির বিরুদ্ধে গাঁধী থআর উইন চুক্তির বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। নেতাজিকে কারারুদ্ধ করে, ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধ ভেঙে ভারতে এলে তাকে আবার কারারুদ্ধ করা হয়। উল্লেখযোগ্য, যে যদি নাথু রাম গডসে ১৯৪৮ সালে গাঁধী জি কে হত্যা না করে ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হত্যা করতেন হয়, তো ভগত সিং কে শহীদ হতে হত না। ভগত সিং এর ফাঁসির সাজা ঘোষণা হতেই চন্দ্রশেখর আজাদ গাঁধীর কাছে ছুটে যান গোপনে, কিন্তু গাঁধী স্পষ্ট করে বলে দিলেন সন্ত্রাসবাদীদের সাথে তার কোনো যোগ সুত্র নেই। হতাশ হয়ে ফিরে এক পার্কে বসে ভাবছিলেন কিভাবে ভগত সিং কে বাঁচানো যায়, কিন্তু সেই খবর ইংরেজদের কাছে পৌঁছে দেন আমাদের প্রিয় চাচা জওহরলাল নেহেরু। তাৎক্ষণিক ঘিরে ফেলে চন্দ্র শেখর কে, শেষ রক্ষা হয়নি নিজেকে ইংরেজ দের হাতে তুলে দেবে না বলে নিজের বন্ধুকের গুলিতে আত্মঘাতী হন। এমনকি ভগত সিং এর ফাঁসি যে দিন হবার ছিল গাঁধীর প্ররোচনাতে আগের দিন রাতে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল, এই ভাবে বীর শহীদরা সন্ত্রাস বাদী তকমা নিয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছেন না ফেরার দেশে।
ভারতবর্ষ  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধতে অংশ গ্রহণের ব্যপারে সুভাষ বোস খুশি ছিলেন না, সে সময়ে তিনি নজর বন্দি ছিলেন এলগিন রোড এ তার নিজস্ব বাড়িতে। বুঝতে পারেন যে ব্রিটিশরা তাকে যুদ্ধের আগে ছাড়বে না তাই দুটি মামলা বাকি থাকতেই তিনি আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানী তে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি পশতু ভাষা জানতেন না তাই ফর ওয়ার্ড ব্লক এর উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নেতা মিয়া আকবর শাহ কে সঙ্গে নেন। মিয়া আকবর এর পরামর্শে তিনি অধিবাসীদের কাছে বোবা ও কষলা হিসাবে পরিচিত হন। কারণ ওই দেশগুলি তে হয় তো তাকে ব্রিটিশ অণুচর ভাবতে পারেন। সেখান থেকে নেতাজি সুভাষ মস্কোতে গমন করেন, ইতালির “কাউন্ট অর ল্যান্ড মাজ্জট” নামক এক নাগরিকের পরিচয়ে। মস্কো থেকে জার্মান পৌঁছান। বারলিনে মুক্ত ভারতীয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ভারতের স্বাধীনতার জন্যে এডলফ হিটলারের সাহায্য প্রার্থনা করেন কিন্তু এ ব্যপারে হিটলারের উদাসীন মনোভাব তার মনোবল ভেঙে দেন কিন্তু তিনি ও নাছোড় বান্দা, ১৯৪৩ সালে তিনি জার্মান ত্যাগ করেন। একটি জার্মানির সাবমেরিন তাঁকে জাপান সাব মেরিনে পৌঁছে দেন, সেখানে তোজোর সাহায্য প্রার্থনা করেন, তবে তাঁকে হতাশ করেনি তোজো। তবে তার বীরত্বতে হিটলার, তোজোর মতো একনায়ক তন্ত্রে বিশ্বাসীরা ও তার সামনে মাথা নত করে মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দেন।




১৯৪৩ সালে ২১শে অক্টোবর তার একান্ত ঘনিষ্ঠ সঙ্গী রাস বিহারী বসুর সহায়তায় গড়ে তোলেন “আজাদ হিন্দ বাহিনী"। এই বাহিনীর দায়িত্ব নেন সুভাষ বোস নিজেই। তিনি তিরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন,এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই দিন রবি ঠাকুরের বিখ্যাত সঙ্গীত “জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে” কে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এই স্বাধীন সরকার একটি নারী বাহিনী ও গড়ে তোলেন নাম দেন “ঝাঁসি বাহিনী”।এই সরকারে নিজস্ব ব্যাংক, মুদ্রা, আইন ও বিচার ব্যবস্থা ছিল। মোট সাতটি দেশ তাদের স্বীকৃতি দেয়। হয় তো সেটাই সহ্য হয়নি স্বদেশের নেতাদের কারণ তারা জানতেন যে নেতাজি যদি ফিরে আসেন স্ব মহিমায় তিনি হবেন প্রধান মন্ত্রী যেটা মেনে নিতে পারেনি নেহেরু, গাঁধী, বল্লভ ভাই পটেল, দামোদর সাভাররের মত নেতৃ বর্গরা। তাঁরা সবাই নেতাজি র সাথে চরম বেইমানি করেন. ক্ষমতার লোভে নেতাজির আহবান এ সাড়া দেয়নি কোনো নেতা। মহাত্মা গাঁধী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, নেহরু বলেন তাকে তরবারি দিয়ে আহবান জানানো হবে। সেদিন যদি নেতাজি র ডাকে সাড়া দিতেন ১৯৪৭ সালের অনেক আগেই লেখা হতো মুক্তির ইতিহাস। ক্ষমতা লোভের অভিবাসনষয় মরতে হতো না হাজারো মানুষ কে নোয়া খালির দাঙ্গায়। ভারতবর্ষ থাকতো অখন্ড। কিন্তু না গোপনে ঠান্ডা মাথায় চুক্তি সেরে ফেলেন ব্রিটিশ দের সাথে। না আর তার ভারতে ফেরা হয় নি, স্বপ্ন অধরা থেকে যায় নেতাজি সুভাষ এর। ব্রিটিশ রা ভারত ত্যাগ করেছেন অনেক বছর কেটে গেছে কিন্তু আজও দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি গুলি থেকে ব্রিটিশ রা আজও রয়ালটি পায়, এই চুক্তি আজও কেনো লাগু হয়ে আছে, কেনো কে দেবে তার উত্তর? ভারতের সম্পদ অন্য দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো কে মজবুত করে চলেছে অথচ ভারতে অনাহারে অ পুষ্টিতে ভুগে মারা যান প্রতি মিনিটে, প্রতি ঘন্টায়। ১৯৪৬ সালে দামোদর সাভার কর বলেছিলেন যে, যুদ্ধ যখন দোর গোড়ায় হাজির তখন এই যুদ্ধে ব্যপক ভাবে নাম লেখাতে হবে ব্রিটিশ বাহিনীতে। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন আপন লক্ষে। কয়েক বছর ধরে ৎবপৎঁরঃসবহঃ পবষষ ব্যপক ভাবে সংঘটিত করে ব্রিটিশ বাহিনী তে হিন্দু দের নিয়োগ করেন এবং এদের দ্বারা তিনি দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল ধরে এগিয়ে আসা আজাদ হিন্দ বাহিনীকে আটকাবে বলে সিদ্ধান্ত নেন। ব্রিটিশ দের অত্যন্ত অনুরাগ ভাজন হিন্দু সেবকরা উত্তর পূর্বাঞ্চল এর বাহিনীকে বিধ্বস্ত করেন ও অনেক সেনা কে হত্যা করেন। এখান থেকে কি মনে হয়? একথা কি এক দম অবিশ্বাস করা যায় কি, ব্রিটিশ দের ২০০ বছরের রাজত্ব এর মূল কারণ আমরাই। আজও আমরা জেনে শুনে নিজেদের কবর খুঁড়ে চলেছি। আজও একটা ভয় সবার তাড়া করে বেড়াচ্ছে সবার কারণ যদি নেতাজি আবার স্ব মহিমায় ফিরে আসে কি হবে? কেনো তার অন্তরর্ধষন রহস্য উন্মোচন হয় নি? সবাই জানি তবু ও চুপ কারণ আমরা দাসত্ব টা খুব ভালো বুঝি হয় তো, আজ বলতে ইচ্ছে করে “হে আমার মুক্তি দাতা ব্রিটিশ, ফিরে এসো দাসত্ব আমার জন্মগত অধিকার”। রাষ্ট্র সঙ্ঘের খাতা তে আজও তাকে যুদ্ধ অপরাধী হিসাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কি সত্যিই যুদ্ধপরাধী? এর উত্তর জানতে চেয়েছে কেউ কোনোদিন, না জানতে চায় নি। কারণ কেঁচো খুঁড়ে কেউটে বার করার ইচ্ছে কারো নেই সেটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায়। তিনি প্রকাশ্যে এলে তাকে তুলে দিতে হবে রাষ্ট্র সঙ্ঘের হাতে সেখানে তার বিচার হবে. কিন্তু কেনো তাকে তুলে দিতে হবে রাষ্ট্র সঙ্ঘের হতে? বিধাতার কি নিষ্ঠুর পরিহাস, দেশের এক সন্তান নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেশ কে মুক্ত করতে চেয়েছিল নিঃস্বার্থ ভাবে তাকেই আজ দেশ ছাড়া হতে হল আজীবন এটাই কি নোংরা রাজনীতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আর আমরা সবাই শীত ঘুমে ব্যস্ত। নেতাজি সুভাষ কে রাষ্ট্র সঙ্ঘের হতে তুলে দেবার মেয়াদ ছিল ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত কিন্তু তা বাড়িয়ে ২০২১ সাল করা হয়। যদি প্রশ্ন করা যায় ১৯৪৫ সালে নেতাজি জাপানের তাইহকু বিমান বন্দরে বিমান ধ্বংসে মারা যান তবে তাকে রাষ্ট্র সঙ্ঘর হাতে তুলে দেবার প্রশ্নটা কেনো উঠেছিল। আর কেনো বা ১৯৯৯ থেকে আবার ২০২১সাল করা হয়েছিল এর উত্তর কে দেবে? তবে কি সর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে আছে।



ফিরে এসো হে নেতাজি সুভাষ আজও আমরা তোমার অপেক্ষায় দিন গুনে চলেছি। তুমি এসে সবার চক্রান্ত করে দেবে বানচাল, তুমি এসে ধর এই দেশের ঢাল। তোমার জন্যে আজও আমাদের হৃদয়ের আসন শূন্য। তুমি ফিরে আসবে স্ব মহিমায়। সত্যি তিনি যদি আবার ফিরে আসে?তিনি মৃত একথা আমরা মানি না। যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করে যাব তার আসার অপেক্ষায়। তিনি আজও বেঁচে আছেন এবং থাকবে আমাদের হৃদয়ে। তার বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে যে কাহিনী চলে আসছে তা নিছক মিথ্যা। তাই তার অন্তরধান রহস্য এর উন্মোচন কিনারা পাওয়ার জন্যে আমরা সবাই মিলে লড়াই শুরু করি।আমরা সত্যি জানতে চাই  তাঁর অব্যক্ত জীবন কাহিনী।স্বাধীনতার পরে ভারতে অনেক রক্ত ক্ষয় আন্দোলন হয়েছে. জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবাদী  মহ:আফজল  গুরুং এর ফাঁসি রদ করতে, কাসভের ফাঁসি রদ করতে আন্দোলন, কলকাতা মেট্রো তে চুম্বন আন্দোলন, যাদবপুর বিশ্ব বিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে চুম্বন, ন্যাপকিন আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দলাদলি আন্দোলন। কিন্তু নেতাজি সুভাষ কে নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই, হয় নি কোনো আন্দোলন। ২৩ শে জানুয়ারি তার ১২৩ তম জন্ম দিন, দেশের প্রতি এই আত্ম ত্যাগ অস্বীকার করে এমনে মানব কোথায়। যদি প্রশ্ন করা হয় গুজরাতে বিশ্বের সবচেয়ে উচু মূর্তি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল করা হলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে তবে নেতাজি সুভাষ এর মূর্তি কেনো নয়? বঙ্গ সন্তানের প্রতি এই অবিচার আমাদের দেশের কত খানি লজ্জার তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বলা হচ্ছে যে প্রধান মন্ত্রী রাজনৈতিক স্বার্থে সুভাষ বোস কে তার প্রাপ্য সন্মান দিয়েছে দিল্লিতে। যদি সত্যি রাজনৈতিক স্বার্থ হয় তবে আমরা আশা করব ভবিষ্যতে কোনো নেতা রাজনৈতিক স্বার্থে নেতাজির  অন্তর র্ধষন রহস্য উন্মোচন করতে পারবে সেদিন হয় তো এই দেশ সত্যি সত্যি স্বাধীন হবে, তেমন নেতার প্রতি আমরা সবাই কৃতজ্ঞ থাকবো।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট