দূরুত্ব
মুহাম্মদ রাফিউল আলম
...কিছু না। শুধু এক চার আনা কম লাগবে। ঘাট এসে গেছে। কথাগুলো বলেই সোহাগ চুপ হয়ে যায়!
‘মানে?
‘সব সত্য জানতে নেই।
‘আমাকে কোনদিন ভুল বোঝনা জুহি! তোমার দিদিকে, বিশ্বাস করো তোমার
দিদিকে আমি আঘাত করতে চাইনি।
‘দিদি! হ্যাঁ দিদিই বটে! মাসতুতো। আসলে কি জানো দাদা, তুমি সব সময় ভুল মানুষকে চয়েস করো। আর ভালো মানুষগুলোকে চিনতেই পারো না। তুমি মানুষ চিনলেনা এখনো।
‘তুমি এখনো অনেক ছোটো। তাই তোমার এমনটা মনে হয়। থাক এসব কথা, বলো কেন সেদিন হঠাৎ করে রাগ দেখিয়ে চলে গেছিলে?
‘না থাক। এক চার আনা কম লাগবে। ঘাট এসে গেছে।
‘হা হা হা......
সোহাগের কথাটাই রিপিট করে জুহি! সে বুঝতেও পারেনা এই এক চার আনার
মানেটা আসলে কি! অথচ পাকা গৃহিনীর মতো হাবভাব। দেখে বোঝায় যায় না বয়স মাত্র পনেরো!
‘জানো দাদা, তোমাকে না আমার নিজের দাদার মতোই মনে হয়। তুমি আমার দাদা হবে?
‘না। আমি তোমাকে সে চোখে দেখিইনি কোনদিন। তাছাড়া এত সুন্দর একটা
সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়! এত সুন্দর একটা কিউট মিষ্টি মেয়েকে, না,না আমি তোমার দাদা হতে পারবোনা।
‘মানে?
বিস্ময়ে জুহির চোখ দু’টো বড় হয়ে যায়!
‘তাহলে কি!
‘এই ছোট্ট পাগলী সোনাটাকে আমার শালি বানাতে চাই, হা হা হা...
‘তুমি না, যাও তোমার সাথে আড়ি।
‘দুর পাগলী! তুমি তো আমার বোনের মতোই। তোমার সঙ্গে জাস্ট একটু মজা
করলাম......কিন্তু সেদিন রাগ করেছিলে কেন সেটা বললে না তো?
‘একটা কথা বলবে দাদা?
‘উহুঁ! দাদা না---দুলাভাই। হা হা হা......
‘ওহ নো! আই এম সিরিয়াস।
‘ওকে! ওকে! বলো।
‘তুমি কি বৃষ্টিদি কে সত্যিই...
না! সোহাগ আর কথা বলতে পারেনা। একটা নিস্তব্দ পরিবেশ। বোটটাকে সে এবার ঘাটের দিকে নিয়ে আসে । বৃষ্টি চেপেছে অন্যদের বোটে। অন্যদের বোট
বললে অবশ্য ভুল হবে। অঙ্কিতা, শিবানি, রাহুল আর বৃষ্টি। সোহাগ জানে কেন সে রাহুলের সঙ্গে ওই বোটে......সোহাগও বৃষ্টির মনে জ্বলন সৃষ্টি করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই জুহির সঙ্গে এই বোটে এসেছে। এই শীতল পরিবেশেও দু’টো হৃদয়ে জ্বলে চলেছে চিতার আগুন। শুধু বুঝতে পারছেনা রাহুল আর জুহি তাদের পাশেই পোড়ার গন্ধ! পিকনিক স্পটে যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। যে যার পছন্দের তারা দল করে নিয়েছে নিজের মতো করে। শুধু জুহির পছন্দের দিদি আর দাদা আজ দলছুট! নতুন দলে!
‘দাদা চলনা, পাহাড়ে চড়ি। জানো দাদা, ঝরনার জলের কথা আমি বইয়ে
পড়েছিলাম। স্ব-চক্ষে দেখবো ভাবতেই পারছিনা। মনে হচ্ছে যেন রূপকথার জগতে ঘুরছি। আনন্দে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। পাহাড়ের গা বেয়ে বয়ে যাচ্ছে জলধারা। এতসুন্দর জগত্টা যে সৃষ্টি করেছে সে না জানি কতই সুন্দর!
জুহির কথাগুলো শুনে সোহাগের অবাক লাগে! এইটুকু একটা পুঁচকে মেয়ে তার মনের ভেতর এত গভীরতা। ঝরনার এই অপরূপ রূপ ক’জনের চোখেই বা এত সুন্দরভাবে ধরা পড়ে! কই আমার চোখে তো ধরা পড়ছেনা এই রূপের ছটা! প্রথমে এসেই আমি ঝরনাটাকে দেখেছি, কি দেখেছি? পাহাড়ের চোখ জল দেখেছি অবিকল ঝরনাধারা! মুদ্রার অন্য পিঠ! বৃষ্টি কি আমাদের মতোই অনুভব করতে পারছে এই ঝরনাটাকে! নাকি তার সন্দেহপ্রবণ চোখ দেখে গেছে ঝরনার তৃতীয় রূপ!
‘কি হল দাদা? চলো।
সোহাগের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় পাহাড়ের উপরে। দাদার অধিকারে সোহাগের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। শিবানি আর বৃষ্টি নেমে আসে নীচে। পেছনে রাহুল আর অঙ্কিতা। সহজ
বিশ্বাসে এগিয়ে যায় জুহি, প্রথম থ্রোটা ভেসে আসে অঙ্কিতার কাছ থেকে।
‘হাতটা একটু শক্ত করে ধরিস। নাহলে পড়ে যাবি! ‘দেখিস বোন! পাহাড়ের রাস্তা কিন্তু খুব এবড়ো খেবড়ো!একটু সাবধানে যাস।
দ্বিতীয় থ্রো টা করে বৃষ্টি। জুহি হাসে।
‘না দিদি। দাদা আছে, ভয় নেই।
সোহাগ বুঝতে পারেনা বৃষ্টি কেন তাকে বারবার আঘাত করে! সে তো এখন বৃষ্টির দিকে ফিরেও চায়না। এমন সময় পাহাড় থেকে নেমে আসে তাদেরই আর একটা দল। অঞ্জু, সুস্মিতা আর আবির। জুহি সুযোগটা কাজে লাগায়।
‘আরে অঞ্জু দি! তোমার পাহাড় দেখা হয়ে গেল?
‘পাহাড়ের আর কি দেখবো বলো!
সুস্মিতা সব মাটি করে দিল। ভাবলাম পাহাড়ে উঠে একটা সেলফি তুলবো!
‘তুই যা না। আমি আবিরের সঙ্গেই চলে যাচ্ছি। কিছু দুর উঠেই সুস্মিতার
মাথা ঘোরে। উঁচুতে উঠতে তার ভয়। তাই সে ফিরে আসে। সুস্মিতা আর আবির নীচে নেমে যায়। সোহাগদের সাথে যোগ দেয় অঞ্জু। বৃষ্টি মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়। এবার শিবানি থ্রো করে বৃষ্টিকে।
‘তুই আর একবার যাবি নাকি!
‘তোর ইচ্ছা হলে তুই যা।
‘চলো---রাহুল।
বাধ্য ছেলে মেয়ের মতো অঙ্কিতা আর রাহুল নীচে নেমে যায়। শিবানিও দলছুট হতে চায়না। কিন্তু অকারন সোহাগকে যখন তখন অপমান করা সে মেনে নিতেও পারেনা।
‘কি দাদা! তুমিও যাবে নাকি? হা হা হা......
একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে ওপরের দিকে এগিয়ে যায় সোহাগ। পিছন
পিছন জুহি আর অঞ্জু। জুহি এবার অঞ্জুর সাথেও দুষ্টুমি করতে ছাড়েনা । সে জানে অঞ্জুর দুর্বলতা। জুহি কোনদিন ভাবতেই পারেনি সোহাগের মতো একটা ছেলে তার বৃষ্টিদির মতো এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসতে পারে। বৃষ্টিই তাকে একদিন বলেছিল । অঞ্জু আর সোহাগের মাঝে কোন গোপন রিলেশন আছে! জুহি বিশ্বাসও করেছিল! কিন্তু যেদিন সোহাগের গোপন ডাইরিটা পড়ে ফেলেছিল সে
ছেলেমানুষী ভুলে সেদিন তার বুঝতে অসুবিধা হয়নি সোহাগের সমস্ত তনু মন
প্রাণজুড়ে দেবীরূপে কে অধিষ্ঠান করে আছে! একদিন জুহিও দুর থেকে আর পাঁচটা খারাপ ছেলের দলেই ফেলেছিল সোহাগকে। বাইরে থেকে দেখলে তাকে
এমনটাই মনে হয়। সে শুনেছিল সোহাগের সঙ্গে অনেক মেয়ের রিলেশন আছে!কিন্তু সে তো কোনদিন দেখেনি কারো সঙ্গে ঘনিষ্ট হতে! একদিন বৃষ্টিও সোহাগ বলতে অজ্ঞান ছিল। আর এখন যেন দুই মেরুপ্রান্তের দু’টো জীব। বৃষ্টির চোখে ঘৃণা। সোহাগের চোখে শুধুই ভালোবাসা।