ভালো থেকো শৈশব ও কুয়াশার রাত !

 


ভালো থেকো শৈশব ও কুয়াশার রাত...

মুহাম্মাদ রাহাতুল ইসলাম 


নিশুতি রাত। চারপাশ নিঝুম নিস্তব্ধ। প্রচন্ড শীত। ঘন কুয়াশায় ফ্যাকাসে হয়ে গেছে শেষ রাতের উজ্জ্বল চাঁদের আলো। শীতে রাত দীর্ঘ হয়। তাছাড়া গ্রামে ঠান্ডার প্রকোপে ঘুমানো হতো সন্ধ্যার পরপরই। তাই প্রায়শই ঘুম ভেঙে যেতো রাত পোহাবার আগেই। এই হাড়কাঁপানো শীতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কান পেতে শুনতাম টিনের চালে টুপটাপ কুয়াশা পরার শব্দ। কত শত কথাই না ভাবতাম। মনের আঙিনায় উঁকি দিতো কত অবান্তর প্রশ্ন। হঠাৎই জপজপ শব্দে উড়াল দিতো ডালে বসে থাকা রাতজাগা কোনো দাঁড়কাক। দূরে কোথাও ডেকে উঠতো তেজি রতা মোরগ। মুহুর্তেই তার সাথে সুর মিলিয়ে আওয়াজ তুলতো এবাড়ি ওবাড়ির ঘরকুনো মোরগ দল। মুরব্বিরা বলতো মোরগারা রাতে সময় মাফিক ডাক দেয়। একটা নির্দিষ্ট সময়েই না-কি তারা ডেকে উঠে প্রতিদিন। গ্রামে প্রচুর শীত পরে। শীতের প্রকোপে কাবু হয়ে যেতো গৃহপালিত পশুরাও। 

ফজরের আজান হলে যখন মা নামাজের জন্য উঠতো তখন সোয়েটারটা কাঁথার ভিতর দিয়ে যেতো। যাতে গরম হয়। উঠে মক্তবে যেতে হবে। সোয়েটার ঠান্ডা বলে কোনো অযুহাত পেশ করার সুযোগ নেই। 

আস্তে আস্তে সকাল হয়ে যেতো। আমাদের অজপাড়াগাঁয়েও আসতো সোনালী সূর্যটা। মিহি কুয়াশাকে বেধ করে তার উজ্জ্বল কিরণ এসে পড়তো গাছের সবুজ পাতা ও ঘাসের উপর। মুক্তা দানার মতো চকচক করতো তরল শিশির। 

সকালে মক্তবে যাওয়ার আগে কিছু খাওয়া ছিলো অলিখিত আইন। বেশির ভাগই বাড়ি থেকে খেয়ে যেতাম। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে খেতে খেতেই চলে যেতাম মক্তবে। 

একটা নীল সোয়েটার পরে মক্তব ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। পায়ে খয়েরী রঙের বাটা সেন্ডেল। পরনে টেইলার্সের দোকানে বানানো মোটা সুতি কাপড়ের হাফ প্যান্ট। মা আব্বুকে বলে সোয়েটারটা কিনিয়েছে আমার জন্য। এই একটা সোয়েটারের কথাই খুব বেশি মনে পরে। এটা আমার সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতি। এরও আগের বিক্ষিপ্ত কিছু স্মৃতি ছাড়া তেমন কিছু স্মরণ করতে পারছি না। সত্যি বলতে সোয়েটারটা আমার একদমই পছন্দ হয়নি। তবুও বেশ কয়েকটা শীত পার করে দিয়েছে এটা পরে। কতজনের থেকেই যে তাদের কারুকার্য ম-িত মনোমুগ্ধকর শীতবস্ত্রের দাম জিগ্যেস করেছি তার হিসেব নেই। কিন্তু বাবা মায়ের কাছে সে দামের জেকেট বা শীতবস্ত্র ক্রয়ের আবদার করার মতো যথেষ্ট সাহস আমার ছিলো না। কালেভদ্রে উচ্চবাচ্য করলেও আমি ছিলাম নিরেট বোকাসোকা। সুবোধ বলাক বলতে যা বুঝায় তার পুরোটাই। মক্তবে আমরা গ্রুপ গ্রুপ হয়ে পড়তাম। সূরা, কায়দা আমপারা ও কোরআন শরীফ। সূরার গ্রুপ হলো একদমই ছোটদের। যারা হরফ চিনেনা। শুধু মুখে মুখে ছোট ছোট সুরা পড়ে। মুখস্থ করে। এরপর একের পর এক ধাপ অনুযায়ী। প্রত্যেক গ্রুপ আবার একাধিক ভাগে বিভক্ত থাকতো। তবে ক্বারী সাহেব সবাইকে ছুটির একটু আগমুহূর্তে এক সাথে মশকো করাতেন। । আমরা ছুটির উন্মাদনায় চিৎকার করে পড়তে থাকতাম। ‘দোয়ায়ে কুনুত আল্লাহুমা ইন্না নাসতায়িনুকা- অনাসতাগফিরুকা’

মক্তবে যাওয়ার পর অনেকের সাথেই পরিচয় হয়। ওরা অবসরে ঘুড়ি উড়ায়, লাটিম ঘুড়ায়, মারবেল খেলে। আর আমি একা-একা ঘরে বসেই খুটিনাটি করি। আস্তে আস্তে পরিচিতি বাড়তে থাকে। মক্তবের নিয়ম অনুযায়ী আমি ধাপ পেরিয়ে কোরআন শরীফ হাতে নেই। ক্বারী সাহেব প্রথম সবক শুরু করেন। আমরা একত্রে সুর দিয়ে পড়ি ‘আলিফ-লাম-মিম’ ‘যা লিকাল কিতাবু লা রয় ইবা ফিহ’। সকালে রোদে বসে ভাত খাওয়াটা ছিলো ভীষণ মজার। পান্তা ভাত, শুকনা মরিচ ভাজা আর কয়েক রকম ভর্তা। বিশেষ করে সিম ও সিমপাতা ভর্তার কথা খুব বেশি মনে পরে। নতুন ধনিয়া পাতা দিয়ে বানানো হতো। ধনিয়ার মতো ঘ্রাণ যুক্ত আরেকটি পাতাও দেয়া হতো কখনো সখনো। আমরা বলতাম ভিলাতি ধনিয়া।

আমাদের ধনিয়া ক্ষেতটা এখন আর নেই। নদীতে ভেঙে গেছে। নেই শৈশব আর শৈশবের বাড়িঘরগুলোও। একবুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাই। মনে মনে বলি, ভালো থেকো শৈশব ও কুয়াশার রাত।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট