হারান মাঝি
আজাদ মণ্ডল
হারান মাঝি ইদানিং কালের অনেক কিছুই ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। সে কারণ খুঁজে, তেমন কিছু হাতরিয়ে পায়ও না, মুর্খ বলে জ্ঞানের পরিসীমার ঘাড় দোষ চাপাতে তার মনে বাঁধা আসে। সব জ্ঞান তো বই পাতার অক্ষরের মধ্য লুকিয়ে থাকে না। সব না হোক, কিছুমিছু বুঝার জন্য তো বয়সই যথেষ্ট। সেই বয়সতো তার হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় ঘাট অঘাট হয় আবার অঘাট ঘাট হয়,এই ধারা সেই আদ্যিকাল হতে, কিন্তু কিছু কিছু জীবন প্রবাহের ঘাট থাকে সেগুলোর উপড় রঙিন প্রলেপ দিতে গেলে সুন্দরের চেয়ে অসুন্দরই হয় বেশি। সামান্য একজন খেয়া ঘাটের মাঝির গভীর রাতে নানারূপ দার্শনিক চিন্তা ভাবনা করা, আদার ব্যাপারি জাহাজের খবর রাখার মতো মনে হয়। কিন্তু চারপাশে যেরকম অঘাটের ছড়াছড়ি, তাতে খেয়া নৌকার মাঝিই কি আর বিশাল জাহাজের ক্যাপ্টেন কি, পথের একজন ভিক্ষুকও তো রাতের গভীরে একাকী চিন্তা ভাবনা করতে পারে!
আলম ব্যাপারীর হাঁকে, মাঝির বুঝতে না পারার চিন্তা ভাবনার ছেঁদ পড়ে-
-মাঝি ঘুমাইয়া পরছো নাকি?
নদীর সাথে লাগোয়াই মাঝির ছই ঘর, সেই ছই ঘরের ফুটা দিয়ে আকাশ দেখা যায়, এই আকাশ দেখেই মাঝি মাঝে মাঝে দার্শনিক হয়ে উঠে। ব্যাপারীর ডাকে সে বিছানা হতে উঠে বিড়ি ধরায়, কান টুপি আর চাদর জড়িয়ে কাশতে কাশতে বাইরে বেড়িয়ে আসে-
-তোমারে পার না কইরা ঘুমাই কেমনে বেপারী,
ব্যাপারী এগিয়ে আসে, কৃতজ্ঞস্বরে বলে-
-এই বয়সে, শীতের মধ্য আমার জন্যি জাইগা থাহো, খারাপ লাগে মাঝি। কি করমু কও?
ব্যাপারীরপ্রায় প্রতিদিনের একই কথা মাঝি আমলে নেয় না, তার কাজ খেয়া নৌকায় মানুষ পারাপার করা, এতে দিন দুপুরই কি আর রাত দুপুর কি? মাঝি ব্যাপারীর জন্য প্রস্তুতও থাকে, যত রাতই হোক একজন এসে তাকে দুঃখস্বরে ডাকবে ‘ মাঝি ঘুমাইয়া পরছো নাকি?’ বহুদিনের অভ্যাসে এই ডাকের প্রতি তার আলাদা একটা মায়ার জন্ম নিয়েছে। তাছাড়া গভীর রাতে নদীর বুকে নৌকা চালানো অন্যান্য সময়ের চেয়ে তার অধিক মধুর মনে হয়, চারদিক পরিপূর্ণ নিরবতা, সারা পৃথিবীর মানুষ ঘুমের ঘোরে, এমনক্ষণে চাঁদের আলোয় রুপালী ঢেউ খেলানো পানির মধ্য বৈঠা চালানোর চপচপ শব্দ কিংবা ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্য নৌকা নিদিষ্ট ঘাটে বেয়ে নেওয়ার মধ্য মনভরা সুখ আছে, এই সুখকে তার স্বর্গ মনে হয়।
মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মাঝি হাঁক ছাড়ে-
-কি আর করবা, কপাল বইল্যাও তো কিছু একটা আছে! কপালের নাম গোপাল তো মাইনসে হুদা হুদি রাহে নাই! উইঠা বসো।
ব্যাপারী নৌকায় উঠে বসে, মাঝি নৌকা ছেড়ে দেয়, প্রায় ঘন্টা খানিক সময়ের যাত্রা, শীতের দাপটে চুপসে যাওয়া নদীতে মাতাল হাওয়া বয়ে যায়, অন্যান্য রাতে মাঝি গান ধরে, কিন্তু আজ তার মাথায় দার্শনিক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, গলার সুরটা নদীর ঢেউয়ের মতোই উঠানামা করছে। এক জায়গায় স্থির নাই। সে তাল মিলাতে পারছে না। স্বর্গের অমৃত সুধা কেনো যেনো চিরতা গাছের রসের মতো মনে হচ্ছে।
ব্যাপারী মাঝির চুপচাপ বৈঠা চালানোর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না, বহুরাতের অভিজ্ঞতার সাথে আজকে যেনো কোন মিল নাই।
-কি ব্যাপার মাঝি চুপ মাইরা গেলা ক্যা? গান ধরো।
-আর গান! কিছু ভালা লাগে না বেপারী।
-ভালা লাগে না ক্যা? বউ তো নাই। নাকি ছাওয়াল মাইয়া দেখবার পারে না হেই জন্যি?
-আরে রাহো ছাওয়াল মাইয়া, বাপে খেয়া বায় তার জন্যি হেগোর শরম করে, এডা কুনো কথা অইলো কও?
-তাগো তো দোষ না, বুইড়াকালে তোমারে ওরা সুকে রাখবের চায়।
-বোগাজ কথা, আমার কিসে সুক হিডা আমি বুঝুম, ওরা নাক গলাইবের কেরা?
ব্যাপারী খিলখিল করে হেসে উঠে, সেই হাসি নিস্তব্দ নদীর বুকের কুয়াশা ভেদ করে অনেকদূর গড়িয়ে যায়।
-বয়েস বাড়ার হাতে হাতে তোমার জ্ঞান-বুদ্ধিও গাঙের পানির হাতে ধুয়া গেলোনি,
-বাদ দেও তো পোলাপানের কথা, হাট-বাজারের খবর কি,হিডা কও?
-হাট বাজারের খবর আর কইও না মাঝি, দ্যাশে নেতামেতা কাউয়ার মতো বাইড়া গেছে, খালি চানন্দা দেও আর চানন্দা দেও। স্কুলের মাঠে পালাগান হুনবার গেছিলানি?
ব্যাপারী মাঝির দার্শনিক চিন্তা-ভাবনার মূলে হাত দেয়, শীতের মধ্য গ্রামের স্কুলে পালা গানের আয়োজন সেই বহুকাল আগে হইতে, কিন্তু ইদানিং কালে পালাগানের প্রাচীন ঐতিহ্যের আয়োজনে যেন বাড়াবাড়িই লক্ষ্য। গ্রামের উঠতি বয়সের নেতাকর্মীদের অযথা অস্ফালনের হাকডাকে গানের মূল ¯্রােত বিপরীত দিকে বইতে থাকে। গানের চেয়ে, যাদের গানের সাথে কোন সম্পৃক্তা নাই তাদের গুন-কীর্ত্তনের সুরই বেশি বাজে। মাঝি গতরাতে গান শুনতে গিয়ে ধৈর্যহারা হয়ে গিয়েছিলেন, নেতা-নেত্রীদের গুন-গান গাওয়ার পর, প্রায় শেষ রাতের দিকে, গায়ক একজন উঠে যখন বন্দনা শুরু করলেন-‘ সত্য সনাতনও, নিত্য নিরাঞ্জনও, পতিত পবনও নিরাঞ্জন’। ব্যস লাগলো প্যাঁচ, দর্শকসারি হতে কয়েকজন দাঁড়িয়ে বন্দনার প্রতিবাদ শুরু করল, এই বন্দনা চলবে না। প্যাঁচ, পেচাতে পেচাতে যখন মাঠের সমস্ত মানুষকে পেচিয়ে ফেললো, মাঝি ফাঁক দিয়ে বেড়িয়ে এসে আকাশ সমান একবুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়ি ধরিয়েছিলেন।
ব্যাপারীর প্রশ্ন শুনে গতরাতের দীর্ঘশ্বাস মাঝির আবারো উথলে উঠলো-
-গেছিলাম তো।
-গান কেমন হুনল্যা? হুনলাম বাঘা বাঘা শিল্পী আনছে? চানন্দা তো ডবল দিলাম।
-চানন্দা ডবল দিছাও ঠিক আছে, গায়কও ভালা, তয় তাগো গলাতো হুনবার পারলাম না, হুনলাম খালি পাতি কাকগো কা কা।
-তাইতো হুনলাম, বন্দনাতে নাকি হাউকাউ লাইগ্যা গেছিলো।
-হ, ঠিকই হুনছো, মেলা কষ্ট পাইছি বেপারী, কিসব জাতপাত সবকিছুর মধ্য ডুইকা যাইতেছে, এডা কুনো কথা অইলো কও?
-হ বড়ই চিন্তার কথা, সমেস্যা অইলো যেনেসেনে পুলাপান মাতবরি করতেছে, পুলাপানের কাছে মাতবরি গেলে তো হাউকাউ অইবোই।
-কতাটা খারাপ কও নাই, বাপ-দাদার নাম নাই, নেতাপেতাগো ফটোর নিচে নিজের ফটো লাগাইয়া সবজায়গায় টানাইয়া রাখছে।
-কি করবা মাঝি, দুনিয়ার ক্ষ্যামতা সব অযোগ্যদের হাতে চইল্যা যাইতেছে। দুনিয়ার নিয়ম-কানুনও সব উল্টায়্যা যাইতেছে। দেহো না, এই টালের মধ্যি গাছে নতুন পাতা অইতেছে?
মাঝি কোন কথা বলে না, সে বহুবছরের খেয়া ঘাটের মাঝি, দীর্ঘজীবনে একমাত্র দেশ স্বাধীনের সময় সে জাতপাত নিয়ে কথা শুনেছে, তখন তার বয়সও কম ছিলো। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সেই জাতপাত নদীর পানির মতো ভাটির দেশে চলে গিয়েছে, কিন্তু গতরাতে যেভাবে গান শুরুর বন্দনা নিয়ে জাতপাত নদীর বুকে চর জাগার মতো জেগে উঠলো তাতে দুনিয়ার বাতাস যে এলোমেলো হয়ে দিক পরিবর্তন করছে, সেটা বড়ই চিন্তার ব্যাপার। বহুবছরের মানুষ পারাপারে তার বা তার জানামতে কেউ তো কোনদিন কারো জাতপাতের হিসাব করেনি। কারো সেটা মনেই হয়নি। গতরাতে হঠাৎ করেই গানের বন্দনার কথা নিয়ে প্যাঁচ লাগলো কেনো? কোন অসূর শান্ত শিষ্ট গ্রামে ভর করলো আর কেন করলো? তাহলে আর কোন আশঙ্কা ঝড় সামনে তৈরী হয়ে আছে?
মাঝির অন্তঃকোণের অশনি ঝড়ের অদৃশ্যে দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হলো না, সামনে বসা ব্যাপারীই অন্তর জ¦ালার ঘিয়ে আগুন জে¦লে দিলেন-
-তৈইরি থাইকো মাঝি, এই টালের মধ্যি তোমার ঘাটেও মনে অয় ঝড় আইবো।
ব্যাপারীর কথা মাঝি বুঝতে পারে না, সে ঠাট্টা ভাবে, তবুও তার মনে খক্টা লাগে, ঘাটে ঝড় আসবে মানে কি? এই ধরণের কথার অর্থইবা কি? সে বিড়ি ধরায়।
- এই টালের মধ্য মশকরা করো ব্যাপারী?
-মশকরা করি না মাঝি, তুমি আমার গভীর রাতের সাথী, তোমার হাতে মশকরা করা যায়?
মাঝির হাতের বৈঠা চালানোর বেগ কমে যায়, ইদানিং তার অল্পতেই বুক কাঁপতে থাকে, সত্যিই তো ব্যাপারীর সাথে তো তার ঠাট্টা-তামাশা করার সম্পর্ক না।
-তয় টালের মধ্য আমার ঘাটে ঝড় আইবো কেন? এহন কি ঝড় তুফেনের দিননি?
-এহন তো গাছে পাতা গজানোর দিনও না, গাছে পাতা অইতিছে কি জন্যি?
-ব্যাপারী, প্যাঁচ মাইরা কথা কইও না, বুক কাঁপতেছে।
-আরে বাবা, তোমার ছই ঘরের পাশে নতুন টিন দিয়া চেয়ারমেন ঘর বানাইছে ক্যা?
মাঝি ভেবে পায় না, ব্যাপারী এমনভাবে কথা বলছে কেনো, যার জায়গা সেখানে সে ঘর বানাক না চুলা বানাক সেটা তার ইচ্ছা, তা এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার কি আছে?
-ঘর তো বানাইছে মানসের আরামের জন্যি, খেয়া নাও ওপাড়ে থাকলে মানুষ যাতে রইদে কষ্ট না পায়।
-মাঝি সারাজিবন বোকা থাইকা চিনির বস্তা টাইনা গেলা, হাড়কাঁপা টালের মধ্যি গাছে নতুন পাতা কেন অয় হেইডা বুঝলা না।
-ব্যাপারী তোমার দুইখান পায়ে ধরি কথায় প্যাঁচ মাইরো না।
-করবো কিনা জানি না, বাজারে কানাঘুষা হুনলাম তোমার নাম বাদ দিয়া ঘাট অইবো চেয়ারমেনের নামে।
অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়, কিন্তু আচঙ্কা শোকে কি হয়? ব্যাপারীর কথা শুনে মাঝির সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো, এ কি শুনলো সে? শীতের মধ্যও তার সারা শরীর গাম ঝরতে লাগলো। হাতের আঁজলা ভরে জল খেতে গেলে, কাঁপা হাতের ফাঁক গলে জল পরে গেলো।
- দিন বদলাইছে মাঝি, এহন চেয়ারমেন এই ঘাটে মেশিন দিয়া নৌকা চালাইবো। তোমার ভাঙ্গা কোষা নাও কি এই জামানায় চলে? আর তুমি বুইরা অইয়া গেছাও, ছাওয়ালও লায়েক অইছে, শেষ বয়সে একটু আরাম আয়শে কাটাও।
মাঝি নির্বাক হয়ে গেছে, ব্যাপারীর সংকেত কথা সে ঠিকঠাক বুঝতে পারছে না, নৌকা ঘাটে থামলে ব্যাপারী অন্ধকারের মধ্য অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু মাঝির বুকের মধ্য সে যে ঝড় তুলে দিয়ে গেলো সেই ঝড় কিছুতেই অদৃশ্য হচ্ছে না, বনের মধ্যে আগুন লাগার মতো দাউদাউ করে কেবল বাড়তেই লাগলো..